থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে

‘থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে’ পঙ্‌ক্তির মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর আদুরে অনুভুতি আছে, হৃদয়কে একেবারে শান্ত করে দেওয়ার মতো। আমার জীবনে থোকায় থোকায় জোনাক দেখার এই অনুভুতি বহুবার এসেছে। জলার ধারে, জানলার ওপাশে কিংবা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে যাদের জোনাকি দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তারা আদতে অভাগা!

জীবনে প্রথমবার জোনাকির হাট দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল একেবারে ছোটবেলায়। সেই মায়াবী সন্ধ্যাটা আমার স্মৃতিপটে তির তির করে স্পষ্ট কাঁপন তোলে এখনো। আমাদের বাড়ির পেছনে একচিলতে ফাঁকা জায়গা, সেটার ওপর পানি টলমলে পুকুর, পুকুরের ওপারের পাড়াটার নাম খালপাড়া।

জানালায় বসে খালপাড়ার পুকুরপাড় স্পষ্ট দেখা যেত। ভাঁটফুল আর আকন্দের সঙ্গে আরও কী কী সব ঝোপে ছেয়ে থাকত পুকুরপাড়, সেসব ঝোপঝাড়ের ওপর তেলাকুচা আর স্বর্ণলতা দিব্যি নিজেদের ছড়িয়ে দিত স্বাধীনতার আনন্দে। পুকুরপাড়ের ঢোলকলমির ঝোপ ডিঙিয়ে জগডুমুরের ফল টুপুস করে পড়ত পুকুরের পানিতে।

ঝোপের ভেতরের গর্ত থেকে মাঝেমধ্যে বেজি বেরিয়ে কী সব খুঁজত ইতিউতি, কখনো বাদামি মেঠো খরগোশ তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে চলে যেত পুকুরপাড়ের সরু রাস্তা ধরে। শেয়ালের আনাগোনা তো ছিল নিত্য। জানলায় বসে আমি কত কত দিন যে সাদাকালো রঙের পাকড়া মাছরাঙাকে চিড়িক চিড়িক ডাক পেড়ে পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি, তার হিসাব নেই।

এই জানালাটা আমার খুবই প্রিয় ছিল। ছোটবেলায় ওখানে বসেই কেটে যেত দিনের অনেকটা সময়।

তখনো স্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি আমার। এক সন্ধ্যায় জানালা দিয়ে পুকুরের ওপারে তাকাতেই আমার চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেলো। দেখলাম, খালপাড়ার ওপাশের ঝোপে আগুন লেগে সারা!

সঙ্গে সঙ্গেই আমি হই হই করে উঠলাম, ‘আগুন লেগেছে, আগুন!’

ঘরে আমার সঙ্গে ছিল দূরসম্পর্কের এক খালু। উনি আঁতকে উঠে বললেন, ‘কই আগুন?’

আমি আঙুল উঁচিয়ে পুকুরের ওপারটা দেখিয়ে দিলাম।

উনি সেদিকে দেখেই একগাল হেসে উঠলেন, ‘আরে পাগল! ওটা আগুন না, ওগুলা তো জোনাক পোকা!’

জোনাক পোকা!

জোনাক পোকা যে এমন আগুন কাণ্ড ঘটাতে পারে, সেটা আমার ধারণাতে ছিল না, আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওদিকে। পুকুরের ওপারের ঝোপে রীতিমতো আগুন লেগেছে যেন। হাজারো জোনাকি একসঙ্গে টিপ টিপ করে এমনভাবে জ্বলছে যে আমার মতো ছোট্ট একটা ছেলের চোখে সেটাকে আগুনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলাটা দোষের কিছু হয়নি।

ঝোপের ওপর ইতিউতি হাজারো জোনাকি বান ডেকেছে যেন, হাজারো নক্ষত্র যেন একসঙ্গে ভেঙে পড়েছে পুকুরপাড়ে। একই ছন্দে জ্বলছে, নিভছে তারা, দেখতে কী যে মায়াবী লাগছে। একটা দুটো জোনাকি ঝোপ ছেড়ে সাই করে এমনভাবে পুকুরের পানি ছুঁয়ে ছুটে আসছে, ঠিক যেন আগুনের ফুলকি!

দুনিয়ার সব মুগ্ধতা এক করে আমি জোনাকির হাট দেখেছিলাম সে সন্ধ্যাজুড়ে, অনুভব করেছিলাম প্রকৃতির এক আদুরে বিস্ময়!

একটু একটু করে বড় হতে হতে জোনাকি সান্নিধ্য আর আপন হয়ে উঠল যেন। জোনাকজ্বলা সন্ধ্যায় জানালা ছেড়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসার সাহস ততদিনে এসে গিয়েছিল। বসন্তে আর গ্রীষ্মে যখন সবচে বেশি জোনাকি দেখা যেত, তখন পুকুরপাড়ে গিয়ে ঠায় বসে থাকতাম, স্বপ্নালু চোখে জোনাকিদের ওড়াউড়ি দেখতাম।

পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড় থেকে একটা–দুটা জোনাকি কখনো কখনো ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ত। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতাম। অন্ধকার ঘরে আয়েশ করে উড়ে বেড়াত জোনাকি, আমি আদুরে চোখে দেখতাম। কী যে ভালো লাগত! কখনো কখনো কাচের বয়ামে ভরে ফেলতাম জোনাকি, ছেড়ে দিতাম টানানো মশারির ভেতর। শুয়ে শুয়ে দেখতাম, জোনাকির টিপ টিপ আলোর ওড়াউড়ি! ঘুমানোর ঠিক আগে মশারি তুলে আবার ছেড়ে দিতাম জোনাকিদের, জানলা দিয়ে টুপুস করে বেরিয়ে যেত—যেন একচিলতে হলদে-সবুজ আলো!

কী যে দারুণ কাটত সে সময়গুলো!

নামে ফায়ারফ্লাই হলেও আদতে জোনাকিদের মোটেও মাছিগোত্রীয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত এরা একপ্রকার গুবরে পোকা!

নক্ষত্রের বান ছোটানো জোনাকিকে জলার পোকাও বলা চলে, যেখানে জলাভূমি রয়েছে, এদের দেখা সাধারণত এরকম জায়গাতেই পাওয়া যায়। ডোবা, খাল, পুকুর, নদীর মতো জলাভূমির আশপাশের ঝোপঝাড়ে এদের দেখা যায় গভীর আনন্দে টিপ টিপ আলো ছড়িয়ে উড়ে বেড়াতে।

আমার জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেক আর ঝোপঝাড়ে ভরা এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জোনাকির জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা। একেবারে কাছ থেকে জোনাকি যাপন আমার ভাগ্যে এখানেই সবচে বেশি জুটেছে বলা যায়।

বৃষ্টি মাথায় ছুটে বেড়ানো জাহাঙ্গীরনগরের জোনাকি দুনিয়ার সবচে স্নিগ্ধ দৃশ্যগুলোর একটা। এর স্বাদ যে চোখ পেয়েছে; তার দেখার সাধ যেন জ্বলে উঠেছে আরও বহুগুণ!

ক্যাম্পাসে ভরা বর্ষণের পর যখন ইলশেগুঁড়িতে নেমে আসত বৃষ্টি, রাতের আন্ধার আরও গাঢ় হয়ে জমে উঠতো মমতাময়ীর আদরের মতো ; জাহাঙ্গীরনগরের ট্রান্সপোর্ট মোড়ের পেছনের লেকজোড়া জোনাকির বান ডাকত তখন। শিক্ষকদের কোয়ার্টার থেকে জাহানারা ইমাম হলের পেছন হয়ে একেবারে গণিত ও পরিসংখ্যান ভবন পর্যন্ত ছড়ানো লেক পাড়ের ঝোপ আর লেকের শাপলা পাতায় তখন টিপ টিপ করে খেলে বেড়াতো ছোট ছোট হলদেসবুজ নক্ষত্রের দল।

আমি বৃষ্টি মাথায় নির্জন ট্রান্সপোর্ট মোড়ের পেছনে ভেজা চড়ুইছানার মত জবুথবু হয়ে বসে এসব নির্ভার জোনাকিদের দেখতাম। ওরা হাজার তারার আলো জ্বালিয়ে জ্বলত, নিভত, জীবনানন্দে ছুটে বেড়াতো লেকজোড়া, শান্ত আলোয় ছেয়ে ফেলত লেকের ধারের ঝোপ, জংলা। কখনোবা নাচতে নাচতে কোনো জোনাকি এসে আমার গায়ে, মাথায়, মুখে বসত, চুলের ভেতর ঢুকে যেত দিব্যি নির্ভাবনায়। আমি কখনোবা দুয়েকটা জোনাকি মুঠোবন্দি করে তন্ময় হয়ে দেখতাম আঙুলের ফাঁক চিরে বের হয়ে আসা ছোট্ট কীটের অবাক স্নিগ্ধ আলো।

ক্ষণিক আলো জ্বেলে জোনাকিরা আঙুলের ফাঁক গলে মুঠোর ভেতর থেকে নিজে নিজেই স্বাধীন হতো একসময়, ছুটে যেতো শাপলা পাতার ওপর। বৃষ্টি ছুঁয়ে আলোর নাচ তুলত, ইতিউতি ছুটত এক নিঃশব্দ আবেগ মাখিয়ে। একেবারে নির্ভার, নিঃস্বার্থ আর নির্ভয়ে; ছোট ছোট আলো জ্বেলে যেন জানিয়ে দিত এই তো জীবন, এই তো বেঁচে থাকার আনন্দ!

রাতের নির্জন ট্রান্সপোর্ট তখন আমার আর জোনাকির সঙ্গতায় জীবনের এক অনন্য উৎসবে মেতে উঠত যেন।

এতো অদ্ভুত বৃষ্টিভেজা জোনাকি আমি আর কোথাও পাইনি।

জাহাঙ্গীরনগরের বটতলা তখনো এত বিস্বাদী আলো ঝলমলে হয়ে ওঠেনি। টিনের শাটার নয়, দোকানপাট তখনো ঝাপ ফেলে বন্ধ করা হতো, বিদ্যুৎ গেলেই জ্বলে উঠত কুপি বা হারিকেন, টুংটাং বেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচ তুলত রিকশার পেছনে ঝুলতে থাকা কাচবন্দী হারিকেনের আলো। এরকম বিবাগী সন্ধ্যা ঘনালেই লাইব্রেরির পেছনের ঝোপঝাড়ে জেগে উঠত জোনাকির দল। হাবিব ভাইয়ের দোকানে বসে সেসব জোনাকি দেখতাম নেশাতুর চোখে, যেন এই জোনাকির আলোই শাশ্বত, এর ভেতরেই দুনিয়ার সব সৌন্দর্য হাঁসফাঁস করে; যেন এটা দেখার মোহেই আমার জীবন টিকে আছে অফুরন্ত কাল ধরে।

বঙ্গবন্ধু হলের পরিচর্যাহীন মাঠ সিডনি ফিল্ড এখন তকতকে হলেও তখন গলা অবধি ঘাসে ঢাকা থাকত, দিনের বেলা কেউ কেউ গরু ছাগলের জন্য ঘাস কাটতে যেত ওদিকে, আর সন্ধ্যা ঘনালেই সুনসান। সিডনি ফিল্ড থেকে হলের পিছনের লেক পর্যন্ত পুরোটায় ঝোপঝাড়ে সয়লাব তখন, সুইজারল্যান্ডের উল্টোপাশের কড়ই বনে নিবিড় নীরবতা, তার একটু পাশেই একটা তালগাছ নির্জন দাঁড়িয়ে আকাশ দেখত। সন্ধ্যার পরপরই এই এলাকার পুরো ঝোপজুড়ে জোনাকিরা মরিচবাতির হাট বসাত। ইতিউতি উড়ত, ঘাসের ডগায় বসে দোল খেত অবিরাম।

আমি অন্ধকারের ঘোর চোখে নিয়ে ওই ঝোপেঝাড়ে ঘুরতাম কখনো কখনো। আমার আওয়াজে জোনাকিরা আরও বেশি করে ওড়া শুরু করত, মাঝেমধ্যে আমি নিজেই ঘাসের গায়ে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে কিংবা ঘাসের জমিনে পা বুলিয়ে জোনাকি উড়াতাম। আকাশভর্তি তারার নিচে সিডনি ফিল্ডের জমিনেও যেন হাজার তারার বান ডাকত। এই অদ্ভুত ঘোর লাগা সময়ের যে নিগুঢ় আনন্দ, যে নিঘাত ভালোলাগা, তা এত সহজে স্মৃতিপট থেকে পটে বসবে বলে মনে হয় না।

বৃষ্টি আর আন্ধার মাথায় জোনাকি যেমন জীবনের আবেগী এক স্বপ্ন ফুটাতো জাহাঙ্গীরনগরে, তেমনি ভরা জোছনায় জোনাকিরাও যেন স্বর্গ ফুটাতো এ নগরের নির্লিপ্ততায়। ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ওদিকে জোছনার রাতগুলোতে এক অপার্থিব সৌন্দর্য দোল দিয়ে যেতো। আমি প্রায়ই জোছনায় ভিজতে বোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়িয়ে ডাব্লিউ আর সির পাশের কড়ইবাগানে গিয়ে বসে থাকতাম। ওখানে থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন আর সুইমিংপুলের পাশের লেকের ঝোপঝাড়ে নেচে বেড়ানো জোনাকিদের আসর দেখতে চমৎকার লাগত, জোনাকির ওড়াউড়ি দেখতে লাগত যেন অলৌকিক কোনো নন্দিনীর বিছিয়ে দেওয়া শাড়িতে তারার ফুল ফুটানো কারুকার্যের মতো। তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে পাল্লা দিয়ে হুক্কা হুয়া রবের হল্লা করে লেকের পাড় মাতাতো শিয়ালের পাল। কখনো কখনো মনে হতো, এখনি হয়তো জোছনা ছুঁয়ে নেমে আসবে ছোট্টবেলার কল্পনায় দেখা রূপকথার কোনো পরি, হাতের জাদুকাঠি নাড়িয়ে আমার চোখের সামনে রঙিন আতশবাজির তুবড়ি ছুটিয়ে বলে উঠবে, ‘বিবিডি, বাবিডি, বুউউউউউউ...’

একবার পাহাড়ের এক ঝিরির পাশে সপাটে সন্ধ্যা নেমেছিল। বাঁশকাঠের এক পাহাড়ি মাচাং ঘরের চারপাশে জোনাকির বান ডেকেছিল ঝিঁঝিপোকার কান ঝালাপালা তান উপেক্ষা করে। ঘরের মাচায় বসে আমি এক অদ্ভুত মায়ানগরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ঝিরির আশেপাশে হাজারো নক্ষত্রের পতো দেখলাম যেন, ছোট ছোট হলদে-সবুজ আলোর ঝলক তুলে পাহাড়ি ঝোপঝাড়ের ওপর একটা ঝলমলে রাতের আকাশ যেন ফুটিয়ে তুললো জোনাকির পাল।

পাহাড়ি জোনাকির সে কী রং, সে কী বাহার।

এই দৃশ্য এক জনমে ভোলা সম্ভব না!

সময় এখন পাল্টেছে। আমি আমার ছোট্টবেলার সেই জানালায় বসে এখন আর জোনাকির দেখা পাই না আগের মতো। পাহাড়ি ঝিরির ধারের জোনাকিরা কমে এসেছে একেবারেই, জাহাঙ্গীরনগরে জোনাকিরাও আর আগের মতো হাসে না।

চকচকে দালান আর ঝলমলে বৈদ্যুতিক আলোর নিচে আস্তে ধীরে হয়তো চাপা পড়ে গেছে জোনাকিদের প্রাণপ্রাচুর্যের জীবন, তারা সব হারিয়ে গেছে কোথায় যেন!

বনজঙ্গল ধ্বংস করে, জলাভূমি উজাড় করে মানুষেরা আবাস গড়তে গিয়ে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে এসব নক্ষত্রদের জীবন। নক্ষত্রদেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয়তো এ কারণেই!

তবু আমার যাপন করা জোছনা জীবন আমাকে এখনো আগের মতো স্বপ্নালু করে তোলে, চোখের তারায় টিপ টিপ করে এখনো স্বর্গ সুখের অনুভূতি জোগায়। এ অনুভব যারা পেয়েছে, শুধু তারা জানে, এ অনুভব কতটা অমূল্য, কতটা প্রশান্তির! এত এত নেই এর ভিড়, মন তবু আশা করে আবারও এদেশের জলা জঙ্গলে নেমে আসুক হলদেসবুজ আলোর নক্ষত্রেরা। কোনো ভাবুক বালক তার জানালায় বসে সন্ধ্যায় মিহিন আলোর জোনাকি দেখতে দেখতে ছড়া কাটুক,

‘পুকুর ধারে নেবুর তলে,

থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে।’