প্রাণীকে কখন সাহায্য করব
মোটাদাগে প্রাণীরা থাকে দুই পরিবেশে। একধরণের প্রাণী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বসবাস করে। যেমন কুকুর বা বিড়ালের মতো প্রাণীরা। এরা গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে পরিচিত। মানুষের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। বিভিন্ন অবস্থায় এই প্রাণীগুলোকে সহায়তা করতে হয়। আরেক দল প্রাণী আছে—বুনো। মানুষের ওপর বিভিন্ন কারণে নির্ভরশীল হলেও এরা বাস করে মানুষ থেকে দূরে। এড়িয়ে চলে মানুষকে। এমন প্রাণীর সংখ্যা অনেক। এই ধরো, বেজি, কাঠবিড়ালি, পাখি। এদের কেউ যদি কখনো বিপদে পড়ে, তাহলে কি এদের সাহায্য করা যাবে? কোথাও ঘুরতে গিয়ে যদি দেখো, একটা শালিকের ছানা গাছের নিচে পড়ে আছে, তেমন নড়াচড়া করছে না। আশপাশে কোথাও শালিকের মাকে দেখাও যাচ্ছে না। যদিও বুঝতে পারছ, গাছের ওপরে শালিকের বাসা আছে। তখন তুমি কী করবে?
ছোট্ট কোনো পাখির ছানা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলে যে কেউ সেটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে। পাখির ছানা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলে সবার মনেই মায়া জেগে ওঠে। কিন্তু দয়ালু হওয়া কি প্রাণীর জন্য ভালো, নাকি ক্ষতিকর? যদি কোনো বন্য প্রাণীর ছানা আহত অবস্থায় পড়ে থাকে, তখন আসলে কী করা উচিত? আবার ধরা যাক, বনে বেড়াতে গিয়ে একটি হরিণছানাকে একলা অবস্থায় পেল কেউ। তারপর তার মায়ের কাছে ফেরত দেওয়ার জন্য মাকে খুঁজতে থাকল। সহজেই কি মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে? আর খুঁজে পেলেও হরিণের মা কি ছানাটিকে গ্রহণ করবে? আবার মা হরিণটি যদি বাঘের পেটে চলে যায়, তখন কি একলা একটি হরিণছানা বনে টিকে থাকতে পারবে?
পাখি বা হরিণছানাকে সবাই সাহায্য করতে চায়। বড় কোনো প্রাণীকে যতটুকু সাহায্য করতে ইচ্ছা করে, ছোট কোনো প্রজাতির ছানা দেখলে সাহায্য করার ইচ্ছা জাগে বেশি। কারণ, ছোট ছানারা বেশি ‘কিউট’ আর নির্ভরশীল। একটি প্রাণী যখন সত্যিকারের বিপদে পড়ে, তখন তা বুঝতে পারা কঠিন। সাহায্য করতে গিয়ে প্রাণীটির ক্ষতি হবে কি না, তা–ও বোঝা সহজ না। সবার জন্যই বিষয়টি কঠিন। এমনকি প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্যও বিষয়টি সহজ নয়।
কোনো বন্য প্রাণীকে আহত অবস্থায় দেখতে পেলে—
দূর থেকে দেখতে হবে
কোনো প্রাণী বিপদে আছে বুঝতে পারলে শুরুতেই কাছে যাওয়া যাবে না। দূর থেকে আগে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। হুট করে কোনো ছানা বা বাচ্চা প্রাণীর কাছে গেলে সেটা ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। প্রাণীটির বাবা-মা হয়তো প্রাণীটাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছিল, ভয় পেয়ে প্রাণীটাকে পরিত্যাগও করতে পারে তারা।
খরগোশ এবং হরিণছানার মতো প্রাণীকে বাবা-মা দীর্ঘ সময় এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে চলে যায়। মূলত উঁচু ঘাস বা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। খাবারের খোঁজে যায় তারা। তারা সম্ভবত ঝামেলা কমাতে একলা ফেলে যায় ছানাদের। কারণ, শিশুরা সঙ্গে থাকলে শিকারির চোখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এই ছানাগুলো দুর্বল হওয়ায় অপ্রয়োজনীয় চড়ে বেড়ানোয় অযথা তাদের শক্তি খরচ হবে।
সরীসৃপ সাধারণত জন্ম থেকেই নিজেরা নিজেদের মতো চলে। এদের আসলে মানুষের সাহায্যের তেমন প্রয়োজন হয় না। তাই এদের থেকে দূরে থাকতে হয়। বড় কোনো বন্য প্রাণী থেকে সম্ভব হলে ২৫ গজ দূরে থাকা উচিত। এমনকি চিড়িয়াখানায়ও সেলফি তোলার জন্য এদের খুব একটা কাছাকাছি যাওয়া উচিত না।
তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যদি দেখা যায় রাস্তায় একটি কচ্ছপ পার হচ্ছে, তখন চলাচল বন্ধ রেখে অপেক্ষা করা ভালো। চাইলে কচ্ছপটাকে রাস্তা পার করিয়েও দেওয়ায় যায়। তবে সুস্থ থাকতে হলে দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
প্রাণীটি আহত হয়েছে কি না? কতক্ষণ ধরে একা আছে?
যখন একটি প্রাণীকে আহত অবস্থায় দেখা যায়, তখন সবচেয়ে ভালো কাজ হলো প্রাণী উদ্ধারকারী দলের হটলাইনে ফোন করা। বন বিভাগ, পশু হাসপাতাল বা নিবন্ধিত স্থানীয় বন্য প্রাণী পুনর্বাসনকারীকে খবর দিয়ে প্রাণীর অবস্থা জানানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যদি প্রাণীটি আহত না হয়, তাহলে প্রাণীটির বাবা-মা ফিরে আসে কি না, তা দেখার জন্য একদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আহত প্রাণীকে কখনোই হত্যা করার চেষ্টা করা যাবে না। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, ভেবে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করাও ঠিক হবে না। কারণ, মানবিকভাবে সবার পক্ষে এই কাজ করা কঠিন। এ ছাড়া এতে আইনও ভঙ্গ করা হবে।
মানুষের সংস্পর্শে এলে মা কি বাচ্চাদের প্রত্যাখ্যান করে?
অনেকের মধ্যে প্রবলভাবে এই ধারণা আছে, কোনো পশু-পাখির বাচ্চাকে মানুষ ধরলে তার মা তাকে পরিত্যাগ করে। পাখিদের নিয়ে এ ধারণা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। বিজ্ঞানীরা এমন কোনো প্রাণীর প্রজাতির কথা নিশ্চিত করে বলেননি, যেটি শুধু মানুষের সংস্পর্শের কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়।
প্রাণীর নানা কারণে একটি ছানাকে ত্যাগ করতে পারে। প্রাণীর পরিবার থেকে দূরে সরে যাওয়া, খাবারের অভাব ও অন্যান্য চাপ এগুলো হলো অন্যতম কারণ। প্রাণীর মা যদি কোনো কারণে চাপে থাকে এবং কেউ গিয়ে তার বাচ্চাকে বিরক্ত করে, তাহলে মা প্রাণীটি নিজের ক্ষতি কমানোর জন্য চলে যেতে পারে।
কখন সাহায্য করতে হবে?
এই লেখায় ওপরে কচ্ছপকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। এমন অন্যান্য পরিস্থিতিতে মানুষ নিরাপদে চলে যেতে বন্য প্রাণীকে সাহায্য করতে পারে। দুর্ঘটনাক্রমে কোনো গাছে থাকা পাখির বাসা থেকে বাচ্চা পাখি পড়ে যেতে দেখলে পাখিটিকে তার বাসায় ফিরিয়ে দেওয়া যায়। তবে পড়ে যেতে না দেখলে এই পদ্ধতি কাজে না–ও লাগতে পারে। পাখিরা তাদের বাচ্চাদের গন্ধ দিয়ে চেনে না। তাই পাখির বাচ্চাকে যদি আমরা ধরি, তাতে তার বাবা-মায়ের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। তবে পাখিদের কেবল তখনই বাসায় ফিরিয়ে দেওয়া উচিত, যখন তারা একেবারেই ছোট। যেগুলোর পালক উঠেছে খুব কম, এখনো হাঁটতে, ওল্টাতে বা পা দিয়ে আঙুল শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে পারে না।
যেগুলো পায়ের আঙুল দিয়ে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে সক্ষম, সেগুলোকে সব সময় যেখানে আছে, সেখানেই ফেলে রাখা উচিত। এদের বাবা-মাকে আশপাশে না দেখা গেলেও এরা হয়তো আছে। হয়তো তাদের বাচ্চার ওড়ার ট্রেনিং চলছে। অথবা অন্য বাচ্চাদের যত্ন নিচ্ছে।
একটি ছোট্ট প্রাণী মরে যাচ্ছে বা অন্য কোনো শিকারি প্রাণীকে খেয়ে ফেলছে, এমন দেখলে মন খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু হতে পারে অন্য প্রাণীটি এই ছোট্ট প্রাণীকে খেয়ে তার প্রজাতিকে রক্ষা করছে। এমন ঘটতে দেখা কষ্টকর হলেও একটি প্রাণী অন্য প্রাণীর শিকারে পরিণত হওয়া প্রকৃতির অংশ। মোটকথা, কোনো প্রাণীকে বিপদে পড়তে দেখলে আগে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাদের।