ভুতুড়ে কাণ্ডের নায়কেরা

বাঘকাঁপানো শীত পড়েছে মাঘ মাসে। মধ্যরাতের পর টিনের ঘরের চালায় বৃষ্টি পড়ছে বেশ শব্দ করে। ঘরখানার তিন পাশেই বড় বড় আম-জাম ও কাঁঠালগাছ। আছে বড় বড় চারটি নারকেলগাছও। সন্ধ্যার পর থেকে শিশির ঝরছে—জমছে গাছগুলোর পাতায় পাতায়। জমা শিশির ভারী হয়ে মধ্যরাতে ঝরছে বৃষ্টির মতো। লেপ মুড়ি দিয়ে টিনের চালায় ‘শিশির-বৃষ্টির’ শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমটা দারুণ জমে।

হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ টিনের চালায়, ঘরসুদ্ধ মানুষের ঘুম ভেঙে গেল। কী পড়ল টিনের চালায়! শুকনো নারকেল, নাকি গেছো ইঁদুরের কেটে দেওয়া ডাব! উঠানে থপথপ শব্দ কিসের! ঘরের মুরব্বিরা কুপি জ্বেলে সাবধানে দরজা খুলে বারান্দায় নামলেন যখন, তখন ভয় পেলেন বেশ। লাফালাফি-দাপাদাপি করছে কিছু একটা! ছোটরা দরজায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে—তীব্র শীতে, না ভয়ে, তা ওরা নিজেরাই বুঝতে পারছে না। উঠানের মাটিতে লাফাচ্ছে ওটা কী! শোরগোল শুনে প্রতিবেশীরা এল। টর্চ-হারিকেনের আলোয় দেখা গেল আধা সের (আধা সের প্রায় ৪৬৬ গ্রামের সমান) আকৃতির একটি রুই মাছ ক্রমাগত লাফিয়েই চলেছে ঊর্ধ্বমুখে। রক্তে ওটার শরীর ভেসে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে সুরা-কালাম পড়তে পড়তে পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধ হাতের লাঠিখানা দিয়ে মাছটিকে মাটিতে চেপে রাখতে চাইলেন, উপস্থিত অন্যরা বলল, ছোঁবেন না, ছোঁবেন না।

বৃদ্ধ বললেন, মাছটার পিঠ-পেটে দেখি দাঁত বসে গেছে! বড় ছিদ্র হয়ে গেছে। গলগল করে রক্তও বেরোচ্ছে।

অন্য এক বৃদ্ধা বললেন, সবাই যার যার ঘরে যাও। মাছটাকে কিছু করার দরকার নেই। এটাকে মুখে কামড়ে ধরেছিল ‘মুচিভিটা’র পাকুড়গাছটার সেই মেয়ে মেছো ভূতটা। ‘সুতির বিলে’র মাছ! পাকুড়গাছে ফেরার পথে মুখ থেকে খসে পড়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। সবাই যার যার ঘরে গিয়ে দরজা এঁটে দিল ভূতের ভয়ে। শীতের প্রচণ্ড কাঁপুনির সঙ্গে শুরু হলো ভয়ের কাঁপুনি। শিশু-কিশোর ও কিশোরীরা লেপ–কাঁথা মুড়ি দিয়ে একেবারে চুপ। মুচিভিটার সেই ভয়ংকর মেছো ভূত! দু-চারটা দাঁত ওটার পড়ে গেছে, তাই বুঝি উড়ে যাওয়ার সময় দাঁত-মুখ থেকে খসে মাছটি পড়েছে টিনের চালায়। মেছো ভূতটি এই এলাকায় বিখ্যাত হয়েছে—আতঙ্ক ছড়িয়েছে বেশ কিছু ঘটনার জন্য। মাঝে মাঝে মাছ পড়ে ঘরের খড়ের চালায়। গত ভাদ্র মাসে তো পূর্ব পাড়ার তালেব আলী যখন তাল কুড়াতে তালতলায় গিয়েছিল ভোররাতে, তখন তার মাথা-ঘাড়জুড়ে একটি গজার মাছ পড়ল তালগাছটির মাথা থেকে। বেহুঁশ তালেবকে সকালবেলায় উদ্ধার করা হয়েছিল ধানবন থেকে।

ভোরবেলায় গত রাতে উঠানে পড়া রুই মাছটির হদিস পাওয়া গেল না। শিশিরভেজা উঠানে ছোপ ছোপ রক্তের ছাপ।

খবর পেয়ে দুপুরবেলায় বিখ্যাত ভূতের এক ওঝা এলেন ৭ মাইল দূরের ষাটতলা গ্রাম থেকে। পরনে বিশাল জোব্বা, মাথায় খয়েরি রঙের পাগড়ি, হাতে সুন্দরবনের হেঁতালগাছের ইয়া মোটা একখানা লাঠি। উঠানে বসলেন তিনি জলচৌকি পেতে। ডান হাত বাড়িয়ে রক্ত মেশানো ভেজা মাটি হাতের তালুতে রেখে নাকে ধরে শুঁকলেন, বললেন, ‘মাইছো ভূত’! মাইয়ে ভূত (মেয়ে ভূত) এইটা। পুরুষটা নড়তি-চড়তি পারে না। সারা রাত বইসে বউয়ের কামাই খায়। বুড়ির বয়স তিন শ বছর, বুড়োর সাড়ে তিন শ।’

বালক-বালিকারা ভয়ে সরে দাঁড়াল। বয়সীরা কেউ অবিশ্বাস করলেন না। পাঁচ টাকার বিনিময়ে সেই ওঝা আশপাশের ৭–৮টি বাড়িসহ টিনের চালের বাড়ির উঠানেও একটি করে মন্ত্রপূত তাবিজ গেঁড়ে দিলেন মাটির তলায়। মেছো ভূত হোক আর মেছো পেতনি হোক—এই এলাকায় আর ঢুকতে পারবে না। ওই বাড়ির মালিককে বললেন, বন্দুক দিয়ে শূন্যে তিনবার গুলি ছুড়তে। গুলি ছোড়া হলো। টিনের ঘরের মালিকের আছে ইংল্যান্ডের তৈরি একটা দামি বন্দুক।

দুই

গ্রামীণ ঘন-গভীর বাগান ও ঝোপঝাড়ে ভরা গ্রামটিতে কোনো পাকা ঘর নেই। অধিকাংশ ঘরই খড়ের চালার। বেড়া বাঁশের অথবা পাটকাঠির। ঘরের ডোয়া তথা মেঝে মাটির তৈরি। জনসংখ্যা কম। সন্ধ্যা নামতেই চরাচর সুনসান হয়ে যায়। মনে হয় বনের ভেতরে বসবাস করে কয়েক ঘর সাধারণ মানুষ।

এক সন্ধ্যায় স্কুলপড়ুয়া পাঁচ ভাইবোন রোজকার মতো বারান্দায় হোগলার পাটি বিছিয়ে গোল হয়ে বসে জোরে জোরে যার যার বই পড়ছে। মাঝখানে একটি হারিকেন। মা রান্নাঘরে রান্না করছেন। পোষা কুকুর ‘টাইগার’ উঠানে টান টান হয়ে শুয়ে বসন্তের বাতাস লাগাচ্ছে শরীরে। উঠানের চারপাশে নানান রকম বড় বড় গাছ, বরই-পেয়ারা-সফেদা-আমড়া-কলা। ঘরের পেছন দিকে একটি উঁচু ও মোটা রয়নাগাছ।

একটু বাদে পড়ুয়া পাঁচ ভাইবোনের কানে এল পাশের বাড়ির ময়নার ছোট বোনটির সুরেলা কান্না, বয়স মোটে ওর চার দিন। প্রায় সময়েই কাঁদে। কুকুরটা এ সময় তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে উপরমুখো হয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে বাড়ি ফাটাতে লাগল। রান্নাঘর থেকে মা ভাতের কাঠি হাতে বেরিয়ে এসেই ছেলেমেয়েগুলোকে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়তে বললেন। পাঁচ ভাইবোন অবাক। মা বললেন, পেতনির বাচ্চা কাঁদছে!

আতঙ্কে উঠে দাঁড়াল পাঁচ ভাইবোন, ঘরে ঢুকে কান পেতে শোনে—কান্না ভেসে আসছে রয়নাগাছটার মাথার ওপর থেকে। একটা না, ৩–৪টা পেতনিছানা কাঁদছে সম্মিলিত কণ্ঠে। একেবারে ‘নাকি’ সুরের কান্না। মা আবার রান্নাঘরে ঢুকলেন। বাবা গেছেন হাটে। ময়নার চার দিন বয়সী বোনটির কান্নার চেয়ে এই কান্না আরও করুণ।

রান্নাঘর থেকে গলা চড়িয়ে মা বললেন, ভালো করে পড়। পড়লে পেতনি বা পেতনির বাচ্চারা তোদের কোনো ক্ষতি করবে না। পেতনিটাও ভয় দেখাবে না।

কিসের পড়া! এ সময় সত্যিই ময়নার বোনটা তারস্বরে কাঁদতে শুরু করল। পেতনির বাচ্চাদের কান্না আর মানুষের বাচ্চার কান্নার শব্দ মিলেমিশে একাকার। পার্থক্য করা কঠিন।

বাবা ফিরলেন হাট থেকে। সব শুনে বললেন, সারা দিন খেলা আর দুষ্টুমি করলে এ রকমই হবে। পড়ালেখায় মন নেই। তাই পেতনির বাচ্চারা এসেছে। রয়নাগাছের মাথার বড় খোঁড়লে আখড়া গেড়েছে। ছোটখাটো ওঝা দিয়ে কাজ হবে না। কেঁদে কেঁদে ওরা মানুষের রক্ত খেতে চাইছে। বেশি ভয় পাসনে। আমি থাকতে ওরা তোদের করতে পারবে না কিছু। ঘরে বন্দুক আছে না!

পাঁচ ভাইবোন পাশাপাশি বসে থির থির করে কাঁপছে। মাথার ওপরে পেতনির বাচ্চা! কবে না লাফ দিয়ে ঘরের চালায় পড়ে, চালা ফুটো করে ঘরের ভেতরে পড়ে! নাকি ময়নার বোনটাকে তুলে নিয়ে যাবে শখ করে। মানুষের বাচ্চা পুষবে!

তিন

গ্রীষ্মের রাতে মায়ের পাশে শুয়ে গল্প শুনছে ছেলেটি। ছেলেটির বাবা চাকরি করেন সুন্দরবন লাগোয়া শরণখোলা থানায়। সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়িতে আসেন। তো ছেলেটির চোখে যখন ঘুম নেমে এসেছে, তখন উঠানে শুয়ে থাকা ‘টাইগার’ ও ‘কালু’ নামক কুকুর দুটি তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করল। পরমুহূর্তেই উঠানের কিনারের মানকচু ঝাড়গুলোর কাছে শোনা গেল ‘রুম ঝুম, রুম ঝুম’ ধরনের ঘুঙুরের আওয়াজ। শিশুদের খেলা ‘ঝুমঝুমি’ হাতে ধরে ঝাঁকালেও অনেকটাই এ রকম শব্দ হয়। কুকুরের হাঁকডাক ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে ঝুমঝুম শব্দ! ছেলে ভয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকাল। কান তার খাড়া। মা ফিসফিস করে বললেন, চুপচাপ শুয়ে থাক। পরিরানি হয়তোবা সুন্দরবন রাজ্য থেকে ডানাওয়ালা সাদা রঙের ১০টি পঙ্খিরাজ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। নজর পড়েছে আমাদের বাগানে। সঙ্গীদের নিয়ে নেমে পড়েছে উঠানে! নামবে না! কচুঝাড়ের পাশের ফুলবাগানে ফুটেছে গোলাপ, বেলি-রজনীগন্ধা, গাঁদা ফুলসহ কত রকম ফুল! পূর্ণিমার ফুটফুটে চাঁদনি রাত আজ। ওই শোন, খুশিতে একে অপরের হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নাচছে। পায়ে সবার ঘুঙুর বাঁধা, হাতভরা কাচের চুড়ি। শোন না, কী সুন্দর শব্দ বাজছে! বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখবি নাকি পরিদের নাচ! পরিরানিকে! দশটি সাদা ঘোড়া!

ছেলেটি আরও ভয় পেয়ে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিল। উঠানে পরিদের নাচ চলছে সমানে, থামছে না কুকুর দুটোও। তারস্বরে চেঁচিয়ে পাড়া ফাটাচ্ছে। গ্রামের পথে পথে ঘুরে যেসব মানুষ ‘ঘটিগরম’ বেচে হাঁক ছেড়ে ছেড়ে, তাদের পায়েও থাকে ঘুঙুর বাঁধা। হাঁটার ছন্দে ছন্দে পায়ের ঘুঙুর বাজে। ছেলেটির কানে বাজছে যেন সব ধরনের ঘুঙুরের ‘রুমঝুম’ শব্দ, মায়ের হাতের কাচের চুড়ির শব্দ। মায়ের সিল্কি শাড়ির খসখসানি ধরনের শব্দ। ছেলেটি মনে করল—পরিরাও পরেছে সিল্কের শাড়ি।

পরিরা এবার ‘ঝিনঝিন’ শব্দে শব্দে নাচতে নাচতে উঠানের প্রান্তের সুপারিবাগানের ভেতরে চলে গেল। কুকুর দুটো তখনো ডেকে চলেছে। শব্দ মিলিয়ে গেল একসময়। থেমে গেল কুকুরের ডাক।

শনিবারে ছেলেটির বাবা এলেন বাড়ি। রোববার ছুটি। ঘরের পেছনের একটি উঁচু আমগাছের ডালে প্রকাণ্ড একখানা মৌচাক। ২০ ফুট উঁচুতে থাকা মৌচাকখানা ‘কাটলে’ মধু পাওয়া যাবে কমপক্ষে ১২ সের। কিন্তু মৌচাক কাটার ‘গোন’ বা লগ্ন হলো ভরা পূর্ণিমার সময়। মৌচাক কাটার সব কৌশল জানেন বাড়ির স্থায়ী গৃহকর্মী গনি মিয়া। তবু বাবা আনতে চান সুন্দরবনের বিখ্যাত গুনিন মধু মৌয়ালকে। বয়স নাকি তাঁর এক শ বছর! এখনো সুন্দরবনে যান মৌচাক কাটতে। বাতাসে নাক টেনেই উনি মৌচাকের সন্ধান পেয়ে যান। মন্ত্র পড়ে উনি মৌমাছিদের ঘুম পাড়িয়ে ফেলেন। সুন্দরবনের রাজাকেও সম্মোহিত করে ওটার পিঠে চড়ে সুন্দরবনে ঘুরে ঘুরে মৌচাক খোঁজেন।

ওই শনিবার রাতেই ছেলেটি শুলো বাবার কোলের কাছে। মা অন্য পাশে। বাবা গল্প বলছেন। বাইরে ফুটফুটে চাঁদনি। ঘরভরা অন্ধকার। ঘরের তিন পাশ জোড়া গাছগাছালি!

ঘুঙুরের শব্দ বেজে উঠল হঠাৎ ঘরের পেছন দিকে। ছেলেটি বাবার বুকের একগুচ্ছ লোম খামচে ধরে বলল, আজ আবার পরিরা এসেছে ফুল তুলতে! বাবা বললেন, আমতলায় মনে হয় আমের ‘গুটি’ কুড়াতে নেমেছে!

বাবা ছেলের মাথায় হাত রেখে আবারও বললেন, ভয় পাসনে। ঘরে বন্দুক আছে না! দরকার হলে গুলি করে দেব। শোন খোকন, আমার তো মনে হচ্ছে পরিটা এসেছে আজ মৌচাক থেকে টাটকা মিষ্টি–মধু পান করতে। মধু খুব পছন্দ করে ভূত-পরিরা। মৌচাকের সন্ধান পেলে ওরা স্থায়ীভাবে থেকে যায়। যত দিন মৌচাক কেটে নামানো না হবে, তত দিন ওরা ‘ভস্ম’ বা অদৃশ্য হয়ে আমগাছে থেকে যাবে। আমার ছেলেবেলায় ৪–৫ বার আমাকে পরিরা তুলে নিয়ে আকাশপথে ‘কোহেকাফ’ শহরে নিয়ে গিয়েছিল। রোজ চার বেলা করে পেটাত ঝাড়ু দিয়ে। বদখত চেহারার ভূতের ছানাগুলো বড় বড় নখ দিয়ে হাত-পা-পিঠ ও বুকে খোঁচা মারত। খেতে দিত না কিছু। বুঝলি, ভূতগুলো হলো পুরুষ। বিশ্রী চেহারা। পরিরা সুন্দরী। ওরা আমাকে মারত না বটে, খেতেও দিত না। আমার অপরাধ হলো, কেন আমি মৌচাকে রোজ ঢিল মারি! গুলতির ‘গুরোল’ মারি। তির-ধনুক দিয়ে ২–৩ হাত লম্বা পাটকাঠি ছুড়ি! ৪–৫ বারই আমি মাফটাফ চেয়ে ছাড়া পাই। পরিরাই আমাকে ঘাড়ে করে বাড়ির উঠানে নামিয়ে দিয়ে যায়। ছেলেটি তো ভয়ে কাঠ! ঘরের পেছনের মৌচাকের তলায় নাচছে পরি!

একটু থেমে বাবা আবার বললেন, দেখবি পরিটাকে? রাতেই বেরোয় শুধু। এটাই এখন মৌচাকের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে সারা দিন পড়ে পড়ে ঘুমায়। রাতে মধু পান করে পাটকাঠি দিয়ে টেনেটেনে— তোরা যেমন পাটকাঠি তাল-খেজুরের ঠিলার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চুষে চুষে রস পান করিস। ওঠ! ভয় নেই। আমি আছি না!

পরি দেখতে কার না ইচ্ছা করে! ভয়ে ভয়ে খোকন উঠে বসল। বাবার বুকের ভেতরে থেকেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকাতেই আলো-আঁধারির তলায় পরিটাকে দেখতে পেল। ঘুরে ঘুরে নাচছে। পায়ের ঘুঙুর বাজছে তালে তালে। পরিটার পরনে দেখি মায়ের মতো একই রঙের সিল্কের শাড়ি! বাজছে হাতের কাচের চুড়ির ‘টুং টাং টিং টাং’ আওয়াজ!

চার

হেমন্তকাল। রান্নাঘরের পেছনেই পুকুর। পুকুরপাড় জোড়া তাল-নারকেল-আম-জামগাছ ও ঝোপঝাড়ের সারি। দক্ষিণ পাড়ে পারিবারিক গোরস্তান। গাছপালা ঝোপঝাড় এতই ঘন ওখানে যে ভরদুপুরেও রোদ পড়ে না ওখানকার মাটিতে। মস্ত বড় একটা হিজলগাছ আছে ওখানে মাথা উঁচু করে। তার পাশেই বিশাল একটা তেঁতুলগাছ। সেই গাছে আছে গিন্নি শকুনের বাসা। বাসার ছানাটি যখন কাঁদে, তখন সারা গ্রাম থেকেই বুঝি শোনা যায়। খিদে পেলে শকুনছানারা একনাগাড়ে চেঁচাতেই থাকে। আর ওই হিজলগাছে নাকি ‘হিজলগাছের পিছল ভূত’ বাস করে। রাতে কখনো কখনো ওই গাছের মাথা থেকে ভেসে আসে বিড়ালের ডাকের শব্দ, দু-চার দিন বয়সী মানবশিশুর কান্নাও। ভয়ে দিনের বেলায়ও ওদিকটা মাড়ায় না কেউ।

রাতে মা-ছেলে শুয়ে আছে ঘরের মেঝেতে। মাটির মেঝে। তার ওপর মাদুর বিছানো। একখানা পাতলা কাঁথা। মশারি টানানো।

মাঝরাতে ছেলেটির ঘুম ভাঙল। প্রস্রাব করবে। মাকে ডাকতেই মা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললেন, বেড়ার পাশে যা।

ছেলেটি বেড়ার কাছে গিয়ে বসল। কাজ সেরে আবার এসে শুয়ে পড়ল মাকে জড়িয়ে ধরে। তখন পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের দিকের জলে প্রচণ্ড শব্দ আর তোলপাড় শুরু হলো। ভাদ্র মাসে ঝপ ঝুপ শব্দে যেন পাকা তাল পড়ছে পুকুরের জলে। এ তো তাল পড়ার শব্দ না! মনে হচ্ছে একদল ছেলেমেয়ে পুকুরে নেমে ডুবসাঁতারের খেলায় মেতেছে। ডিগবাজি দিচ্ছে কেউ কেউ। একটু পরেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠের ডাকাডাকি শুরু হলো। এই ছেলেটি যখন দলবলসহ এই পুকুরে নেমে সাঁতরায়, ডুব দেয়, পুকুরপাড়ের কাত হওয়া গাছের ডালপালা ও তাল-নারকেলের গোড়ায় দাঁড়িয়ে দর্শনীয় উল্টো ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে, তখনকার শব্দের মতোই মনে হচ্ছে! হাকিম আর মজিদ ভালো শিস দিতে পারে। কে ওই তীক্ষ্ণ শিস বাজায় এই মধ্যরাতের পুকুরে!

ছেলেটির মা বললেন, এগুলো জলভূতের ছেলেমেয়েরা। হিজলগাছের পিছল ভূতের ছানারাও এসে যোগ দেয় রাতে। তোরা যেমন পুকুরে গোসল করতে নেমে দুষ্টুমি করিস দিনে, ভূতের বাচ্চারাও গোসল করে রাতে। দুষ্টুমিও করে।

ভূতের ভয়ে ছেলেটি যেন জমাট বেঁধে যাবে! এই প্রথম শুনল সে ভূতের ছানাদের ডুবসাঁতারের শব্দ।

পরে এই ছেলেটিই শীতের এক রাতে (তখন তারা মোট ৫ ভাইবোন) টিনের চালায় মেছো ভূতের মুখ থেকে রুই মাছ পড়ার প্রচণ্ড শব্দ শুনেছিল। পাঁচ ভাইবোনেরই সেদিন থেকে মেছো ভূতের আতঙ্ক ও বিশ্বাসটা বুকের গহিনতম প্রদেশে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। তখন গ্রামবাংলায় ‘ভূতভীতি’ ভয়ংকর প্রকট ছিল। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ বেশি ছিল। ছিল কিছু ভণ্ড ভূতের ওঝা। তারাও নানা রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভূতগ্রস্ত-পেতনিগ্রস্ত কারও পরিবারকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলত।

ঘাড়ের ভূত নামানোর ঘটনাও প্রায়ই ঘটত, উত্সুক মানুষ ‘ওঝা ও রোগীকে’ ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের ভূত বা পরিকে তাড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখত। ওঝারা নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে, কসরত করে ও জোরে জোরে অস্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ করে অন্ধবিশ্বাসী সমাজকে মোহগ্রস্ত করে ফেলত। ভূত-পরি তাড়ানোর ভয়ংকর ভয়ংকর বানানো কাহিনি শোনাত, কারও কারও সঙ্গে পাঁচ-দশটা ভূত-পরি থাকত বডিগার্ড হিসেবে। দিনে তো আর ভূত-পরি দেখা যায় না। তাবিজ-কবচ দিত ওই সব ওঝা। বলত, কামরূপ–কামাখ্যা থেকে এনে দিয়েছে তার বশীকরণ করা দৈত্যরা। আরও কত গালগল্প! অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করত। গভীর রাতে আঁধার ঘরে পরিরা এসে মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলত, অনুরোধ করলে নাচ–গানও করত। বিনিময়ে টাকা দিতে হতো। যাহোক, বাড়ির ওপর দিয়ে ভূত-পরিরা যাতে উড়ে যেতে না পারে কিংবা বাড়ির সীমানায় প্রবেশ না করতে পারে, সে জন্য ‘বাড়ি বন্ধ’ করে দিত ওঝা-কবিরাজেরা। ভূত-পরি-পেতনি নিয়ে হাজার রকম গল্প প্রচলিত ছিল সমাজে। চাক্ষুষ ভূত-পরি দেখার লোকের যেমন অভাব ছিল না, তেমনি বিশ্বাস করার লোকও ছিল প্রচুর। ভূতের সঙ্গে কুস্তি লড়ার সাহসী মানুষ ছিল, মেছো ভূতের কবল থেকে বোয়াল-গজার ছিনিয়ে আনা বীর ছিল, ভূতের গল্পের অবস্থা ছিল রমরমা—অন্তত আশির দশক পর্যন্ত।

এখনো ভূতে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা কম নয় আমাদের সমাজে। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারগুলো যুক্তি বা বাস্তবতা দিয়েও দূর করা যাবে না সহজে। অবশ্য গত ৫০–৬০ বছরে অন্ধবিশ্বাস-কুসংস্কার ৫০ শতাংশ কমে গেলেও ৫০ শতাংশ মানুষ সেই ৫০–৬০ বছর আগের মতো ভূত-পরি–কাণ্ডে ঘোরতর বিশ্বাসী।

যেসব ভুতুড়ে কাণ্ডের কথা আমি এতক্ষণ বলেছি, সব কটিরই প্রত্যক্ষদর্শী আমি—সেই সময় আমি ও আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম সব, আমার বয়স ২৫ বছর হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে আমি উল্লিখিত ভৌতিক কাণ্ডগুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যা পেয়েছি। রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। যাহোক, সেসব ভুতুড়ে কাণ্ডের নেপথ্য নায়কেরা আজও গ্রামবাংলায় আছে, যদিও সেসব নায়কদের কেউ কেউ গ্রামবাংলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কেউ কেউ টিকে আছে, অস্তিত্ব–সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে দিনরাত।

বগুড়ার শাহজাহানপুরে ভুতুম প্যাঁচা

প্রথম ঘটনার নায়ক: টিনের চালে-ঘরের চালে বা পাকা বাড়ির ছাদে অথবা পথচলতি মানুষের মাথায় ও উঠান-বাড়িতে এখনো আকাশ থেকে রক্তাক্ত মাছ পড়তে পারে, তড়পাতে পারে। বাড়ির ছাদে ওই তড়পানির শব্দকে ‘ধুপধাপ’ মনে হতে পারে ঘরের ভেতরের মানুষজনের, মনে হতে পারে পায়ে ঘুঙুর ছাড়াই রাতে কেউ নাচছে তালে তালে ঘরের ছাদে, অথবা লাফাচ্ছে। পরদিন সকালে ছাদে মৃত মাছ দেখলে ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। ছাদে মাছ এল কেত্থেকে! নিশ্চয়ই ভূত-পেতনি বা পরির কাজ!

আসলে, মাছটি খসে পড়েছে আমাদের আবাসিক পাখি ভুতুম প্যাঁচার পায়ের আঁকশির মতো শক্তপোক্ত ও ধারালো নখর থেকে। নিশাচর এই পাখিটির মূল খাদ্য মাছ। নখরে মাছ গেঁথে বাসার ক্ষুধার্ত ছানাদের কাছে অথবা উঁচু গাছের দিকে যাওয়ার সময় নখর ফসকে ক্বচিৎ পড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভুতুমরা সহজে মাটিতে নামে না, কিন্তু বাড়ির ছাদে নামে পুনরায় শিকারটিকে পাকড়াও করতে। এ ক্ষেত্রে মাছ ও ভুতুমের অসম লড়াইয়ের কারণেও ছাদের শব্দটা ভয়ংকর মনে হতে পারে। তবে কম বয়সী আনাড়ি ভুতুম প্যাঁচা, নখর ক্ষয়ে যাওয়া বুড়ো ভুতুম প্যাঁচার ক্ষেত্রেও এ রকম ঘটনা কখনো কখনো ঘটে। সাধ্যে কুলোবে না—এমন মাছ শিকার করেও এই প্যাঁচারা, তখন ওড়ার পরে পা থেকে খসে পড়তে পারে মাছ। প্রথম ঘটনাটা ও রকমই ছিল, তাই নিয়ে কত কাণ্ড!

ভুতুম প্যাঁচার গোলগাল মাথা-মুখমণ্ডল ও বড় বড় চোখ দেখলে এমনিতেই ছেলেপুলেরা ভয় পেয়ে যেতে পারে। ভুতুমের ইংরেজি নাম Broun Fish Owl. বৈজ্ঞানিক নাম Ketupa zeylonensis. দৈর্ঘ্য ৬১ সেন্টিমিটার। ওজন ১.১-২.৫ কেজি। গ্রামবাংলার মানুষেরা এই প্যাঁচাটিকে চেনেন। এদের ভয়ংকর ভৌতিক ডাকের সঙ্গেও পরিচিত গ্রামবাংলার মানুষ। এই প্যাঁচারা বাড়ির আঙিনার গাছে বসে ডাকলে নাকি সেই বাড়ির ভয়ংকর অমঙ্গল হয়। এটা একেবারেই কুসংস্কার।

দুই নম্বর ঘটনার নায়ক: রাতে ঘরের পেছনের রয়নাগাছে যে পেতনির বাচ্চা বা একাধিক পেতনির বাচ্চা ঠিক ময়নার চার দিন বয়সী বোনটার মতো অথবা ৪–৫ দিন বয়সী মানবশিশুর মতো কাঁদছিল, ওগুলো ছিল আমাদের আবাসিক ও নিশাচর বন্য প্রাণী গন্ধগোকুলদের ছানাদের কান্না। মা-বাবা গন্ধগোকুল তো দিনভর ঘুমিয়ে-ঝিমিয়ে কাটায় বড় বড় গাছ অথবা গাছের কোটরে-ফোঁকরে। সন্ধ্যায় মা-বাবা যখন পিচ্চি ছানাদের রেখে চরতে বেরোয়, তখন ছানারা কাঁদে, বায়না ধরে মা-বাবার পেছনে পেছনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে বয়স তো ওদের হয়নি! গন্ধগোকুলের ছানারা কাঁদে বিড়ালছানা অথবা ৪–৫ দিন বয়সী মানবশিশুর মতো, জোরে জোরে। খিদেয়ও কাঁদে তারস্বরে। এটাই পরি বা পেতনির কান্না বলো আজও বিশ্বাস করে অনেকে। লম্বা-লোমশ লেজের গন্ধগোকুলের ইংরেজি নাম Common Palm Civet। বৈজ্ঞানিক নাম Paradoxurus hermaphroditus। দৈর্ঘ্য, লেজ ৫৫ সেমি, শুধু বডি ৫৩ সেমি। ওজন ২-৪ কেজি।

উল্টোভাবে তার বেয়ে এগুচ্ছে গন্ধগোকুলের ছানাটি
ছবি: এস আই সোহেল

এখানে বিশেষ একটি কথা আছে। এই ছানারা যখন (ছানা হয় ৩-৪টি) মা-বাবার পেছনে ঘোরার অনুমতি পায়, তখন ঘরবাড়ির চালায় লাফালাফি করে, ছাদ পেলে তো প্লে-গ্রাউন্ড বা ডাইনিং টেবিল মনে করে দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়ি খেলায় মাতে—ঠিক বিড়ালছানাদের মতো। ছাদের ওপরের শব্দকে তখনো ‘ভূতের নৃত্য’ মনে হতে পারে। গাছের ডালপালা থেকে যদি বয়সী গন্ধগোকুল ছাদে লাফিয়ে পড়ে, তাহলে ছাদে আকাশ থেকে দৈত্য লাফিয়ে নেমেছে বলেও মনে হতে পারে। বৃক্ষচর এই প্রাণীরা তো বটেই, ছানারাও বাড়ির উঠানে টানানো কাপড় শুকানোর তার বা দড়িতে উল্টো হয়ে ঝুলে যাতায়াত করতে পারে। যেন দক্ষ সার্কাসম্যান! বুনো মোটা লতা ধরেও এই কাজটি করে তারা।

তৃতীয় ঘটনার নায়কেরা: এরা হলো সারা শরীরে বড় বড় কাঁটাভরা প্রাণী শজারু। নিশাচর এই প্রাণীরা দিন কাটায় মাটিতে নিজেদের গড়া সুড়ঙ্গে। রাত একটু বেশি হলে দলবদ্ধভাবে খাবারের সন্ধানে বেরোয়। মানুষের বাড়ির আঙিনা বা আশপাশের বাগানে গেলে পোষা কুকুরেরা এদেরকে ধাওয়া করে, প্রচণ্ড ডাকাডাকি-হাঁকাহাঁকি করে। এ সময় শজারুরা ওদের লেজের ফাঁপা কাঁটা খাড়া করে নেড়ে নেড়ে ঝিনঝিন শব্দ করে ভয় দেখায় কুকুর বা অন্য যেকোনো শত্রু প্রাণীকে। এদের শরীরের ৬-৯ ইঞ্চি মাপের কাঁটাগুলো দেখতে পেনসিলের মতো। শক্ত ও ধারালো। এগুলো জাগিয়ে-ফুলিয়ে শজারুরা কেমন যেন গোলগাল আকৃতি ধারণ করে, কাঁটায় কাঁটায় জোরে জোরে আঘাত করে ‘কাঁটা সংগীত’ বাজায়, এটাই হলো পরিদের পায়ের ঘুঙুরের আওয়াজ।

রাঙ্গামাটিতে সজারু
ছবি: ড. আ ন ম আমিনুর রহমান

গ্রামবাংলা থেকে শজারু এখন বিলুপ্ত (১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ছিল) হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক ও পার্বত্য বনগুলোতে আছে। শজারুর কাঁটা আর বর্তমানে কিশোরী-তরুণীদের মাথার চুলে গোজার কাঁটা দেখতে প্রায় একই রকম। শজারুদের শরীরের কাঁটা এমনিতেই ঝরে পড়ে কখনো কখনো। শৈশব-কৈশোরে বাগানে আমরা কাঁটা কুড়িয়ে পেলে আমরা বোন-ভাবি বা মা-চাচিদের এনে দিতাম। তাঁরা মাথার চুলের খোঁপায় ওই কাঁটাই গুঁজতেন।

শজারুর কাঁটাকে ভয় করে সুন্দরবনের বাঘ থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার শিয়াল পর্যন্ত। ওই কাঁটা ভয়ংকর বিষাক্ত। বাঘের থাবায় বা নাকে বিঁধে গেলে যন্ত্রণা হয়। পচন ধরে। ছেলেবেলায় পোষা কুকুরের ঘাড় ও নাক-মুখে পচন ধরতে দেখেছি। এই ‘শজারু-পরির’ ভয়কে কাজে লাগিয়ে আমার মা-বাবা যুক্তি করে ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমাকে পরির নাচ দেখিয়েছিলেন। কেননা, মৌচাকখানায় আমরা প্রায়ই ঢিল মারতাম। মৌমাছির কামড়ে বিপদ না বাধাই, সে জন্য মা সেই ঘুঙুর পায়ে রাতে পরি সেজে নেচেছিলেন।

শজারুর ইংরেজি নাম Himalayan crestless porcupine। বৈজ্ঞানিক নাম Hystris brachyura। শুধু শরীরের দৈর্ঘ্য ৬০ সেন্টিমিটার, লেজ ৬ সেন্টিমিটার। ওজন ১১-১৮ কেজি। শরীরভরা কাঁটাগুলো ৫ থেকে ৩০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়।

রাজশাহীর পদ্মার চরে ভোঁদর

চতুর্থ ঘটনার নায়ক: চতুর্থ ঘটনার নায়ক হচ্ছে ভোঁদড় বা উদবিড়াল। মূলত নিশাচর। রাতে পুকুর-দিঘি-খাল-বিলে নেমে মাছ ধরে খায়। ডুবসাঁতার ও জড়াজড়ি-হুড়োহুড়িতে খুবই ওস্তাদ। পাড় থেকে লাফ দিয়ে জলে পড়ে, আবারও ডাঙায় ওঠে, আবারও লাফের খেলাটা ওদের খুবই পছন্দের। ওই শব্দই হলো ‘জলভূত’ বা জলদৈত্যের’! জলদৈত্যের বা জলভূতের ভয় দিয়ে মা-বাবা চাইতেন—বেশি ডুবোডুবি না করি আমরা। ডুবে মরার ভয় তো থাকে! ওই ভয়ে আমরা গোরস্তানের নিচের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে গিয়ে ডুবসাঁতারের চেষ্টাই করতাম না। ভোঁদড়রা পেছনের দুই পায়ে ভর করে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে নাচতে পারে। তা ছাড়া গুলিতে কোমরভাঙা ভোঁদড়ের ‘ভোঁদড়নৃত্য’ বার কয়েক আমি দেখেছি। ভোঁদড়েরা বিষধর সাপসহ অজগর সাপও মেরে ফেলতে পারে—সুপরিকল্পিত কৌশলে।

ভোঁদড়ও গ্রামবাংলা থেকে বিলুপ্ত। ইংরেজি নাম Oriental small-clawed otter। বৈজ্ঞানিক নাম Aonyx cinerea। দৈর্ঘ্য বডি ৪১ সেন্টিমিটার, লেজ ২৯ সেন্টিমিটার। ওজন ২.৭-৫.৪ কেজি।