সাইকেলে ৩২০০০ কিলোমিটার

৫২৭ দিন পর আর্জেন্টিনায় পৌঁছে লিয়াম

উত্তর আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য আলাস্কা। ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ তৎকালীন প্রায় ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে রাজ্যটি কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আলাস্কা থেকে প্রায় ৩২ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার। বিমানে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে লেগে যায় প্রায় ছয় ঘণ্টা।

তবে বিমানে নয়, লিয়াম গার্নার নামে মাত্র ১৭ বছর বয়সী এক আমেরিকান কিশোর বিশাল এই দূরত্ব পাড়ি দিয়েছে বাইসাইকেলে!

লিয়াম খুবই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। বড় কোনো অ্যাডভেঞ্চার করার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই। উৎসাহ দেখে এক বন্ধু অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে লেখা একটা বইয়ের খোঁজ দেয়। বইটি পড়ে উত্তেজনায় লিয়ামের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়! বাইসাইকেলে এক পর্যটক যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন থেকে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার পাতাগোনিয়াতে। সেই ভ্রমণের বর্ণনা ছিল বইটিতে। ব্যস, লিয়ামকে আর থামায় কে! মাথায় ঝোঁক চেপে বসল তার, বাইসাইকেলে তাকেও যেতে হবে আর্জেন্টিনা।

অনেকে ভাবতে পারো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর্জেন্টিনা সরাসরি আদৌ যাওয়া সম্ভব কি না। তোমাদের জানিয়ে রাখি, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাকে যুক্ত করেছে প্যান আমেরিকান হাইওয়ে। অনেক বছরের চেষ্টার পর ১৯৬৩ সালে চালু করা হয় এ রাস্তাটি। মোট ১৪টি দেশকে সংযুক্ত করা প্যান আমেরিকান হাইওয়ের এক প্রান্তে আছে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা, আরেক প্রান্তে আছে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস।

এই পথে আর্জেন্টিনা যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর লিয়াম তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়ে এক সকালে। ছোট একটি ব্যাগ আর ক্যাম্পিং করার সরঞ্জাম নিয়ে আলাস্কার প্রুডো বে থেকে শুরু করে যাত্রা।

প্রতিদিনই বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে যত বেশি সম্ভব দূরত্ব অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে লিয়াম। যত দিন সে উত্তর আমেরিকার মধ্যে ছিল, সুবিধাজনক কোনো জায়গায় তাঁবু গেড়েই কাটিয়ে দিত রাত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা থেকে বের হওয়ার পর সস্তা কোনো হোটেল বা অপরিচিত মানুষদের বাসায় উঠত সে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি সত্যি এমনটাই করত লিয়াম। আর বেশির ভাগ মানুষই খুশি খুশি মনেই তাকে জায়গা করে দিত নিজেদের বাসায়। সাইকেলে কেউ উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা যাচ্ছে—এমন ঘটনা তো আর রোজ রোজ দেখা যায় না!

যাত্রাপথে অনেক চড়াই–উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে লিয়ামকে। হঠাৎ একদিন রাস্তার এক কুকুর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তার তাঁবু। পথে দুবার ছিনতাইয়ের শিকারও হতে হয় তাকে। হারিয়ে যায় পাসপোর্টসহ আরও প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র। তবে লিয়ামকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় শারীরিক যন্ত্রণায়। প্রতিদিন সাইকেল চালানোর ফলে এমনিতেই শরীরে ব্যথা হয়ে যেত। পাশাপাশি অন্য সমস্যাও জেঁকে বসে শরীরে। একবার দুই কানে দেখা দেয় ইনফেকশন। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটে কলম্বিয়াতে। সাইকেল চালানোর সময়ই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গিয়ে সরাসরি আঘাত পায় মাথায়। প্রায় চল্লিশটি সেলাই পড়ে তার শরীরে। কান ছিড়ে যাওয়ায় করতে হয় প্লাস্টিক সার্জারিও। সে যাত্রায় প্রায় এক মাস হাসপাতালে থাকতে হয় লিয়ামকে।

তারপরও দমে যায়নি লিয়াম, বরং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে নতুন উদ্যমে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। অবশেষে ৫২৭ দিন পর, ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি লিয়াম পৌঁছে যায় প্যান আমেরিকান হাইওয়ের শেষ প্রান্ত আর্জেন্টিনায়। বর্তমানে বাইসাইকেলে প্যান আমেরিকান হাইওয়ে পাড়ি দেওয়া সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্রের লিয়াম গার্নার।

আলাস্কা থেকে রওনা দেওয়ার পরপর নিজের টিকটক আইডিতে নিয়মিত যাত্রা সম্পর্কে আপডেট দিত লিয়াম। কিছুদিন পরই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে যায় সে। তার আইডিতে এখন ফলোয়াড়সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশি।

এখানেই থেমে যাচ্ছে না লিয়াম। নির্ধারণ করেছে নতুন লক্ষ্য। আগামী পাঁচ মাসে আর্জেন্টিনা থেকে প্যান আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছাতে চায় সে। লিয়াম গার্নারের এই যাত্রাও সফল হবে, এমনটাই আশা এখন সবার।