খ্যাপাটে সিইও ইলন মাস্ক

কোনো প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে একজন কর্মী ৪০ ঘণ্টা কাজ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এর চেয়ে বেশি কাজ করলে ওই কর্মী মানসিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি তৈরি হয় শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিও। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়, কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহে ৫৫ ঘণ্টা কাজ করেন, তবে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ৩৫ শতাংশ, হার্টের অসুখে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে ১৭ শতাংশ। কিন্তু এ সময়ের আলোচিত ধনকুবের ইলন মাস্ক সপ্তাহে কাজ করেন ১০০ ঘণ্টার বেশি।

এ কথা বলে সম্প্রতি ইলন মাস্ক আলোচনায় এসেছেন, এমনটা নয়। এ কথা তিনি বেশ আগেই বলেছেন। সম্প্রতি তিনি আলোচনায় এসেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার কেনাকে কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেওয়ার পর একের পর এক ঘটনা ঘটাচ্ছেন আর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় শিরোনাম হচ্ছেন ইলন মাস্ক।

টুইটারকাণ্ড

টুইটার কেনার আগে কয়েক মাস জল ঘোলা করেছেন ইলন মাস্ক। গত এপ্রিলে তিনি জানান, টুইটারের ৯ শতাংশের বেশি শেয়ার তিনি কিনে নিয়েছেন। এত শেয়ার কিনলে সাধারণত যেকোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। নিয়ম অনুসারে, তাঁকেও টুইটারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু এতে সাড়া দেননি তিনি। বরং তিনি টুইটার পুরোপুরি কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নেওয়ার ঘোষণা দেন আলোচিত ধনকুবের।

কিন্তু টুইটারের মালিক তো একজন নন। অনেকে মিলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক। এই মালিকদের পক্ষ থেকে একটি পরিচালনা পর্ষদও রয়েছে। সেই পর্ষদে ইলন মাস্কের প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর তাঁরা প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। কিন্তু এরপরই শুরু হয় গোলমালটা। মে মাসে ইলন মাস্ক ঘোষণা দেন, তিনি প্রতিষ্ঠানটি কিনবেন না। কারণ, টুইটারের কর্তৃপক্ষ তাঁকে বেশ কিছু মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ভুয়া অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ফলে তিনি টুইটার কেনার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যান।

কিন্তু টুইটার কর্তৃপক্ষ নাছোড়বান্দা। তারা জানিয়ে দেয়, ইলন মাস্ক ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। এরপর টুইটারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। এই মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় ইলন মাস্কের। তিনি বুঝতে পারেন, প্রতিষ্ঠানটি না কিনলে তাঁকে জরিমানা গুনতে হবে। ফলে ওই মামলার রায় হওয়ার আগেই ২৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেন তিনি।

কেনার আগে বেশ মজা করেছেন ইলন মাস্ক। যেমন, প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেওয়ার আগের দিন ২৬ অক্টোবর টুইটার কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানে যাওয়ার একটি ভিডিও টুইটারে পোস্ট করেন। এতে দেখা যায়, হাতে একটি সিংক নিয়ে সদর দপ্তরে ঢুকছেন তিনি। এর ক্যাপশনে মজা করেই লিখেছেন, ‘আসুন, ডোবা যাক!’

কিন্তু কেনার পরই ইলন মাস্ক অন্য রূপে হাজির হন। ২৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি কেনার পরপরই টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পরাগ আগরওয়ালকে চাকরিচ্যুত করেন তিনি। একই সঙ্গে টুইটারের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা নেড সেগাল এবং আইন ও নীতিবিষয়ক প্রধান বিজয়া গাড্ডেকেও চাকরিচ্যুত করেন। এই তিন কর্মকর্তা তাঁকে বিভ্রান্ত করেছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন ইলন মাস্ক।

এরপর টুইটারের কর্তাব্যক্তি হিসেবে হাজির হন ইলন মাস্ক। সিইও পদে বসে যান তিনি। এরপর প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটি কেনার সময় কর্মী ছিল প্রায় সাড়ে সাত হাজার। কিন্তু মাস্ক দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় অর্ধেক কর্মী ছাঁটাই করেন। এ ছাড়া তিনি ঘোষণা দেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হবে।

ইলন মাস্কের এই আহ্বানে সাড়া দেননি অনেকেই। ফলে অনেকেই নিজ থেকেই চাকরি ছেড়ে দেন। ইলন মাস্ক বুঝতে পারেন, সংকট আসন্ন। পরিস্থিতি সামাল দিতে টুইটারের সব কার্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন।

এ তো গেল অফিস ও পরিচালনাকেন্দ্রিক কাণ্ডকারখানা। এর বাইরে নীতিনির্ধারণী-সংক্রান্ত বেশ কিছু এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি কেনার পর ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই প্ল্যাটফর্মে সবাই মত প্রকাশ করতে পারবেন। এমনকি ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে টুইটারে নিষিদ্ধ হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ্যাকাউন্টও ফেরত দেন তিনি (যদিও ট্রাম্প এই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছেন না)।

কিন্তু এই ঘোষণা দিয়ে ঠিক উল্টো কাণ্ড ঘটিয়েছেন ইলন মাস্ক। তাঁকে নিয়ে খবর প্রকাশ করায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের অ্যাকাউন্ট সম্প্রতি বন্ধ করেছিলেন তিনি। পরে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইলন মাস্কের সমালোচনা করে। এই সমালোচনা ও হুমকির মুখে সাংবাদিকদের অ্যাকাউন্ট ফেরত দেন তিনি।

টুইটার কেনার পর ইলন মাস্ক ঘোষণা দেন, এখন থেকে টুইটার অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড করতে টাকা দিতে হবে। এই ঘোষণার পর নানা বিপত্তি দেখা দেয়। অনেকেই অন্যের নামে অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করে নেন। এতে সংকট সৃষ্টি হয়। ইলন মাস্কও ক্ষতিগ্রস্ত হন। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম কমে যায়।

সর্বশেষ কাণ্ড ঘটান সিইও পদে থাকা নিয়ে। টুইটারে তিনি তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে জানতে চান, তিনি সিইওর পদ ছাড়বেন কি না। টুইটার ব্যবহারকারীদের মতামত নিতে গিয়ে বিপাকেই পড়েন ইলন মাস্ক।

ইলন মাস্কের টুইটার হ্যান্ডলে অনুসারী রয়েছেন ১২ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ ভোট পড়েছে ওই জরিপে। এতে ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ টুইটার ব্যবহারকারীর রায় হলো, সিইওর পদ থেকে ইলন মাস্কের সরে দাঁড়ানো উচিত। আর ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবহারকারী চান তিনি এই পদেই থাকুন। এরপর কয়েক দিন নীরব ছিলেন ইলন। পরে নীরবতা ভেঙে ঘোষণা দেন, তিনি এই পদে থাকবেন না। তবে এই পদের জন্য যোগ্য মানুষ আগে খুঁজে পেতে হবে।

এ নিয়েও মজা করে টুইটার পোস্টে ইলন মাস্ক লেখেন, ‘টুইটারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমার মতো একজন বোকা ব্যক্তি খুঁজে পেলেই সিইও পদ থেকে সরে যাব। তারপর আমি শুধু সফটওয়্যার আর সার্ভার টিমের দেখাশোনা করব।’

টুইটার নিয়ে বেশ খামখেয়ালি আচরণ ইলন মাস্ক করেছেন। এর খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে। অনেক বড় বড় কোম্পানি টুইটারে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে; অর্থাৎ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি।

ইলন মাস্ক এমনই

খামখেয়ালি আচরণ, নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠান চালানো, যখন-তখন কর্মী ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে ইলন মাস্কের পরিচিতি রয়েছে। তাঁর বৈদ্যুতিক গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা তখন তাদের মডেল-থ্রি গাড়ির উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। টেসলার প্রধান ইলন মাস্ক তখন কাজের চাপ সামলাতে প্রতিষ্ঠানটির কারখানার কনফারেন্স রুমে ঘুমাতে শুরু করেন। তিনি তখন বিনা নোটিশে কোম্পানির কর্মী এবং নির্বাহীদের বরখাস্ত করেছিলেন।

সম্প্রতি টুইটারে এমন ঘটনাই ঘটল। কর্মী ছাঁটাই, দেউলিয়াত্বের আশঙ্কা, কর্মীদের কঠোরভাবে কাজের নির্দেশ দেওয়া—এগুলো বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের জন্য নতুন কিছু নয়। ইলন মাস্ক গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি টেসলা ও রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সে এসব নীতিমালা অনুসরণ করে আসছেন। শুধু টেসলা বা স্পেসএক্স নয়, নিজের মালিকানাধীন অন্য কোম্পানিগুলোতেও তাঁকে বারবার এসব কৌশল খাটাতে দেখা গেছে।

অনেকের থেকে আলাদা ইলন মাস্ক

১৯৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে জন্মগ্রহণ করা ইলন মাস্ক এখন পর্যন্ত আটটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এগুলো হলো টেসলা, স্পেসএক্স, হাইপারলুপ, ওপেন এআই, নিউরালিংক, দ্য বোরিং কোম্পানি, জিপ টু, পেপাল। ছেলেবেলা থেকেই মাস্ক প্রযুক্তির পোকা। কম্পিউটার কোডিং তিনি নিজে নিজেই শিখেছেন। ১২ বছর বয়সে তিনি ‘ব্লাস্টার’ নামে একটি ভিডিও গেম বানিয়ে ফেলেছিলেন।

১৭ বছর বয়সে তিনি কানাডায় চলে যান। সেখানে অন্টারিওর কিংস্টনে কুইন’স ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। ব্রিটানিকার তথ্য অনুসারে, সেখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় চলে আসেন। এখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পদার্থবিদ্যা ও অর্থনীতি—দুই বিষয়ে তাঁর স্নাতক। এরপর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। কিন্তু দুদিন পরই তাঁর মনে হয়, পদার্থবিদ্যায় পড়ার চেয়ে ইন্টারনেট সম্পর্কে জানা বেশি জরুরি। সেখানে পড়া ছেড়ে দেন তিনি। এরপর জিপ টু নামের কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করেন ৩০ কোটির বেশি ডলারে। এরপর অনলাইনে লেনদেনের জন্য এক্স ডটকম নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যা পরবর্তী সময়ে পেপাল নামে পরিচিত হয়। ২০০২ সালে ১৫০ কোটি ডলারে সেই প্রতিষ্ঠান বিক্রি করেন দেন তিনি।

মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ ছিল ইলন মাস্কের। কিন্তু এই মহাকাশ গবেষণা বা স্যাটেলাইট পাঠাতে রকেট উৎক্ষেপণে যে পরিমাণ খরচ হতো, তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। এই খরচ কমাতেই ২০০২ সালেই স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। রকেট উৎক্ষেপণে এই প্রতিষ্ঠান যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। তাদের তৈরি রকেট এখন একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি একাধিক রকেটের ডিজাইনেও কাজ করেছেন তিনি।

গাড়ির জগতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন ইলন মাস্ক। আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান টেসলা। অন্য ইলেকট্রিক গাড়ির থেকে এর পার্থক্য হলো, এই কোম্পানির তৈরি গাড়ি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটারিতে চলে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সহজ। দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে দিয়েছে।

ইলন মাস্ক সিইও হিসেবে সফল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই মানুষের জীবনযাপনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এবার দেখার বিষয়, টুইটারে তিনি কী কী পরিবর্তন আনেন।