কথা বলে ভাতশালিক

ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান ও শিপলু খান

পুকুরের চার পাড়জুড়ে সারি সারি নারকেলগাছ, ফাঁকে ফাঁকে হিজলগাছও আছে বেশ কয়েকটা। হিজলগাছগুলোয় কাত করে বাঁধা মাটির কলস ও ঠিলা। বাড়ির ছেলেপুলে মৌচাক পাওয়ার আশায় ওগুলো বেঁধে রেখেছিল মাঘ মাসে। ভেতরে খেজুরের ঝোলা গুড় ও পুরোনো মধু মেখে দিয়েছিল ঘষে ঘষে, মধু ও গুড়ের সুগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে মৌমাছি ঠিলা-কলসের ভেতরে বসে, চাক গড়ে। প্রতিবছরই দু-পাঁচখানা মৌচাক থেকে দু-পাঁচ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু ফাল্গুন মাস আসতে না আসতেই ঠিলা-কলস দখলে নিয়ে বাসা বানায় ভাতশালিক-ঝুঁটিশালিক-দোয়েল-কাঠশালিক ও কোটরে প্যাঁচা। ছেলেমেয়েরা প্রতিবছরই তাড়াতে চায়, সব ক্ষেত্রে সফল হয় না। তাদের ধারণা, দোয়েল-শালিক বাসা না বাঁধলে মৌচাক বেশি হতো, মধুও পাওয়া যেত বেশি। চড়ুই হলো নচ্ছার পাখি। বাসার উপকরণ ফেলে দিলেও বেহায়ার মতো আবারও উপকরণ আনে। তবে বাড়ির ছেলেপুলের ভেতরে দুই মতের দ্বন্দ্ব আছে। কিছু ছেলেমেয়ে চায়, ভাতশালিক বাসা বাঁধুক, তাহলে ছানা পোষা যাবে, ভাতশালিক ময়না-টিয়ার মতো কথা বলতে পারে। অন্য মত হলো, বেশি মধু দরকার। তবে শেষ পর্যন্ত রফা হয়, পাখির পাশাপাশি মৌমাছিও সুখে থাকে।

ফাল্গুনের মাঝামাঝিতে এক জোড়া ভাতশালিক হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে বাসা বানানোর জায়গা। পাচ্ছে না কোথাও। অবস্থা এমন যে ‘বাসা খালি নাই’ বা ‘সিট খালি নাই’ অবস্থা। এই বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে সুপারিবাগানের ভেতরে আছে একটি পরিত্যক্ত-পুরোনো বাড়ি। ওই একতলা ভবনের ভেন্টিলেটরসহ সব কোটর ও ফোকরে ‘সিট খালি নাই’ নোটিশ যেন টাঙানো। অর্থাৎ টিয়া-ভাতশালিক-কোটরে প্যাঁচা দখলে নিয়ে নিয়েছে। এই শালিক জোড়া বা দম্পতি ওই ভবনের একটি কোটর থেকে এক জোড়া টিয়াকে হটিয়ে বাসা দখল করতে প্রবল চেষ্টা করেছিল। ঝগড়াঝাঁটি! মারামারি! হাঁকাহাঁকি! না, নাছোড়বান্দা টিয়া দখল ছাড়েনি। ছাড়ে কীভাবে! বাসায় যে ডিম রয়েছে ছয়টি! ভাতশালিক দুটি হামলা করেছিল দলবলসহ। টিয়াও দলবদ্ধ পাখি। কান–ঝালাপালা ডাকাডাকি ও পাল্টাপাল্টি আক্রমণেও দমেনি টিয়াগুলো।

এদিকে শালিক দুটি তো বাসা বানানোর জন্য এখন আরও বেপরোয়া। এই পুকুরপাড়ে এসে ওগুলো পেছনে লাগল এক জোড়া কোটরে প্যাঁচার। প্যাঁচা তো নিশাচর পাখি। দিনে বসে থাকে মরা একটি নারকেলগাছের কোটরে। আরও কয়েকটি মরা নারকেলগাছের কোটরে-ফোকরে টিয়াগুলোর বাসা। অতএব কোটরে প্যাঁচা দুটিকে টানা আড়াই দিনের প্রচেষ্টায় উৎখাত করতে পারল ভাতশালিক দুটি। তারপর জরুরি ভিত্তিতে দুটিতে মিলে চার দিনেই উপকরণ এনে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ল ছয়টি, অবশ্য সময় নিল। পাঁচ দিনে ছয়টি ডিম পেড়ে শুরু হলো পালাক্রমে ডিমে তা দেওয়া। তাড়াহুড়ো করে বাসা বানানো যায়, ডিম কি ইচ্ছেমতো ফোটানো যায়! ডিম ফুটে ওই ৫ দিনেই ৬টি ছানা বেরোল, অর্থাৎ ১৯ দিন তা দেওয়ার পর প্রথম ছানাটি ডিম ফুটে বের হয়, তারপর ৫ দিনে ৬টি ছানা। জরুরি ভিত্তিতে বাসা বানানো যায় পাঁচ দিনে, যদিও লাগে ছয়-আট দিন। কিন্তু ছানাগুলোকে তো আর জরুরি ভিত্তিতে টেনেটুনে বড় করা যায় না। মা-বাবা সারা দিন পালা করে খাবার খাইয়েও ‘খাই খাই’ ছানাগুলোর খিদে মেটাতে হিমশিম খেয়ে যায়, ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ে। আরও ১৭ দিনের মাথায় ছানাগুলো যখন ‘উড়ু উড়ু’ হলো, তখন একটি ছেলে গাছ বেয়ে উঠছে যখন, তখনি একটি শালিক বেজায় চেঁচামেচি জুড়ে দিয়ে তেড়ে এল। ডাইভ মেরে আক্রমণ করতে চাইল ছেলেটিকে। ছেলেটি ভয়ে নেমে এল তাড়াতাড়ি। ততক্ষণে এসে গেছে আরও শালিক, ওগুলোর সম্মিলিত চেঁচামেচি-শোরগোলে মুখর চারদিক। যেন ডাকাত পড়েছে ওখানে। ভাতশালিক লড়াকু, সাহসী ও কুশলী পাখি, ছানা রক্ষার জন্য জীবন দিতেও রাজি ওগুলো। বাসার ত্রিসীমানায় যদি আসে বেজি-কুকুর-পোষা বিড়াল-বনবিড়াল-খ্যাঁকশিয়াল বা কোনো শিকারি পাখি, তাহলে ‘ধর-মার-কাট’ শব্দে জোরালো স্লোগান দিতে দিতে আক্রমণ করে শত্রুকে। ছেলেটি যা পারল না, তাই করে দিল বাড়ির গৃহকর্মী গণি মিয়া। চারটি ছানা পেড়ে আনল শালিকের গালাগাল ও আঁচড়-ঠোকর খেয়ে। চারটিকে পুষবে চারজন। দেশে বন্য প্রাণী আইনে এগুলো ধরা-মারা ও পোষা অপরাধ হিসেবে গণ্য।

ঝগড়াটে স্বভাবের, অনবরত ডাকাডাকি করা ও লড়াকু-সাহসী ভাতশালিকের ইংরেজি নাম Common myna। বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres tristis। দৈর্ঘ্য ২৩ সেমি। ওজন ১১০ গ্রাম। একনজরে মেরুন–বাদামি চঞ্চল পাখি। মাথার তালু ও ঘাড়-গলা চকচকে কালো। পা-ঠোঁট ও চোখের ওপরটা টকটকে হলুদ। ডানায় আছে চওড়া সাদা পট্টি। কালচে লেজের আগাটাও সাদা। কণ্ঠস্বর ধাতব, জোরালো, ‘চক্চাকি-চাকচাকি-চাকচরি’ ধরনের। অন্যান্য পাখি ও প্রাণীর ডাক এগুলো অনুকরণ করতে পারে, এভাবে শত্রুকে বিভ্রান্ত যেমন করে, তেমনি মজাও করে থাকে।

ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান ও শিপলু খান

ভাতশালিকের মূল খাদ্য নানা রকম ফল, শস্য, শস্যবীজ, ঘাসফড়িং, পোকামাকড়, টিকটিকি, ছোট ব্যাঙের ছানা, শুঁয়াপোকা ও কেঁচো। একটি কেঁচোর দুই প্রান্ত মুখে ধরে যখন আনাড়ি ছানাগুলো টানাটানির খেলায় মাতে, তখন দেখতে লাগে দারুণ! শিমুল–মান্দারসহ বড় বড় ফুলের মধু যেমন পান করে এগুলো, তেমনি পান করে তাল, খেজুর ও গোলগাছের রস। গবাদিপশু, যেমন ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষের শরীর ও কানের ভেতরের ‘পেট পুরে রক্ত পান করা’ এঁটুলি পোকা ও বিষাক্ত ডাঁশমাছি খায়। বহু ক্ষেত্রেই গবাদিপশুগুলো কাত হয়ে শুয়ে পড়ে, ভাতশালিকগুলো কানের ভেতরে ঠোঁট চালিয়ে এঁটুলি খায়। আবার বর্ষাকালে গরুর নাকে ‘ছিনে জোঁক’ যখন ঢুকে পড়ে ও গরুতে হাঁচি দিতে শুরু করে, তখন হাজির হয় ভাতশালিক। ঠুকরে জোঁক বের করে প্রায় সময়ই গিলে নেয়। মূলত মাঠবাগানের পাখি তো! তাই বর্ষাকালে মাঠঘাট ডুবে গেলে এগুলো গেরস্তবাড়ির আঙিনায় আসে। নেচে নেচে কী সুন্দর যে শৈল্পিক হাঁটা হাঁটে! ভাত, ডাল, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট খায়। সেদ্ধ করা পাকা মরিচ এগুলোর অতীব প্রিয়। সেদ্ধ রসুনও খায়। গবাদিপশু ও কৃষকের ফসলের খেতের পরম বন্ধু ভাতশালিকের বাসায়ও চুরি করে ডিম পাড়ে কোকিল। ‘শালিক মাতার কোকিলছানা’ গ্রামবাংলায় নজরে পড়ে। এগুলোর ডিম-ছানার প্রধান শত্রু দাঁড়াশ সাপ, অন্যান্য ডিমখেকো সাপসহ বনবিড়াল, গুইসাপ ও কয়েকটি শিকারি পাখি। তবে ভাতশালিকের কবলে পড়লে এগুলো নাস্তানাবুদ হয়ে পালায়।

ঢাকা শহরসহ দেশের সব শহর-বন্দর, তথা বন, বাগান ও গ্রামাঞ্চলে দেখতে পাওয়া ভাতশালিক রাত কাটায় ‘শালিক বাড়িতে’। একটি নির্দিষ্ট গাছ বা ঝোপে সন্ধ্যা থেকে জড়ো হতে থাকে শালিকগুলো, সেকি কোলাহল–কলরব! ‘শালিকবাড়ি’ দেশের সব অঞ্চলেই আছে।

চার-ছয় মাস বয়সে কথা বলতে শেখা আলাদা আলাদা তিনটি বাচ্চা
ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান ও শিপলু খান

তিন–চার মাস বয়স থেকে কথা বলতে শেখে। পোষা শালিকের খাঁচার সামনে আয়না ধরলে আয়নায় প্রতিফলিত প্রতিবিম্বকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে প্রবল আক্রোশে আক্রমণ করতে চায়। মাটিতে পায়ে পা আঁকড়ে ভাতশালিক লড়াইয়ে যেমন মাতে, তেমনি মাতে আনন্দ খেলায়ও।

পোষা ভাতশালিক ছেড়ে দিয়েও পোষা যায়। ওগুলো মাঠ-ঘাট-বন-বাগানে গিয়ে বুনো শালিকের সঙ্গে মেশে। কিন্তু সন্ধ্যা হলে বাড়িতে ফিরে এসে নিজের খাঁচায় ঢুকে পড়ে। জাতীয় পাখি পোষা দোয়েলও একই কাজ করে। দোয়েল ও ভাতশালিকের ভেতর প্রবল প্রবণতা রয়েছে অপরের বাসা দখল করার। এ দুই পাখি কখনো কখনো মাঠে জলজমা ফসলের খেতে গিয়ে ‘কাঁকড়ার সাঁড়াশিতে’ পা আটকে লম্ফঝম্ফ করে ও চেঁচায়। আপেল শামুকের হাঁ করা মুখে পা ফেলে ‘শামুকের ফাঁদে’ পড়ে যায়। শামুক তো ভয়ে তার মুখের কপাট বা শক্ত খোলাটা দেয় বন্ধ করে। বোঝো এবার ছাড়িয়ে! মিস্ত্রি পাখি কাঠঠোকরাকে পছন্দ করে শালিকেরা। করবে না! গাছে তো এগুলোই গর্ত খুঁড়ে বাসা বানানোর জায়গা করে দেয়!