সবচেয়ে দ্রুতগামী ডাইনোসর কোনটি
ডাইনোসরের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। জুরাসিক পার্কের মতো জনপ্রিয় মুভি বা বিভিন্ন কার্টুনের সাহায্যে এই দানবাকৃতির প্রাণী সম্পর্কে আমরা অনেকটা জেনেছি। অবশ্য তোমরা অনেকে বইপত্র বা ম্যাগাজিন পড়েও জেনে থাকতে পারো। তবে মুভিতে সাধারণত ডাইনোসরকে বিশালাকার দেখায়। কিন্তু এরা যে দ্রুতগামী, তা ওদের শরীরের কারণে বোঝা যায় না। ডাইনোসর যে অনেক দ্রুত দৌড়াতে পারত, তা কি তোমরা জানো? আসলে বিজ্ঞানীরাও জানতেন না। বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, ডাইনোসর যেহেতু অনেক বড় প্রাণী এবং এদের রক্ত ঠান্ডা, তাই এরা বেশি দ্রুত দৌড়াতে পারে না। কিন্তু বিজ্ঞানীদের সেই ভুল ভেঙে গেল ১৯৬৪ সালে।
বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরদের একটা নতুন ফসিল খুঁজে পেলেন। সেই ডাইনোসরের নাম দেওয়া হলো ডাইনোনাইকাস। এদের শরীর ছিল হালকা। পায়ে ছিল বড় বড় বাঁকানো নখ। আর পাগুলো ছিল খুব শক্তিশালী। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, এই বৈশিষ্ট্যের ডাইনোসর নিশ্চয়ই অনেক দ্রুত দৌড়াতে পারত! তাছাড়া ওই ডাইনোসর কিন্তু বিশালাকার ছিল না। এরা ছিল আকারে ছোট, চটপটে আর দৌড়ে দারুণ দক্ষ। এই ফসিল আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। তারা বুঝতে পারলেন, অনেক ডাইনোসরই হয়তো তাঁদের ভাবনার চেয়ে দ্রুতগামী ছিল। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী ডাইনোসর কোনটি?
এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের জীবাশ্মবিদ সুজানা মেডমেন্ট। তাঁর মতে, সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী ডাইনোসর ছিল অর্নিথোমিমোসরিয়া গোত্রের কোনো ডাইনোসর। এরা দেখতে অনেকটা উটপাখির মতো। আর ওদের মতোই দুই পায়ে হাঁটত। এদের লম্বা আর সরু পায়ের গঠনই বলে দেয়, দৌড়ে এদের জুড়ি মেলা ভার।
তবে শুধু পায়ের ছাপ দেখে সবসময় সঠিক গতি বলা যায় না। কারণ, ডাইনোসররা দৌড়ানোর সময় আসলেই সবচেয়ে লম্বা পদক্ষেপে (সবচেয়ে বড় পা ফেলে) দৌঁড়েছিল কিনা, তা তো আর বিজ্ঞানীরা দেখেননি। আর এখন আর দেখার সুযোগও নেই।
এ ব্যাপারে মেডমেন্ট বলেন, ‘লম্বা আর হালকা পায়ের পেশীগুলো পায়ের ওপরের দিকে লাগানো থাকলে পা খুব সহজে পেন্ডুলামের মতো নড়াচড়া করতে পারে। এর মানে, প্রাণীটা বেশ দ্রুত দৌড়াতে পারে।’
কোন ডাইনোসর কতটা দ্রুত দৌড়াতে পারত, সেটা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা একটা নতুন উপায় বের করেছেন। প্রাণীদের হাঁটাচলার নিয়মকানুন নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন বিজ্ঞানী হলেন রবার্ট ম্যাকনিল আলেকজান্ডার। ১৯৭০-এর দশকে তিনি বায়োমেকানিক্স নামে একটা নতুন পদ্ধতি দেখান। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখা গেল, কোনো প্রাণী যত দ্রুত হাঁটে বা দৌড়ায়, তার পায়ের পদক্ষেপ তত বড় হয়। ডাইনোসরদের পায়ের ছাপ দেখে আর ওদের পায়ের হাড়ের মাপ নিয়ে বিজ্ঞানীরা আন্দাজ করার চেষ্টা করতেন, কোন ডাইনোসরটা কতটা দ্রুত দৌড়াতে পারত।
তবে শুধু পায়ের ছাপ দেখে সবসময় সঠিক গতি বলা যায় না। কারণ, ডাইনোসররা দৌড়ানোর সময় আসলেই সবচেয়ে লম্বা পদক্ষেপে (সবচেয়ে বড় পা ফেলে) দৌঁড়েছিল কিনা, তা তো আর বিজ্ঞানীরা দেখেননি। আর এখন আর দেখার সুযোগও নেই। সে কারণেই শুধু পায়ের ছাপ দেখে ওদের দৌড়ের গতি বোঝার উপায় নেই। তাছাড়া, ওদের পায়ের সবচেয়ে ভালো ছাপ পাওয়া যায় কাদা মাটিতে। কিন্তু কাদামাটিতে দৌড়ালে তো সবচেয়ে দ্রুত দৌড়ানো যায় না। তাই না! তাহলে উপায়?
এই সমস্যার সমাধান দেখালেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের অধ্যাপক উইলিয়াম সেলার্স। তিনি আরেকটি নতুন উপায় বের করলেন। কম্পিউটার মডেলিং ও ইভল্যুশনারি রোবটিক্স বেছে নিলেন। প্রথমে কম্পিউটারে ডাইনোসরদের কঙ্কাল তৈরি করলেন। তাতে যোগ করলেন পেশি আর হাড়ের গঠন। তারপর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে ডাইনোসরের দৌড় সিমুলেট করলেন। ফলে ডাইনোসররা আসলে কীভাবে দৌড়াত, তার একটা ভালো ধারণা পাওয়া গেল। যেহেতু পেশি আর নরম টিস্যু ফসিল হয় না, তাই সেলার্স আন্দাজ করে নিয়েছিলেন পেশীগুলো কেমন ছিল।
মানুষ, উটপাখি আর এমু পাখির মতো আধুনিক প্রাণীদের হাঁটাচলার সঙ্গে মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা তাঁদের কম্পিউটার মডেল পরীক্ষা করলেন। যখন দেখলেন মডেলগুলো আসল প্রাণীদের গতির সঙ্গে মিলছে, তখন তাঁরা ডাইনোসরদের গতিও সঠিকভাবে মাপতে পারবেন বলে ভরসা পেলেন। সেলার্স পাঁচটা ডাইনোসর নিয়ে মডেল তৈরি করেছিলেন। ডাইনোসরগুলোর মধ্যে ছিল অ্যালোসরস, কম্পসোগনাথাস, ডাইলোফোসরস, টিরানোসরস রেক্স এবং ভেলোসির্যাপ্টর। এর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী ছিল কম্পসোগনাথাস। ঘণ্টায় প্রায় ৬৪.১ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারত এরা! আর ভেলোসির্যাপ্টর ছিল দ্বিতীয় স্থানে, ঘণ্টায় গতি প্রায় ৩৮.৯ কিলোমিটার। এই পাঁচটি ডাইনোসরই মূলত মাংস খেত এবং দুই পায়ে হাঁটত।
তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, টি-রেক্স ছিল সবচেয়ে ধীরগতির, মাত্র ২৮.৮ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় দৌড়াতে পারত এরা। কারণ তার বিশাল শরীর এত বেশি ওজন নিয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারত না। এতে হাড় ভেঙে যাওয়ারও আশঙ্কা ছিল। যদিও আগের অনেক গবেষণায় বলা হয়েছে, টি-রেক্স ঘণ্টায় ১৬–৪০ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতে পারত।
অবশ্য সেলার্স মনে করেন, ছোট থেরোপড ডাইনোসরদের দ্রুত দৌড়ানো খুব দরকার ছিল। তা না হলে ওরা নিজেরাই বড় থেরোপডদের শিকার হয়ে যেত!
তবে এখানেই থেমে নেই হিসাব। কারণ, সেলার্স এখনো সব ডাইনোসরের মডেল তৈরি করে পরীক্ষা করে দেখেননি। এটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটা মডেল তৈরি করতে প্রায় ৬ মাস থেকে ১ বছর লাগে। সব ডাইনোসরের মডেল বানাতে বছরের পর বছর কাজ করতে হবে। তবে সেলার্সের মতে, থেরাপডদের মধ্যে কোনো ডাইনোসরই সবচেয়ে দ্রুতগামী ছিল। কিন্তু কোনটা সেই দ্রুতগামী ডাইনোসর, তা জানতে হলে সব থেরাপডদের মডেল তৈরি করে পরীক্ষা করতে হবে।
তবে সবচেয়ে দ্রুতগামী ডাইনোসর কোনটি, তা কিন্তু এককথায় বলে দিতেই পারি। সেটা হলো পেরিগ্রিন ফ্যালকন। বর্তমানের পাখি যেহেতু ডাইনোসরদের উত্তরসূরি, তাই মজার ছলেই এই উত্তর দিতে পারো। এই পাখি ঘণ্টায় ৩২২ কিলোমিটার গতিতে শিকার ধরার জন্য ওপর থেকে ডাইভ দিতে পারে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স