না ঘুমিয়ে কতক্ষণ থাকা সম্ভব?

১৯৬৩ সালে টানা ১১ দিন ২৫ মিনিট না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল র‍্যান্ডি গার্ডনার। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার হাইস্কুলের ছাত্র ছিল সে। নিজের বিজ্ঞান প্রজেক্ট তৈরির জন্য প্রায় ২৬৪ ঘণ্টা ঘুমায়নি ছেলেটি। তখন সবচেয়ে বেশি সময় না ঘুমিয়ে থাকার বিশ্ব রেকর্ড করেছিল র‍্যান্ডি। তার ঠিক ২৩ বছর পর গার্ডনারের রেকর্ডটি ভেঙে দেন রবার্ট ম্যাকডোনাল্ড নামের এক ব্যক্তি। ১৯৮৬ সালে তিনি টানা ১৮ দিন ২২ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন অনায়াস। তবে গার্ডনারের মতো কেউ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেননি ম্যাকডোনাল্ডকে। ফলে রেকর্ডের খাতায় গার্ডনারের নামই স্থায়ী হয়ে যায়।

১৯৭৭ সাল থেকে না ঘুমিয়ে থাকার রেকর্ড বাতিল করা হয়। কারণ, না ঘুমানো স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে বিপদ হতে পারে। কিন্তু কী ধরনের বিপদ হতে পারে? যারা টানা অনেক দিন না ঘুমিয়ে কাটান, তাঁদের সঙ্গে আসলে কী হয়?

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ বা শারীরিক ক্রিয়াকলাপ সঠিকভাবে চালু রাখার জন্য ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা ও হতাশা বাড়তে পারে। এমনকি স্বাস্থের অবনতি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একই ব্যবধানে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। তবে বিশেষ প্রয়োজনে দিন–রাত টানা ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে, শিক্ষার্থীদের জন্য। তবে এটা না করাই ভালো।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের স্লিপ মেডিসিন ফেলো ড. ওরেন কোহেন জানান, টানা ২৪ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে কাটানোর পর সেই ব্যক্তি জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে আছে, তা তার জন্য বোঝা কঠিন। এ অবস্থায় না ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির মস্তিষ্কে অনবরত ঘুমানোর জন্য সংকেত যেতে থাকে। এ সময় ঘুম ও জেগে থাকার মাঝামাঝি অবস্থায় থাকে সে। যদিও দেখলে মনে হবে, সে জেগে আছে।

এটাকে বলে স্লিপ ইনট্রাকশন বা মাইক্রোস্লিপ। যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা না ঘুমিয়ে কাটায়, তাদের মস্তিষ্ক অনিচ্ছাকৃতভাবে একধরনের ঘুমের মধ্যে চলে যায়। ফলে তার হ্যালুসিনেশন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লিপ ডিজঅর্ডার বা ঘুমের সমস্যা কেন্দ্রের চিকিৎসক অ্যালন আভিডান বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি আমাকে এসে বলে, “আমি কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘুমাইনি,” আমি তখন বলি, এটা প্রায় অসম্ভব।’

ওরেন কোহেন আরও বলেন, ‘মাইক্রোস্লিপ ছাড়া কেউ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় জেগে থাকতে পারে, এটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন।’

কিন্তু মানুষ না ঘুমিয়ে ঠিক কত সময় থাকতে পারে? না ঘুমানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই বা কী? এ ব্যাপারে অ্যালন আভিডান বলেন, মানুষের ঘুমের ব্যাপারটা নিয়ে পরীক্ষা করা অনৈতিক। পরীক্ষা করতে হলে কোনো ব্যক্তিকে টানা অনেক দিন না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। এটা তার জন্য একধরনের মানসিক নির্যাতন ছাড়া কিছুই নয়। কাউকে নিয়ে এ ধরনের গবেষণা না করাই ভালো।

অ্যালন আভিডান আরও বলেন, ‘যদিও ঘুমানোর ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা করা ঠিক নয়, কিন্তু আমাদের কাছে কিছু মানুষের তথ্য আছে। তারা জন্মগতভাবে একধরনের বিরল রোগে ভোগে। ফলে ঘুমাতে পারে না। এসব রোগীর মস্তিষ্কে একধরনের জেনেটিক মিউটেশন হয়। ফলে মস্তিষ্কে একধরনের অস্বাভাবিক প্রোটিন জমা হয়। ধীরে ধীরে তাদের ঘুমের অবনতি ঘটে। শরীর খারাপ হতে শুরু করে। মস্তিষ্কে জমা হওয়া অস্বাভাবিক প্রোটিন মস্তিষ্কের কোষগুলোর ক্ষতি করে। ফলে রোগটি হওয়ার ১৮ মাসের মধ্যেই বেশির ভাগ রোগী মারা যায়।’

২০১৯ সালে ঘুম নিয়ে মানুষের ওপর একটি গবেষণা চালানো হয়েছিল। নেচার অ্যান্ড সায়েন্স অব স্লিপ ম্যাগাজিনে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ১৬ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে, এরপর তাঁদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ধীরে ধীরে তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।

২০০০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, টানা ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকার ফলে হাত ও চোখের রক্তের অ্যালকোহলের পরিমাণ ০.০১ শতাংশ হ্রাস পায়। কোনো ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাতে অতিরিক্ত সময় লাগে। কথাবার্তা জড়িয়ে যায়, হ্রাস পায় মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি। তবে বিপত্তির শেষ নয় এখানেই। ২৪ ঘণ্টা না ঘুমানোর ফলে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিনের মতো স্ট্রেস হরমোন বৃদ্ধি পেতে পারে।

চলো, এবার জানা যাক, টানা ৩৬ ঘণ্টা না ঘুমালে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে? আগেই বলে রাখি, ৩৬ ঘণ্টা না ঘুমানো কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। স্বাস্থ্যের জন্য এটা অত্যন্ত ঝুঁকির কাজ। এ অবস্থায় শরীরের ওপর যথেষ্ট চাপের সৃষ্টি হবে। বারবার তুমি মেজাজ হারিয়ে ফেলবে। কোনো কিছুতে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না। শরীরের তাপমাত্রাও কমতে ও বাড়তে থাকবে। হঠাৎ করেই ক্ষুধা লাগতে পারে। আবার হুট করেই খাওয়ার ইচ্ছা থাকবে না।

এবার ৪৮ ঘণ্টার কথা চিন্তা করো। এ অবস্থায় তুমি মাঝেমধ্যেই হুট করে ৩০ সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে যেতে পারো। তুমি জানতেও পারবে না, কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলে। নিজেকে খুব দিশাহারা মনে হবে এবং এর আগে ২৪ ঘণ্টা ও ৩৬ ঘণ্টার জন্য যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলেছি, সেগুলো এ পর্যায়ে বাড়তে থাকবে।

টানা ৩ দিন বা ৭২ ঘণ্টা না ঘুমালে কী হবে, সে ব্যাপারে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। কারণ, মানুষকে এত সময় জাগিয়ে রেখে গবেষণা করা অনৈতিক। তা ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ তাদের নিজেদের ইচ্ছায় টানা তিন দিন জেগে থাকতে পারে না। তাই কাউকে নিয়ে এ ধরনের গবেষণা করাও অন্যায়। কিন্তু তিন দিন না ঘুমিয়ে কাটালে স্বাভাবিকভাবেই তোমার মেজাজ খিটখেটে হয়ে যাবে। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। চারপাশের পরিবেশও সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকবে না। এ অবস্থায় তোমার হ্যালুসিনেশন হবে।

যা হোক, আশা করি তোমরা সবাই সময়মতো ঘুমাবে। কারণ, টানা অনেক দিন অনিয়মিতভাবে ঘুমালে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। হতে পারে ডিমেনশিয়া। ডিমেনশিয়া রোগের ফলে মানুষ অনেক কিছুই মনে রাখতে পারে না। এর পাশাপাশি ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপও হতে পারে। এমনকি স্ট্রোকও হতে পারে ঘুমের অভাবে।

ওপরের এসব ঝামেলা থেকে বাঁচতে হলে নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো উচিত। প্রতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। এতে স্বাস্থ্য ও মন–মেজাজ ভালো থাকবে। আজ ঠিকমতো ঘুম হয়েছে তো?

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও ক্লাইভল্যান্ড ক্লিনিক