বিদায় সৌম্য, প্রিয় 'ফ্যামিলি মেম্বার'!

ছবি: শাশ্বত সৌম্যর ফেসবুক থেকে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ৪.০ সিজিপিএ নিয়ে সিএসই-তে প্রথম হয়েছিলেন সৌম্য। ২০২১ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ব্র্যাক ও বুয়েটে শিক্ষকতা করেন কয়েক মাস। এরপর পিএইচডি করতে এমআইটিতে যান। এমআইটিতে পিএইচডি প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। গত কয়েকদিন ধরে কানাডা-আমেরিকার কিছু প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ওপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তবে হঠাৎ চলে গেলেন তিনি। ৩ জুলাই, সোমবার কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ওকানাগান লেক থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন কিশোর আলোর সাবেক নির্বাহী সম্পাদক সিমু নাসের।

সৌম্যর সাথে আমার যখন পরিচয় তখন সে তার নিজের পরিচয় নিয়ে ভালোই ভ্যাজালে আছে। সে ব্র্যাকের নাকি বুয়েটের ফ্যাকাল্টি এইটা সে ক্লিয়ার করতে পারে নাই। মনে হয় সে তখন ট্রানজিশনের ভেতর ছিলো। আবার কয়েকদিন পর এমআইটিতে যাবে পিএইচডি করতে সেইটাও মনে হয় চেপে গেছিল।

ঢাকায় আমার বাসার রাত্রিকালীন আড্ডায় সে এসেছিলো কয়েকবার। প্রতিবারই একদম যথাসময়ে হাজির সে। খুবই শান্ত ও ভদ্র একটা বাচ্চা। নিজের জ্ঞান জাহির করার কোনো তাড়না নাই। ফলে সে সমেত আরও কয়েকজন মিলে দারুণ কিছু আড্ডা দিয়েছিলাম আমরা। এরপর সে আমাকে তার 'ফ্যামিলি মেম্বার' করে নিল।

স্পটিফাইয়ের প্রিমিয়াম সার্ভিসে পেমেন্ট নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম তখন। প্রতিমাসে কী জানি একটা ভেজাল লাগে। সৌম্য তখন স্পটিফাইয়ের ফ্যামিলি মেম্বারশিপ নিয়েছিল। আমার পেমেন্ট ঝামেলা জানতে পেরে আমাকেও সে 'ফ্যামিলি মেম্বার' হিসেবে অ্যাড করে নিলো সেখানে। সে ক্রেডিট কার্ড ম্যানেজ করে আমি তাকে মাস শেষে বিকাশ করি। অনেকমাস এভাবে চলার পর তার কার্ডেও কী জানি ঝামেলা হলো। এদিকে একই বাসায় থাকি না বলে আমার মেম্বারশিপেও স্পটিফাই ব্যাপক ঝামেলা শুরু করলো। সেগুনবাগিচার একটা ঠিকনা ব্যবহার করতাম আমরা সবাই মিলে। কিন্তু স্পটিফাই বুঝে ফেললো আমি সেগুনবাগিচা এলাকায় থাকি না। আমি সেই ঝামেলা নিতে না পেরে অ্যাপল মিউজিকে শিফট করলাম। কিন্তু সৌম্যর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হলো না।

আমার সাথে এরপর আরও কয়েকবার দেখা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু ব্যাটেবলে মিলছিলো না। একবার আমি কথা দিয়েও দেখা করতে পারলাম না তার 'বিদায় বাংলাদেশ' খাওয়াদাওয়াতে। সে পিএইচডি করতে চলে আসবে এমেরিকায়। সে উপলক্ষ্যে পার্টি। কিন্তু আমার তখনই কী একটা কাজে ঢাকার বাইরে যেতে হলো তাই শেষ দেখাও হলো না।

ফেসবুকে তার জীবনচক্র চলছিলো আর দশটা মানুষের মতোই। দেখতাম। বিয়ে নিয়ে বলেছিলাম, অন্তত প্রথম বিয়েটা কর। করলো, ডিভোর্সও হলো, পিএইচডিও তার শেষের পথে। এখন সে কোথায় জয়েন করবে সেটা নিয়েই মনে হয় ভাবছিলো। সর্বশেষ স্ট্যাটাসে দেখেছিলাম, এমেরিকার সিস্টেম নিয়ে সে ব্যাপক ক্ষুব্ধ। সে আর এমেরিকায় ফিরতে চায় না। ক্যানাডার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই জয়েন করতে চায়। সেটা দেখে আমি দিয়াকে কালকেই বলছিলাম, দেখ ট্রাম্পের কারনে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়েরা এমেরিকা ছাড়ছে, ক্যানাডার উচিত এই সুযোগ নেওয়া।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সৌম্য নাই। ক্যানাডাতে সে এসেছিলো এখানকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনে কথা বলতে। ভ্যাঙ্কুবারের কোনো এক লেকের পাড়ে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এখনও পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে অসুস্থতাজনিত মৃত্যু। কিন্তু এত ভদ্র, ব্রিলিয়ান্ট বাচ্চারা কেন এত দ্রুত চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, সৌম্য অচিরেই পৃথিবীতে শোরগোল তোলার মতো কিছু একটা করে ফেলবে। কিন্তু সে তার পরিচিত সবাইকে অবিশ্বাস্য শোরগোলের মধ্যে রেখে নিজেই চলে গেল। এর কোনো মানে হয়—বাষ্পীভূত চোখে দূরে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।

বিদায় সৌম্য, প্রিয় ভদ্র বাচ্চা—বিদায় প্রিয় 'ফ্যামিলি মেম্বার'!

আরও পড়ুন