বিশ্বের দীর্ঘতম সীমান্ত কোনটি
বিশ্বের দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ হাজার ৮৯১ কিলোমিটার। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, এটা বেশ সাধারণ একটা সীমান্ত। পরিষ্কার এবং একদম সোজা। কিন্তু একটু কাছে থেকে দেখলেই বুঝবে, এই আঞ্চলিক সীমানা আসলে অদ্ভুত রকমের জটিল। এর গভীরে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত সব ভুল আর মজার ইতিহাস।
আমেরিকা-কানাডা সীমান্তের দুটি প্রধান অংশ আছে। একটা হলো সেই লম্বা সীমান্ত, যার দক্ষিণে আছে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড। আরেকটা হলো উল্লম্ব সীমানা, যা আলাস্কা আর কানাডার মধ্যে মহাদেশের সুদূর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
অনুভূমিক সীমান্তের একটা বড় অংশ বেশির ভাগ বিশ্বমানচিত্রে অবিশ্বাস্য রকম সোজা দেখায়। বিশেষ করে লেক অব দ্য উডস থেকে বাউন্ডারি বে পর্যন্ত ২ হাজার ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশটা মনে হয় একদম নিখুঁতভাবে ৪৯তম সমান্তরাল অক্ষ রেখা বরাবর চলে গেছে। উত্তর গোলার্ধে পৃথিবীকে ঘিরে যে অনেকগুলো কাল্পনিক বৃত্ত আঁকা থাকে, ৪৯তম সমান্তরাল রেখা সেগুলোর মধ্যে একটি। পৃথিবীর নিরক্ষরেখাকে ধরে ওপরের দিকে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত ধরা হয়। নিরক্ষরেখা থেকে ৪৯ ডিগ্রি উত্তরে যে অক্ষাংশের রেখা আছে, তাকেই বলে ৪৯তম সমান্তরাল অক্ষ রেখা।
কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা একদমই আলাদা। মাটির ওপর দাঁড়িয়ে দেখলে দেখা যাবে, সীমানাটা আঁকাবাঁকা। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে আমেরিকা-কানাডা সীমান্ত আসলে ৪৯তম সমান্তরাল অক্ষ রেখা থেকে কয়েক শ মিটার সরে গেছে। সাধারণত এতে কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু মাঝেমধ্যে জটিলতা তৈরি করে।
একটা মজার উদাহরণ দিই। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে জানা গেল, কানাডার আলবার্টার কাউটস শহরটা আমেরিকার সীমানার ভেতরে প্রায় ৩৬৩ মিটার ঢুকে আছে! এমন ছোটখাটো ভুল পুরো সীমান্তজুড়েই ছড়িয়ে আছে। হিসাব করে দেখা গেছে, ভুল করে কানাডা আসলে আমেরিকার অংশের প্রায় ৬৭ বর্গকিলোমিটার জায়গা দখল করে বসে আছে।
কিন্তু কেন এমন ভুল হলো? এর কারণ লুকিয়ে আছে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে। তখন স্যাটেলাইট বা জিপিএস ছিল না। ছিল না ওই এলাকার কোনো ভালো মানচিত্রও। ১৮০৩ সালে আমেরিকা যখন লুইজিয়ানা কিনে নিল, তখন ব্রিটিশ আর মার্কিনরা মিলে ঠিক করল, নদীর প্রবাহ দেখে সীমানা ঠিক করবে। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে দেখা গেল, ওখানকার জমি এত সমতল যে নদীর পানি কোন দিকে গড়ায়, সেটাই বোঝা দায়!
ভেজাল এড়াতে তারা ঠিক করল, সোজা ৪৯তম প্যারালাল বরাবর দাগ টেনে সীমানা দেওয়া হবে। তারা জানতও না, ওই কাল্পনিক দাগের নিচে আসলে কী আছে? পাহাড়, নদী না জঙ্গল? লন্ডনে বসে ম্যাপ আঁকিয়েরা আন্দাজে দাগ টেনে দিয়েছিল এক অজানা দুনিয়ার ওপর।
পুরোনো আমলের সেই নড়বড়ে যন্ত্র আর আন্দাজে টানা দাগের খেসারত আজও মানুষকে দিতে হচ্ছে।
সেই ভুলের মাশুল দিতে তৈরি হলো অদ্ভুত সব দ্বীপ। ওয়াশিংটনের পয়েন্ট রবার্টসের কথাই ধরো। এটা আমেরিকার অংশ, কিন্তু আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই! নিজের দেশে যেতে হলে আমেরিকানদের আগে কানাডায় ঢুকতে হবে, তারপর সেখান থেকে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে পয়েন্ট রবার্টসে।
একই অবস্থা মিনেসোটার নর্থওয়েস্ট অ্যাঙ্গেলে। লন্ডনের ম্যাপ আঁকিয়েদের সামান্য ভুলে এই জায়গাটা কানাডা দিয়ে পুরোপুরি ঘেরা হয়ে গেছে। তবে ভালো খবর হলো, আমেরিকা আর কানাডা ঐতিহাসিকভাবে বন্ধু দেশ। সীমানা নিয়ে তাদের এই অদ্ভুত জগাখিচুড়ি অবস্থা থাকলেও, এটা নিয়ে তারা যুদ্ধ বাধায় না। মানচিত্রের ওই আঁকাবাঁকা দাগ আর ভুলগুলো তাই ইতিহাসের এক মজার কৌতুক হয়েই টিকে আছে।
সূত্র: আইএফএল সায়েন্স