দুই চাকায় আমেরিকা

আমেরিকা দেখার ইচ্ছা কার না থাকে! সবার মতো আমারও সেই ইচ্ছা ছিল। তবে ইচ্ছা থাকলেই যে সব কাজ তখনই হয়ে যাবে, সেটাও ঠিক নয়। তাই অভিযান পরিকল্পনার প্রায় চার বছর পর বাস্তবায়িত হলো আমার এই দুই চাকায় মানে সাইকেলে করে আমেরিকা দেখার পর্ব।

আমেরিকার ভিসার জন্য আর সবার মতো আমাকেও ধৈর্যের এক অসীম পরীক্ষা দিতে হলো। প্রতিবছর যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে ভিসার আবেদন করতাম, আর যথারীতি না-সূচক উত্তর নিয়ে ফিরে আসতাম এম্বাসি থেকে। কিন্তু পরিকল্পনা থেকে বের হয়ে আসতে পারলাম না। শেষমেশ ২০১১ সালে এসে আন্তর্জাতিক একটা সম্মেলনের আমন্ত্রণ এল আমেরিকা থেকে এবং তারাই সবকিছুর ব্যবস্থা করে নিয়ে গেল আমাকে। মজার বিষয় হলো, সপ্তাহ খানেকের জন্য যাওয়ার দাওয়াত পেলেও ভিসা পেলাম পাঁচ বছরের জন্য।

২০১২ সালে, প্রায় আট মাসের টানা জোগাড়যন্ত্র করে মে মাসে রওনা হলাম আমেরিকার নিউইয়র্কের উদ্দেশে। সঙ্গে নিলাম আমার প্রিয় সাইকেল। এর বিশেষত্ব হলো, একটা সাইকেলই দুজন একসঙ্গে চালানো যায়। একে বলে ট্যানডেম। আমার সাইকেলে আরও একটা মজার বিষয় ছিল, এর চাকাগুলো ছিল ২০ ইঞ্চি। তাই আকারেও অন্যান্য সাইকেলের চেয়ে বেশ খানিকটা ছোট। এতে সুবিধা  হলো, এটা বহন করতে বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না।

যেহেতু দুজন মিলে চালাতে হয় সাইকেলটা, তাই আমার সঙ্গী হিসেবে যুক্ত হলেন আরেক রোমাঞ্চপ্রিয় লোক উজ্জ্বল ভাই। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ফ্লোরিডা থেকে চলে এলেন নিউইয়র্কে। যেহেতু আমরা শুরু করব আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে আর শেষ হবে পূর্ব উপকূলে; তাই শুরুর জন্য আমাদের যেতে হবে সিয়াটল শহরে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করে দুজন ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল শহরে পৌঁছালাম। এই শহর খুবই বিখ্যাত। এখানে আছে বিমান কারখানা আর মাইক্রোসফট ও অ্যামাজনসহ বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর। এটাই পশ্চিম উপকূলের সবচেয়ে বড় শহর। বন্ধুর বাসায় এক রাত থেকে পরদিন আমরা দুজনে বের হলাম আমাদের সাইকেল অ্যাডভেঞ্চারে। সাইকেলের চাকা ঘুরতে লাগল পূর্ব উপকূলের দিকে। কত দিন লাগবে তখনো জানি না। শুধু জানি, মাঝখানে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের একটা লম্বা পথ।

পথিমধ্যে একটু জিরিয়ে নিয়ে চলছে খাবারের ব্যবস্থা

পারব কি পারব না, শরীর কুলাবে তো, রাস্তা চিনব তো—এসব চিন্তা করতে করতেই প্রথম দিনের ক্যাম্প করার জন্য একটা ক্যাম্প গ্রাউন্ডে থামলাম। প্রথম দিন হিসেবে বেশ হলো। আর তখনই মনে হলো, না, পারা যাবে। কষ্ট আছে, তবে অসম্ভব নয়।

নিছক সাইকেল চালানো ছাড়াও আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারের আরেকটা বড় উদ্দেশ্য ছিল। আমেরিকাসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে না। এ কারণে আমাদের মতো দেশগুলো যারা সমুদ্র সমতলের খুব কাছে, তাদের জন্য বিষয়টা হুমকিস্বরূপ। কেননা, প্লাস্টিকের উৎপাদনে যে পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন হয় আর তা থেকে যত কার্বন তৈরি হয়, তা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিকেই আমরা বলছি ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ুর পরিবর্তন। এ কারণে হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা। এ সমস্যায় যে দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে, তার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ অন্যতম।

তাই আমরা প্রচারাভিযানের পরিকল্পনার সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক একটা গবেষণার কাজও করেছিলাম। আমেরিকার বোস্টন শহরের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) বন্ধুরা একটা বিশেষ স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের। এর মাধ্যমে আমরা যখন সাইকেল চালিয়েছিলাম, তখন প্লাস্টিকের তৈরি দ্রব্য, যেমন পানির বোতল, খাবারের মোড়ক, কাচের বোতল অথবা এমন কিছু, যা মাটিতে মিশতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়, তেমন কিছু পাওয়া যায়, তা গণনা করতে পারছিলাম সহজেই। আর পুরো জিনিসটাই সঙ্গে সঙ্গে গুগল ম্যাপের মাধ্যমে ওয়েবসাইটে চলে আসত। তাই প্রতিদিনের সাইকেল চালনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যতটা পেরেছি, এমন করে প্লাস্টিকের দ্রব্যগুলোর একটা সংখ্যা বের করার চেষ্টা করতাম।

পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা আমেরিকার চারজন প্রেসিডেন্টের প্রতিকৃতি রাসমোরের সামনে আমরা

ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের পর আসে আইডাহো। দুটো প্রদেশই যথেষ্ট পাহাড়ি। উঁচু-নিচুতে সাইকেল চালাতে তাই কষ্টও হলো বেশ। তবে আইডাহোর যাত্রাপথ ছোট। পরের স্টেট মনটানা। মনটানাকে বলা হয় বড় আকাশের দেশ। কেন? যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম। এত বড় আকাশ আসলে সচরাচর দেখা যায় না। মনটানাতে আমরা মসুলা বলে একটা শহরে থেমে ছিলাম এক দিনের জন্য। এখানেই আছে বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চার সাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা (এসিএ)। আমরা যে পথে আমেরিকা অতিক্রম করব, তার নাম ট্রান্স-আমেরিকান ট্রেইল আর এসিএর ম্যাপগুলো হলো খুব জনপ্রিয়। যেহেতু আমরা বাংলাদেশি, তাই তাদের আগ্রহেরও কমতি ছিল না আমাদের দেখার। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই জানতে পারলাম, আমাদের আগে কেউ আসেনি আমাদের ওদিক থেকে। আর মুসলিম? তা-ও তাদের মধ্যে খটকা লাগল, আমাদের আগে কোনো মুসলমান রাইডারকে তারা ট্যানডেমে দেখেছিল কি না।

মসুলা থেকে আমাদের পরের স্টেট হলো ওয়াওমিং। এই জায়গা খুব বিখ্যাত ইয়োলো স্টোন ন্যাশনাল পার্কের জন্য। আমাদের পথও ছিল এই পার্কের মধ্য দিয়েই। এখানে বলে রাখতে হয়, আমাদের পার্কগুলো যেমন অনেক ছোট, এখানকার ন্যাশনাল পার্ক মানে হলো বিশাল অবস্থা। এমনকি আমরা রাতে ক্যাম্পিংয়ের সময় খাবারগুলো ভালুক যাতে না খেতে পারে, তাই বাক্সের মধ্যে রাখা হতো।

সাউথ ডাকোটার বিখ্যাত মাউন্ট ক্রেজি হর্স আর রাসমোর দেখতে গেলাম সাইকেলে চেপেই। ক্রেজি হর্স হলো আদি আমেরিকানদের জন্য তৈরি করা একটা বড় ভাস্কর্য আর রাসমোর হলো চারজন প্রেসিডেন্টের আত্মপ্রকৃতি, যা একটা বিশাল পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা আছে।

অভিযান শুরুর পাঁচ সপ্তাহ পর নেব্রাস্কা স্টেটে পেলাম এক বাংলাদেশি পরিবারের দেখা

আমরা যখন নেব্রাস্কা স্টেটে ঢুকলাম, তখন সম্ভবত আমেরিকার শত বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিনতম গরম আবহাওয়া ছিল। এটাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় হিট ওয়েভ। প্রায় দুই সপ্তাহের মতো গড়পড়তা ৩৮-৪৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে সাইকেল চালাতে হয়েছিল আমাদের। এর চেয়ে কষ্টকর আর কিছু হতে পারে বলে আমাদের মনে হয় না। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর এই রাজ্যেই প্রথম বাংলাদেশির দেখা পেলাম আমরা। কী যে ভালো লাগল! আমাদের দেখে তাঁদের বেশ আনন্দ হলো। কারণ, আশপাশে কোনো বাংলাদেশি বা বাংলাভাষী বাস করেন না।

নেব্রাস্কার পর আইওয়া, ইলিনয় আর ইন্ডিয়ানা হয়ে আমরা পশ্চিম ভার্জিনিয়া হয়ে ভার্জিনিয়ায় প্রবেশ করেছিলাম প্রায় ৬৫তম দিনে। যাত্রা শুরু হয়েছিল সিয়াটলে আরও দুই মাস আগে। সেটা প্রায় পাঁচ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে। আর আজ আমরা একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। আগামীকাল ম্যারিল্যান্ডে গেলেই  শেষ হবে প্রায় চার বছরের পরিকল্পনা আর অমানুষিক পরিশ্রমের এই যাত্রা। ৬৬তম দিনে, পাঁচ হাজার ৫৩৪ কিলোমিটারের ১২টি রাজ্য অতিক্রম করে আমার ওয়াশিংটন ডিসিতে যাত্রা শেষ করলাম। এ অভিজ্ঞতা আমাদের দুজনের জীবনেরই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

(কিশোর নববর্ষ ১৪২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)