ভয়ের পেছনের কথা

অজানাকে মানুষের বড় ভয়। এই ভয়ের পেছনে আছে অনিশ্চয়তা। সে জন্যই অন্ধকারকে মানুষ যুগ যুগ ধরে ভয় পেয়ে আসছে। কবরস্থান বা শ্মশানের পাশ দিয়ে দিনের বেলায় হাঁটতে কিন্তু অত ভয় করে না কারও। রাতদুপুরে আবার অতি সাহসীরও হাঁটু কেঁপে যায় ওই রকম জায়গা দিয়ে হেঁটে যেতে।

অজানা ও অনিশ্চয়তাকে ভয় পাওয়ার এ রহস্যের বীজ আছে মানুষের জিনে। জিন মানে জেনেটিক কোড। ডিএনএতে লেখা যে জৈব কোড কাজ করে জীবনের নীলনকশা হিসেবে। সেই জিনে লেখা আছে, অজানাকে ভয় পাওয়ার কথা। অনিশ্চয়তা ও অন্ধকারকে ভয় পাওয়ার কথা। কারণ, সতর্ক করে তোলা। প্রাচীনকালে গুহাবাসী মানুষের অন্ধকারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল। বিপদ ওত পেতে থাকতে পারে যেকোনোখানে। অজানা পরিবেশে, অজানা যেকোনো কিছুর ব্যাপারে বা অন্ধকারে অনিশ্চয়তার মধ্যে তাই সতর্ক থাকা দরকার, যাতে প্রস্তুত থাকা যায়। হুট করে কোনো বিপদে পড়তে না হয়। এই ভয় আমাদের ডিএনএতে রয়ে গেছে আজও। আমরা তাই ভয় পাই, ভয় পেতে চাই। ভয় পাওয়াটা সত্যি না হলে উপভোগও করি। সে জন্যই মানুষ ভূতের গল্প পড়ে, মুভি দেখে।

প্রশ্ন হলো, আসলেই কি ভূত আছে? হাজার বছরের পুরোনো এ প্রশ্ন। বিজ্ঞানের চোখে ভূতের অস্তিত্ব নেই। কারণ, এ রকম কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ভূত যদি না থাকে, ভূতে ধরার এত অভিজ্ঞতার গল্প আসে কোত্থেকে? এ রকম কিছু অভিজ্ঞতা বা ঘটনার দিকে তাকানো যাক।

যেমন বোবায় ধরা। মানে, ঘুমের ভেতর কেউ চেপে ধরে আছে মনে হওয়া। নড়াচড়া করতে না পারা। এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক নাম ‘স্লিপ প্যারালাইসিস’। ঘুমের পাঁচটি পর্যায় আছে। প্রথম দিকে মানুষের ঘুম হালকা থাকে, ধীরে ধীরে গাঢ় হয়। সবচেয়ে গভীর ঘুমের পর্যায়টির নাম ‘রেম স্লিপ’। এ সময় মানুষের চোখের পাতা কাঁপে, মানুষ স্বপ্ন দেখে। শরীর গভীর ঘুমের এ রকম একটি পর্যায় থেকে আরেকটি পর্যায়ে যাওয়ার সময় স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে।

আরও কিছু সাধারণ অভিজ্ঞতা আছে। গলার স্বর শোনা বা চোখের কোনা দিয়ে নড়াচড়া দেখতে পাওয়া। এর নাম অডিটরি হ্যালুসিনেশন। কেউ কেউ আবার বিচিত্র গন্ধও পান। হুমায়ূন আহমেদের দেবী বইটা কি পড়েছ তোমরা? সে বইয়ে রাণু চরিত্রটি বেলি ফুলের গন্ধ পায়। এর নাম অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন। রাণুর অবশ্য অডিটরি হ্যালুসিনেশনও হয়। সে কারও হাঁটার শব্দ পায়। দেখতে পায় এমন কাউকে, যে সেখানে নেই।

হ্যালুসিনেশন মানে, যা আসলে নেই, তা আছে বলে মনে হওয়া। এ ধরনের হ্যালুসিনেশন দুই কারণে হতে পারে। এক. মনের ভুল। আর দুই. মানসিক রোগ। বিচিত্র গন্ধ পাওয়ার রোগকে বলা হয় ফ্যান্টোসমিয়া। আবার স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর অডিটরি হ্যালুসিনেশন হতে পারে। তাই বলে তোমাদের যদি কখনো এ রকম অদ্ভুত কিছু দেখা, শোনা বা ঘ্রাণ পাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তাহলে নিজেকে এখনই মানসিকভাবে অসুস্থ বলে ঘোষণা করে দিয়ো না। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটা হয় মনের ভুলের কারণে।

মানুষের কল্পনাশক্তি বেশ প্রখর। আর আমাদের মস্তিষ্ক যেকোনো কিছুতে প্যাটার্ন খুঁজে পেতে চায়। তোমরা কি জানো, এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার কেন দেওয়া হয়েছে? জটিল ও এলোমেলো বিভিন্ন পদার্থ এবং ঘটনার ভেতরের সুপ্ত প্যাটার্ন আবিষ্কারের জন্য। পৃথিবীর জলবায়ু কী জটিল একটা ঘটনা! এলোমেলোভাবে মেঘের বিচরণ, বাতাস, বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন পদার্থ, গ্রিনহাউস গ্যাস, নাইট্রোজেন চক্র, অক্সিজেন চক্র—এ রকম নানা জিনিস। এত সব জিনিসের প্রতিটির আচরণের ভেতরে প্যাটার্ন খুঁজে বের করেছেন এবারের নোবেলজয়ী দুজন বিজ্ঞানী, স্যুকুরো মানাবে আর ক্লাউস হেসেলম্যান। আর জর্জিও পারিসি জটিল পদার্থের গঠনের ভেতরে সুপ্ত প্যাটার্ন খুঁজে বের করেছেন। এমনকি পাখির ঝাঁকের প্যাটার্নও তাঁর গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করা যায়।

এত সব বলার অর্থ, আমাদের মস্তিষ্ক প্যাটার্নের খোঁজে হন্যে হয়ে থাকে। কোনো প্যাটার্ন নেই, এমন কিছু তার পছন্দ নয়। সে জন্যই আমরা মেঘের ভেতর হাতি-ঘোড়া দেখতে পাই। মশারির কোরা কুঁচকে থাকলে মনে হয়, ওখানে কেউ আছে। এটা আর কিছুই নয়, মস্তিষ্কের প্যাটার্ন খোঁজার প্রবণতা। এর নাম পেরিওডোলিয়া। এর সঙ্গে যখন অন্ধকার ও অজানার ভয় যোগ হয়, তখন মনে হয়, ওই যে অন্ধকারে কেউ আছে। এদিকেই তাকিয়ে আছে। কিছু হয়তো করবে সে আমাকে।

অজানাকে ভয় পাওয়ার কারণ কী, আগেই বলেছি, অনিশ্চয়তা। তার মানে, ভূতকে আসলে মানুষ ভয় পায় না। ভয় পায়, সে কে, কী করতে পারে, এসব ভেবে।

একটা সহজ জিনিস ভাবো তো। তোমার রুমে বাতি জ্বলছে। ভরদুপুর। এই ঘরে যদি কোনো ভূত লুকিয়ে থাকেও, সে কথা ভেবে তুমি কি ভয় পাবে? উঁহু, পাবে না। কারণ, আলো আছে। হুট করে কেউ পেছন থেকে এসে তোমাকে ছুঁয়ে দেবে না বা ঘাড়ে টোকা দেবে না। এবার বাতিটা নিভিয়ে দাও। একটু আগে যেমন তুমি ভয় পাওনি, এখনো আসলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

কথায় আছে, বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। তুমি যদি মনের বাঘকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো, তাহলে তোমার ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই!

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য মৃত্যু। জন্মের পর থেকে একজীবনে কত মানুষের মৃত্যুর খবর নিয়মিত শুনি বা পড়ি আমরা, তার হিসাব নেই। তবে কি একজন মানুষের মৃত্যু দুঃখের বিষয়, কিন্তু অনেক মানুষের মৃত্যু পরিসংখ্যান। সে জন্যই আপনজন মারা গেলে আমরা প্রচণ্ড কষ্ট পাই। কিন্তু মাইকে যখন কারও মৃত্যুর সংবাদ শুনি বা পত্রিকার পাতায় পড়ি, তখন আমরা সে পরিমাণ কষ্ট পাই না। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে কথা, মৃত্যুর কথা শুনে আমরা ভয় পাই না। তুমি যদি সৎ মানুষ হও, কারও ক্ষতি না করো, তোমার মা–বাবা ও প্রিয়জনদের ভালোবাসো, তাহলে মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর মৃত্যুকে যদি ভয় না পাও, তাহলে ভূত আছে ভেবে ভয় পাওয়ার কোনো মানে হয়, বলো?

এখন আবার বিজ্ঞানের চোখে একটা বিষয় তলিয়ে দেখা যাক। এত যে ভৌতিক অভিজ্ঞতা মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়, এর সবই কি তাহলে মিথ্যা? আসলে ভয় পাওয়াটা মিথ্যা নয়। পৃথিবীতে ভূত নেই, কিন্তু ভূতের ভয় আছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ভূত সমগ্র বইয়ে এ নিয়ে লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে ভূত নেই, কিন্তু ভূতের গল্প আছে।’ কারণ, মানুষ ভয় পায়। দুর্বল মানসিক অবস্থায় ভয় পেলে মানুষের যে অভিজ্ঞতা হয়, তা অমানবিক। কারণ, ভূত না থাকলেও ভয়টা সত্যি।

আসলে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত ভূত বা এ ধরনের অতিলৌকিক কোনো ঘটনার শক্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুস্থ মস্তিষ্কের একাধিক মানুষের এ ধরনের অভিজ্ঞতা একই সঙ্গে হতে দেখা যায় না। এ ধরনের অভিজ্ঞতার গল্প সাধারণত আসে ‘অমুক বলেছেন বা তমুকের কাছ থেকে শোনা’ হিসেবে। যাঁরা দেখার কথা বলেন, তাঁরা অন্ধকারে বা একা, এমন মানসিকভাবে বিপন্ন অবস্থায় থাকেন যে হ্যালুসিনেশন হওয়া স্বাভাবিক। দিনদুপুরে কয়েকজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ একসঙ্গে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, এমনটা সাধারণত হয় না। তবে অনেক সময় দেখা যায়, একজন মানুষ কিছু দেখতে পেয়েছে বললে বাকিরাও দেখে, গন্ধ পেয়েছে বললে বাকিরাও পায়। এর নাম ম্যাস হ্যালুসিনেশন। বিভিন্ন ধরনের সাজেশন (কেউ কিছু দেখেছে বা শুনেছে বললে) এবং পেরিওডোলিয়া মিলে এমনটা হয়। এটাকে বলে ‘ইনডিউসড হ্যালুসিনেশন’ হওয়া। মানে, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানসিক দুর্বলতার কারণে কেউ যখন ভৌতিক কিছু দেখা বা শোনার কথা বলে, বাকিরাও তখন সেটা অনুভব করে। তবে দিনদুপুরে সাধারণত এ রকম হয় না। কারণ, পরিবেশে অনিশ্চয়তার বিষয়টা থাকে না। সাধারণত দু-তিনজনের দল রাতদুপুরে নির্জন কোথাও এ রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারে।

একটা মজার বিষয় হলো, যাঁরা আগে থেকেই ভূতে ভয় পান (গল্প বা ভৌতিক অভিজ্ঞতা শুনে শুনে), তাঁরাই সাধারণত ভৌতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। যাঁরা এমনিতে ভয় পান না, তাঁদের সাধারণত এমন অভিজ্ঞতা হয়ও না। এর কারণ, ভয় পাওয়ার (পড়ো, হ্যালুসিনেশন হওয়ার) জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক দুর্বলতা তাঁদের মধ্যে থাকে না। ভূতের ভয়ই না শুধু, যেকোনো কারণে মন দুর্বল থাকলে এমনটা হতে পারে। এ কারণেই মাদকদ্রব্য নিলে মানুষের হ্যালুসিনেশন হয়। (মাদকদ্রব্য নেওয়া কখনোই উচিত নয়। মিথ্যা আর মাদক—দুটিকে না বলা আবশ্যক।)

আজ পর্যন্ত যত ধরনের ভৌতিক অভিজ্ঞতার খোঁজ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন, প্রতিটিই হয় মনের ভুলে বা কোনো রোগের কারণে হওয়া হ্যালুসিনেশন, কিংবা কেউ জেনেবুঝে এমন করেছে মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য। সত্যি সত্যি ভৌতিক অভিজ্ঞতার প্রমাণ পাওয়া গেলে বিজ্ঞান হয়তো এসব নিয়ে নতুন করে ভাববে।

ভূত নেই বলে যে ভূতের ভয় নেই, তা কিন্তু নয়। কেউ যদি অনেক ভয় পায়, তার উচিত ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। কারণ, ভয়টা সত্যি। এই ভয় একজন মানুষকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে ফেলতে পারে। তোমাদের কারও যদি অনেক ভয় লাগে, অবশ্যই মা–বাবাকে জানাবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবে।

তবে ভূতে ভয় না পেলে বা ভয় পাওয়ার পুরো বিষয়টি যে অর্থহীন, এটা বুঝলে ইচ্ছেমতো ভূতের গল্প পড়তে পারো বা মুভি দেখতে পারো। ভূত না থাকলে কী হবে, ভৌতিক মুভি বা গল্পের মতো উপভোগ্য জিনিস কিন্তু পৃথিবীতে খুব বেশি নেই!