পৃথিবীর কোন দেশের মুদ্রার দাম সবচেয়ে বেশি
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা কোন দেশের? মানে কোন দেশের মুদ্রার দাম সবচেয়ে বেশি? এমন প্রশ্নে সাধারণত মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড কিংবা ইউরোর কথা মাথায় আসে। কিন্তু বাস্তবতা অন্য রকম। ডলার নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা, তবু মানের দিক থেকে সেরা নয়। কোনো মুদ্রার শক্তি বলতে বোঝায়, সেই দেশের টাকা দিয়ে অন্য দেশের মুদ্রা, জিনিসপত্র বা পরিষেবা কেনার ক্ষমতা কতটা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ১৮০টি মুদ্রার আইনি স্বীকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে এমন কিছু মুদ্রা আছে, যেগুলোর মানের কাছে পিছিয়ে পড়েছে ডলারও।
কোনো মুদ্রা কেন বেশি মূল্যবান হয়, তা বুঝতে হলে কয়েকটি বিষয় বিশ্লেষণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাহিদা ও জোগানের খেলা, মুদ্রাস্ফীতির হার, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা এবং দেশটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। এসব মিলিয়ে একটা দেশের মুদ্রার মান নির্ধারিত হয়। এখন চলো, ২০২৫ সালের শীর্ষ ১০টি দামি মুদ্রার কথা জেনে নিই।
১. কুয়েতি দিনার (KWD)
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা কুয়েতি দিনার। ১৯৬০ সালে যখন মুদ্রাটি চালু হয়, তখন এর মান ছিল এক ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিংয়ের সমান। বাংলাদেশিদের কাছে কুয়েতি দিনারের বিনিময় হার বেশ জনপ্রিয়। কারণ, কুয়েতে অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী বাস করেন। কুয়েতি দিনার দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে নিজের জায়গা ধরে রেখেছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কুয়েত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক দেশ। এই তেল দেশটির অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববাজারে এই মুদ্রার মান খুব বেশি ওঠানামা করে না। পাশাপাশি কুয়েতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগ করে বেশি। তা ছাড়া দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতির কারণে কুয়েতি দিনারের জোগান সীমিত থাকে। ফলে মুদ্রার মানও বাড়ে। বর্তমানে এক কুয়েতি দিনারের মূল্য প্রায় ৪০০ টাকা।
২. বাহরাইনি দিনার (BHD)
কুয়েতের ঠিক পরেই আছে বাহরাইনি দিনার। আরব উপসাগরের ছোট্ট এই উপসাগরীয় দেশেও তেলই মূল ভরসা। তবে শুধু তেল নয়, কম মুদ্রাস্ফীতি আর মার্কিন ডলারের সঙ্গে নির্দিষ্ট বিনিময় হার এই মুদ্রাকে করেছে শক্তিশালী। বর্তমানে এক বাহরাইনি দিনারের মূল্য প্রায় ৩২৪ টাকা।
৩. ওমানি রিয়াল (OMR)
ওমানের মুদ্রার নাম ওমানি রিয়াল। আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ওমানের অর্থনীতিও মূলত তেলের রিজার্ভের ওপর নির্ভরশীল। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৪০ সালের আগে ওমান ভারতীয় রুপিকেই তাদের সরকারি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করত। পরে নিজেদের রিয়াল চালু করে। তেল ও গ্যাস রপ্তানির পাশাপাশি ওমানের মুদ্রাস্ফীতির হারও তুলনামূলকভাবে কম। এটাই রিয়ালের মান ধরে রাখতে সাহায্য করে। বর্তমানে এক ওমানি রিয়ালের মূল্য প্রায় ৩১৬ টাকা।
৪. জর্ডানিয়ান দিনার (JOD)
চতুর্থ স্থানে আছে জর্ডানীয় দিনার। ১৯৫০ সালে এটি ফিলিস্তিনি পাউন্ডের পরিবর্তে জর্ডানের সরকারি মুদ্রা হিসেবে চালু হয়। জর্ডান তেলসমৃদ্ধ না হলেও দেশটির বৈচিত্র্যময় অর্থনীতি আর মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্থির বিনিময় হার এর শক্তির মূল কারণ। মধ্যপ্রাচ্যের অনিশ্চয়তার মাঝেও জর্ডানীয় দিনার রয়ে গেছে স্থিতিশীল। বর্তমানে এক জর্ডানিয়ান দিয়ানের মূল্য প্রায় ১৭২ টাকা।
৫. জিব্রাল্টার পাউন্ড (GIP)
এরপর রয়েছে জিব্রাল্টার পাউন্ড। ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিংয়ের ছায়াতেই জিব্রাল্টার পাউন্ড শক্তিশালী হয়েছে। এ দুটি মুদ্রার মানও প্রায় কাছাকাছি। এক জিব্রাল্টার পাউন্ডের মান এক ব্রিটিশ পাউন্ডের সমান। জিব্রাল্টারে উভয় মুদ্রাই চলে। মুদ্রাটি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী হওয়ার কারণ এটি সরাসরি ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির শক্তি একে সমর্থন জোগায়। এ ছাড়া জিব্রাল্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কেন্দ্র এবং জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হওয়ায় এর অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী ও স্থিতিশীল। বর্তমানে এক জিব্রাল্টার পাউন্ডের মূল্য প্রায় ১৬৫ টাকা।
৬. ব্রিটিশ পাউন্ড (GBP)
যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং বিশ্বের ষষ্ঠ শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, বরং জার্সি, গার্নসি, আইল অব ম্যানসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলের সরকারি মুদ্রা। আমেরিকান ডলার, ইউরো ও জাপানি ইয়েনের পর বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্টার্লিং চতুর্থ সর্বাধিক লেনদেন হওয়া মুদ্রা। ব্রিটিশ পাউন্ডের এই শক্তির পেছনে যুক্তরাজ্যের স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার একটি বড় কারণ। জিডিপির হিসাবে যুক্তরাজ্য বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দেশটির সেবা খাতও বেশ শক্তিশালী। এ ছাড়া ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সরকারের প্রভাবমুক্ত হওয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই সুদের হার এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতিমালা ঠিক করতে পারে। এসব মিলিয়ে পাউন্ডের মান বেশ স্থিতিশীল থাকে। বর্তমানে এক ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্য প্রায় ১৬৪ টাকা।
৭. কেম্যানিয়ান ডলার (KYD)
কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের মুদ্রা কেম্যানিয়ান ডলার। নামটি একটু অপরিচিত লাগতে পারে। এটি হলো ক্যারিবীয় সাগরের মধ্যে তিনটি দ্বীপের এক ছোট্ট দেশ। গ্র্যান্ড কেম্যান, কেম্যান ব্র্যাক আর লিটল কেম্যান নিয়ে কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ। ভৌগোলিকভাবে এটি জামাইকার উত্তরে আর কিউবার দক্ষিণে অবস্থিত। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এখানে জ্যামাইকান ডলার প্রচলিত ছিল। কিন্তু এরপর কেম্যানিয়ান ডলার সরকারি মুদ্রা হিসেবে চালু হয়। বর্তমানে এর এটি বিশ্বের সপ্তম শক্তিশালী মুদ্রা। এর শক্তির পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। দেশটির জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ অনেক কম। অর্থাৎ দেশটির সরকারের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের অর্থনীতিও বেশ শক্তিশালী। বর্তমানে এক কেম্যানিয়ান ডলারের মূল্য প্রায় ১৪৬ টাকা।
৮. সুইস ফ্রাঙ্ক (CHF)
সুইজারল্যান্ড ও লিচেনস্টাইনের মুদ্রা হলো সুইস ফ্রাঙ্ক। সুইজারল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল এবং ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত। সুইস ফ্রাঙ্ক বিশ্বের অষ্টম সর্বাধিক লেনদেন হওয়া মুদ্রা। অনেকে এই মুদ্রাকে নিরাপত্তার প্রতীক মনে করেন। এর শক্তির কারণ হলো সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী মুদ্রানীতি। দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী। সুইজারল্যান্ডে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির হার খুবই কম। রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হওয়ায় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে বিনিয়োগকারীরা সুইস ফ্রাঙ্ককে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচনা করে। বর্তমানে এক সুইস ফ্রাঙ্কের মূল্য প্রায় ১৫২ টাকা। বাংলাদেশি টাকার হিসাবে সুইস ফ্রাঙ্ক অবশ্য কেম্যানিয়ান ডলারের চেয়ে ওপরে।
৯. ইউরো (EUR)
ইউরো নিশ্চয়ই তোমাদের পরিচিত শব্দ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১৯টির মুদ্রা এটি। যুক্তরাষ্ট্রের পরে ইউরোপের এ দেশগুলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক লেনদেন হওয়া মুদ্রাও। তবে বিশ্বের শক্তিশালী মুদ্রার তালিকায় এর অবস্থান নবম। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর ঋণের চাপ মাঝেমধ্যে ইউরোর মান কমিয়ে দেয়। বর্তমানে এক ইউরোর মূল্য প্রায় ১৪২ টাকা।
১০. আমেরিকান ডলার (USD)
সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় মুদ্রা মার্কিন ডলার। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক এটিকে প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ধরে রাখে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় এই মুদ্রায়। কিন্তু ভাবতে পারো, ডলার কেন তালিকার সবার ওপরে না থেকে শেষে? কারণ, আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতির হার অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। ফলে ডলারের ক্রয়ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। দেশটির বাণিজ্যঘাটতি, অর্থাৎ আমদানির পরিমাণ রপ্তানির চেয়ে বেশি হওয়াও ডলারের মানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অবশ্য এসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে এক মার্কিন ডলারের মূল্য প্রায় ১২২ টাকা।
সূত্র: বুক মাই ফরেক্স ডট কম