ডাকটিকিটের যাত্রা শুরু যখন থেকে

বাংলাদেশের ডাকটিকেট

এখন এক ক্লিকেই দূরের মানুষকে দেখা যায়, জানা যায় তথ্য। ইন্টারনেটের এই সহজ যোগাযোগব্যবস্থা খুব বেশি পুরোনো নয়। মাত্র ৫০ বছর আগেও দূরের কারও সঙ্গে কথা বলার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় ছিল কেবল একটি—চিঠি।

সময় বদলেছে। চিঠির ব্যবহার কমে এসেছে, জায়গা নিয়েছে ই-মেইল, স্মার্টফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবু চিঠির নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিল করা একটি খাম, যার ওপরের ডান কোণে জ্বলজ্বল করে একটি ছোট্ট ডাকটিকিট। এই ছোট্ট কাগজটির পেছনে লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

চিঠির শুরু বহু পুরোনো সময় থেকে। ঠিক কখন এর প্রচলন শুরু হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট নয়, কিন্তু প্রাচীন যুগেই দূরে বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল। ধারণা করা হয়, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সালে পারস্যের রানি প্রথম কোনো ধরনের বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তখন অবশ্য কাগজে লেখা হতো না। বার্তা খোদাই করা হতো কাঠের টুকরা বা পাথরে।

আরও পড়ুন

বাংলা উপমহাদেশে আধুনিক ডাকব্যবস্থার সূচনা হয় ১৫৪১ সালে, যখন ঘোড়ার মাধ্যমে বার্তা পাঠানো শুরু হয়। পরে ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৭৭৪ সালে চিঠি প্রেরণ–গ্রহণের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সরকারি ডাকব্যবস্থা গড়ে ওঠে। শুরুতে এটি সরকারি কাজের জন্য ব্যবহৃত হতো, পরে সাধারণ মানুষের জন্যও উন্মুক্ত করা হয়।

চিঠি থাকলেও ডাকটিকিট তখনো ছিল না। ডাকমাশুল সাধারণত প্রাপকের কাছ থেকে নেওয়া হতো, আর এখানেই জন্ম নিত সমস্যা। প্রাপক অনেক সময় মাশুল দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন, আর মাশুল নির্ধারণও ছিল অত্যন্ত জটিল। চিঠি কত দূর যাবে, কাগজ কতগুলো, এসব দেখে হিসাব করতে হতো।

আরও পড়ুন

এই জটিলতা দূর করতে এগিয়ে আসেন ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ স্যার রোল্যান্ড হিল। ১৮৩৭ সালে তিনি ডাকব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তিনটি যুগান্তকারী ধারণা তুলে ধরেন। প্রথমত, প্রাপক নয়, প্রেরক আগেই ডাকমাশুল পরিশোধ করবেন। দ্বিতীয়ত, দূরত্ব নয়, ওজনের ভিত্তিতে মাশুল ধার্য হবে। তৃতীয়ত, অগ্রিম মাশুল প্রদানের প্রমাণ হিসেবে খামের ওপর একটি ছোট আঠালো কাগজ লাগানো হবে। এই আঠালো কাগজই হয়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিট।

১৮৪০ সালে যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হয় সেই প্রথম ডাকটিকিট—‘পেনি ব্ল্যাক’। পুরোপুরি কালো রঙের এই স্ট্যাম্প ডাকব্যবস্থায় এক বিপ্লব ঘটায়। চিঠি পাঠানো আরও সহজ, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে। এরপর খুব দ্রুত বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ডাকটিকিট ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের নিজস্ব ডাকটিকিটের জন্মও এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই ২৯ জুলাই ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে। সেই বছরে মোট আটটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়, যেগুলোর নকশা করেছিলেন শিল্পী অধ্যাপক বিমান মল্লিক। যুদ্ধের দিনে এই ডাকটিকিট শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন বহনকারী প্রতীক।

আজ ই–মেইল বা মেসেঞ্জার যত দ্রুতগতিরই হোক না কেন, ডাকটিকিট এখনো বহু মানুষের কাছে ভালো লাগার জিনিস।

আরও পড়ুন