ঘরহীন মানুষের ছবি তুলতে গিয়ে খুঁজে পেলেন হারিয়ে যাওয়া বাবাকে

আমাদের চারপাশে কখনো কখনো এমন সব অদ্ভূত ঘটনা ঘটে, যা সিনেমার কাহিনিকেও হার মানায়। এমনই একটা গল্প বলি আজ।

ঘটনাটি ২০১৫ সালের। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হনুলুলুর।

আলোকচিত্রী ডায়ানা কিম বাস করেন এ শহরেই। তাঁর বাবা ছিলেন শখের আলোকচিত্রী। বাবার কাছেই আলোকচিত্রের হাতেখড়ি। আইনের ছাত্রী ডায়ানা আলোকচিত্রকে বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। কিন্তু যে বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন এই নেশা, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না প্রায় আড়াই বছর। শেষ পর্যন্ত বাবাকে তিনি খুঁজে পান হনুলুলুরই রাস্তায়। আর বাবা-মেয়ের এই পুনর্মিলন সম্ভব হয়েছে আলোকচিত্রের কারণেই! বাবাকে খুঁজে পাওয়ার অবিশ্বাস্য গল্পটি ডায়ানা জানান নিজের ব্যক্তিগত ব্লগে।

শৈশব খুব একটা সুখকর ছিল না ডায়ানার। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে মায়ের কাছে রেখে ছেড়ে যান তাঁর বাবা। ছোট্ট ডায়ানার যুদ্ধ শুরু হয় ওই বয়স থেকেই। শৈশবের বড় একটা সময় তাঁদের কাটাতে হয় আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে। রাত পার করতে হয় গাড়িতে, এমনকি পার্কিং লটেও। এত কষ্ট করলেও এখন ডায়ানা দারুণ সুখী। স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন হনুলুলুতেই।

খুব অল্প বয়সে বাবা ছেড়ে গেলেও কিছু স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে ডায়ানার মনে। এনবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানান তিনি, ‘আমি ছোটবেলায় মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতাম। মায়ের চোখ এড়িয়ে বাবা আমাকে রিং পপস আর গাম কিনে দিতেন।’

বাবা তাঁদের সঙ্গে না থাকলেও যোগাযোগ যে একদমই ছিল না, এমনটাও নয়। ওই বয়সে তাঁদের ফেলে যাওয়ায় বাবার সঙ্গে বেশ শীতল একটা সম্পর্ক ছিল ডায়ানার। তবে তাঁদের সম্পর্কের উন্নতি হয় বেশ কয়েক বছর আগে। একদিন ডায়ানাকে ফোন করে বাবা বলেন, ‘ডায়ানা, ওই বয়সে তোমাকে ফেলে যাওয়ার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। এখন তোমার নিজেরই একটা পরিবার হয়েছে, এ জন্য আমি যে কত খুশি, তা বলে বোঝাতে পারব না। বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রেখো। আমাকে নিয়ে লোকে যা–ই বলুক, কানে নিয়ো না। আমরা কখনোই ভালোমতো তোমার যত্ন নিতে পারিনি। বাবা হিসেবে আমি খুবই গর্বিত হব, যদি তুমি ঠিকভাবে নিজের বাচ্চাদের বড় করতে পারো। আরেকটা কথা, পৃথিবীর সবাইকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হবে না তোমার। সব সময় নিজের আর নিজের পরিবারকে নিয়েই চিন্তা করবে। কখনো ভুলো না, আমি তোমার নাম রেখেছি ডায়ানা, যার অর্থ অন্ধকারের মধ্যে একমুঠো আলো।’

ওই ফোনের পর বাবার ওপর থেকে সব রাগ দূর হয়ে যায় ডায়ানার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরপর আর ডায়ানার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি তাঁর বাবা। অনেক চেষ্টা করেও ডায়ানা পাননি বাবার নাগাল।

প্রায় দুই বছর পর হঠাৎই একদিন তিনি পেয়ে যান তাঁর বাবাকে। কিন্তু কখনো ভাবেননি, বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যাবে এভাবে।

নিজের ব্যক্তিগত একটা কাজে ডায়ানা হনুলুলুর রাস্তায় বাস্তুহারা মানুষদের ছবি তোলা শুরু করেন। এশিয়ান-মার্কিন নিউজপোর্টাল নেক্সটশার্কের সঙ্গে কথা বলার সময় জানান এর পেছনের কারণ, ‘কলেজে পড়ার সময় আমি গৃহহীন মানুষদের ছবি তোলা শুরু করি। ছোটবেলায় থাকার একটা স্থায়ী জায়গা আমারও ছিল না। তাই তাদের কষ্টটা কিছুটা হলেও আমি বুঝি। সমাজে নিজের কোনো স্থান না থাকলে কেমন লাগে, সেটা আমার খুব ভালোমতোই জানা, কারণ, একসময় আমিও তেমনই ছিলাম।’

এভাবে কেটে যায় বেশ অনেকগুলো বছর। ডায়ানা নিয়মিতই তুলে যাচ্ছিলেন হনুলুলুর গৃহহীন মানুষদের ছবি। প্রতিদিনকার মতোই একদিন ছবি তুলতে বের হন তিনি। সময়টা ২০১২ সাল। হাঁটতে হাঁটতেই রাস্তায় একজনের দিকে চোখ পড়ে। দাঁড়িয়ে আছেন জীর্ণ–শীর্ণ চেহারার এক ব্যক্তি। দেখে বোঝা যাচ্ছে, গোসল করেননি অনেক দিন। ছেঁড়া–ময়লা কাপড় পরে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন সামনে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একই জায়গায়। ছবি তুলবেন বলে ক্যামেরা দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন ডায়ানা। ক্যামেরার লেন্সে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, লোকটা যে আর কেউ নন, স্বয়ং তাঁর বাবা! ক্যামেরা ফেলে বাবার কাছে ছুটে গেলেও, কথা বলার শক্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। কাছে গিয়ে বেশ কয়েকবার ডাক দিলেও জবাব দিচ্ছিলেন না তিনি, দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থির হয়ে। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাবার কাঁধে আলতো টোকাও দেন তিনি। এরপরও কোনো সাড়া দেন না তাঁর বাবা। ততক্ষণে আশপাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। কেউ বুঝতে পারছিল না, একজন বাস্তুহারা মানুষের প্রতি ডায়ানা কেন এত আগ্রহ দেখাচ্ছেন! এক নারী তো বলেই বসেন, ‘তাঁকে ডেকে কোনো লাভ নেই। তিনি বেশ কয়েক দিন ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন।’

সেদিন ডায়ানার বাবা কোনো সাড়া দেননি। এর পর থেকে প্রতিদিনই ডায়ানা কোনো না কোনো সময় ছুটে যেতেন ওই রাস্তায়। কখনো বাবার দেখা পাওয়া যেত, কখনো যেত না। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় ডায়ানাকে চিনতেই পারেননি তিনি। সঙ্গে যাওয়া তো দূরের কথা, মুখে কোনো খাবার বা ওষুধও তুলতে চাননি তিনি।

এরপর কেটে যায় প্রায় দুই বছর। শত চেষ্টার পরও তখনো বাবাকে রাস্তা থেকে সরাতে পারেননি ডায়ানা। একদিন সকালে তাঁর কাজিন ফোন করেন, জানান হার্ট অ্যাটাক হয়েছে ডায়ানার বাবার। পুলিশ তাঁকে নিয়ে গেছে হাসপাতালে। খবরটা পেয়ে একটুও দেরি করেন না তিনি, ছোটেন হাসপাতালের দিকে।

হাসপাতালে গিয়ে নিজের বাবাকে তিনি আবিষ্কার করেন ঘুমন্ত অবস্থায়। নার্সদের চেষ্টায় আগের চেয়ে বেশ পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল তাঁকে। বাসায় ফিরে যাওয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে চোখ মেলে তাকান তাঁর বাবা। ডাক দেন ডায়ানার নাম ধরে। অনেক দিন পর বাবার মুখে নিজের নাম শুনে চোখের পানি ধরে রাখা কষ্ট হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জন্য। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে সেদিনের মতো বিদায় নেন তিনি। হাসপাতালে ডায়ানার বাবা ছিলেন আরও দুই মাস। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছেন, ফিরেছেন নিজের স্বাভাবিক রূপে।

একদিন অপরিচিত একটা নম্বর থেকে ফোন পান ডায়ানা। রিসিভ করে ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে বাবার গলা। একসঙ্গে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ডায়ানা। কফিশপের সামনে গাড়ি নিয়ে ঢোকার সময় ডায়ানা দেখতে পান তাঁর বাবাকে। তাঁকে যে চেনাই যাচ্ছে না! স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে অনেক, গায়ে পরিষ্কার জামা। ছোটবেলায় যেমনটা দেখেছিলেন ডায়ানা, দেখতে লাগছে ঠিক তেমন।

সেদিনের মুহূর্তটা ডায়ানার জীবনের অন্যতম আনন্দের বলে এনবিসি নিউজকে জানান তিনি। পাশাপাশি বাবার ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলেন তিনি, ‘অমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারায় বাবা অত্যন্ত গর্বিত। ভালো একটা চাকরি খুঁজছেন এখন। তাঁর জীবনে এখন আমাদের মতো লক্ষ্য আছে, আছে সফল হওয়ার তাড়নাও। বাবা ভবিষ্যতে আরও ভালো থাকবেন, আমার আশা এখন এটাই।’