বাঁশিওয়ালা

জসীমউদ্‌দীন তখন কলকতায়। ভাড়া বাড়িতে থাকেন। সেই বাড়িটাও স্পেশাল। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি বলে কথা। ভাড়া নিয়েছেন জিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কামরা। নিচতলায়। দোতলায় থাকেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর বাড়িটা ভাড়া নেওয়ার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকা। সব নবীন কবির জন্যই সেটা স্বপ্নের ব্যাপার। সত্যি সত্যিই পল্লিকবির জন্য সেই বাসা শুভ হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের খুব কাছে যেতে পেরেছিলেন তিনি।

তত দিনে নোবেল পেয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি। শুধু নিজের কবিতাতেই মগ্ন নন রবীন্দ্রনাথ। লালন ফকির, হাসন রাজাদের গান সংগ্রহ করে সেগুলো ছাপার ব্যবস্থা করছেন কলকাতায় বসে। সেগুলো নিয়ে লিখছেন নিজের মন্তব্য। দেশের বাউলসমাজের কাজ তুলে ধরছেন সারা দেশের মানুষের কাছে, বিশ্বের কাছে। জসীমউদ্‌দীনের তখন সাধ হলো এমন কিছু করার। গ্রামে এক বাঁশিওয়ালা আছে। নাম কালু মিয়া, দারুণ বাজান তিনি। লোকটা গরিব, তাই প্রতিভার মূল্যায়ন হলো না—এমনটাই মনে করতেন জসীমউদ্‌দীন। কালু মিয়াকে ডেকে নিয়ে বাঁশি শুনতেন। পদ্মার পাড়ে বসে, কিংবা পল্লির নির্জন মাঠে। সেই কালু মিয়াকেই কলকাতায় নিয়ে এলেন পল্লিকবি। বিখ্যাত থিয়েটার অভিনেতা শিশির কুমার ভাদুড়িকে শোনালেন কালু মিয়ার বাঁশি। ভালো লাগল তাঁর। নিজের অর্কেস্ট্রা দলে জায়গা দিলেন। কিন্তু অর্কেস্ট্রার লোকেরা ভালোভাবে নেননি ব্যাপারটা। গাঁয়ের এক অখ্যাত লোককে নিজেদের দলে জায়গা দিতে রাজি নন তাঁরা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল তৈরি হলো, পলিটিকস হলো। বিরক্ত হয়ে শিশির কুমার কালু মিয়াকে বিদায় বলে দিলেন।

জসীমউদ্‌দীন তখন ভাবলেন, কোনোভাবে তাঁর বাঁশির সুর যদি কবিগুরুকে শোনানো যায়, কবির যদি সেটা মনে ধরে, তাহলে হয়তো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবেন অখ্যাত বংশীবাদক। জসীমউদ্‌দীন আলোচনা করলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। তিনিও একমত। সবুজসংকেত পেয়ে পল্লিকবিও সেই বংশীবাদককে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। লোকটা তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন—এবার যদি তাঁর হিল্লে হয়!

সবাই মিলে ঠিক করলেন, সকালে অবন ঠাকুরের ঘরে বসে কালু মিয়া বাঁশি বাজাবেন। ওই সময় অবনীন্দ্রনাথের ভাই সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর যাবেন কবির সঙ্গে গল্প করতে। বাঁশির সুর শুনে কবির মন্তব্য কী, সেটাই এসে জানিয়ে দেবেন তিনি। পরদিন ভোরে পরিকল্পনামাফিক শুরু হলো কালু মিয়ার বংশীবাদন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ খুশি না হয়ে উল্টো বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বললেন, সাতসকালে এমন সুর মোটেও মানায় না। ফলে কালু মিয়ার বিখ্যাত বংশীবাদকও হওয়ার সাধ অপূর্ণই রয়ে গেল।