শব্দ-সমুদ্র ২

অলংকরণ: নাইমুর রহমান
বাংলা পড়তে গেলে এমন অনেক শব্দের সম্মুখীন হতে হয়, যে শব্দগুলো আমরা কখনো শুধু পড়েই যাই কিন্তু গভীরের অর্থ জানি না। অথচ, সেই শব্দগুলোতে আছে সমুদ্রের মতো ব্যাপ্তি আর গভীরতা। ডুবুরি হয়ে শব্দ-সমুদ্রে নেমে তুমিও পেতে পারো মূল্যবান অর্থ-রত্ন।

অকালকুষ্মাণ্ড

তুমি শ্রেণিকক্ষে আছ। তোমার বন্ধু স্যারকে বারবার প্রশ্ন করে বিরক্ত করে ফেলেছে। এবার তোমার স্যার বন্ধুটির উদ্দেশে বললেন—

: ‘তুমি তো একটি অকালকুষ্মাণ্ড! এই প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করে?’

শ্রেণিকক্ষের সবাই হেসে উঠল।

এবার তোমার বন্ধুটি স্যারকে আবার প্রশ্ন করে,

: ‘স্যার, অকালকুষ্মাণ্ড কী?’

সত্যিই তো, অকালকুষ্মাণ্ড কথাটি আমরা বাগ্‌ধারায় সবাই পড়েছি। কিন্তু সবাই কি এর অর্থ জানি?

এখানে দুটো শব্দ আছে ‘অকাল’ আর ‘কুষ্মাণ্ড’। ‘অকাল’ হলো ‘অসময়’ আর ‘কুষ্মাণ্ড’ হলো ‘কুমড়া’—বাজারে যে কুমড়া পাওয়া যায়, আমরা সবজি হিসেবে খাই, সেই কুমড়া। তাহলে ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ হলো অসময়ের কুমড়া। ভালোই তো! অসময়ে খাওয়ার জন্য কোল্ড স্টোরেজে গাজর, টমেটো ইত্যাদি রেখে বেশি দামে আমাদের কাছে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। কিন্তু না। ‘অকালকুষ্মাণ্ড’-এর অর্থ বাজারে পাওয়া সেই অসময়ের কুমড়া নয়। সেটি হলে তো এর দাম বেশি হতো; শব্দটির অর্থও হতো প্রশংসাসূচক।

অকালকুষ্মাণ্ডের একটি পৌরাণিক ব্যাখ্যা আছে এবং সেটির প্রয়োগের কারণেই তোমার বন্ধুকে স্যার যখন ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ বলেন তখন সবাই হেসে ওঠে। পুরাণে এর অর্থ ‘অনিষ্টকারী’ বা ‘দুষ্ট’। ‘মহাভারত’-এ দুই পক্ষ; পাণ্ডব ও কৌরব। পাণ্ডবপক্ষ ধর্মাচারী ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে। আর কৌরবপক্ষ পাপাচারী ও অন্যায় কর্ম করে। কৌরবপক্ষের জন্ম বা সৃষ্টি না হলে ‘মহাভারত’-এর সেই যে কুরুক্ষেত্রের লড়াই, সেটিও হতো না। কৌরবপক্ষের জন্ম হয়েছিল ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ থেকে।

‘মহাভারত’-এ আছে, গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা সুকৃতীর জন্য ব্যাসদেবের কাছ থেকে ‘শতপুত্রের মা’ হওয়ার আশীর্বাদ লাভ করেন। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তিনি গর্ভবতী হন কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তার সন্তান জন্মগ্রহণ করে না। বিচলিত হলে গান্ধারীর গর্ভপাত হয়। আদতে এটি ছিল অকালে গর্ভপাত। গান্ধারী যেহেতু আশীর্বাদধন্য ছিলেন, সেহেতু অন্যের মতো স্বাভাবিক সময় তার জন্য প্রযোজ্য নয়; এটি গান্ধারী বুঝতে পারেননি। অকালে তিনি কুষ্মাণ্ড আকার বা কুমড়ার মতো মাংসপিণ্ড প্রসব করেন এবং সেটি একটি পাত্রে রেখে বর্তমানের টিস্যু কালচারের মতো জন্ম দেওয়া হয় এক শ এক সন্তানের। আশীর্বাদগুণে তাদের মধ্যে এক শ জন পুত্র ও একজন কন্যা হিসেবে জন্ম নেয়। পুত্রদের নাম হয়: দুর্যোধন, দুঃশাসন, দুঃসহ, দুঃশল, দুর্মুখ ইত্যাদি এবং কন্যার নাম দুঃশলা। এই দুর্যোধনরা কৌরব হিসেবে পরিচিত। তাদের কুকর্মের জন্য নিজেদের কুরুকুলই বিনষ্ট হয়ে যায়। সেই পুরাণসূত্রে আজ কুকর্মকারী বা দুষ্টদের ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ বলে ভর্ৎসনা করা হয়।

অকালবোধন

তুমি তোমার স্যারের সঙ্গে আগামীকাল দেখা করবে বলে তাঁর সঙ্গে কথা আছে। কিন্তু তুমি ভাবলে, যাচ্ছি তো স্যারের বাড়ির সামনে দিয়েই। আজই দেখি না, স্যার আছেন কি না! তোমাকে স্যার খুব স্নেহই করেন। স্নেহের অধিকার নিয়ে তুমি স্যারের বাড়িতে গেলে। তোমাকে দেখেই স্যার বলে উঠলেন,

: ‘তোমার তো আসবার কথা আগামীকাল। তা এই অকালবোধনের কারণ কী?’—এমন বাগ্‌ধারা কথায় ও পড়ায় অনেক শোনা ও দেখা যায়। কিন্তু এই অকালবোধন কী? প্রথমেই জেনে নিই, ‘অকালবোধন’ শব্দমূলের অর্থ কী? ‘অকাল’ হলো অসময় আর ‘বোধন’ অর্থ জাগানো বা ঘুম ভাঙানো। তাহলে, তোমার স্যার কি এটি বুঝিয়েছেন যে, তিনি ঘুমিয়েছিলেন আর তুমি এসে তাঁর ঘুম ভাঙিয়েছ? না। তিনি কী করছিলেন সেটা এখানে বড় ব্যাপার নয়। তুমি আগামীকাল আসবে বলে আজ এসেছ অর্থাৎ আগে এসেছ—এটিই তিনি বুঝিয়েছেন ‘অকালবোধন’ শব্দ দিয়ে। কারণ ‘অকালবোধন’ হলো একটি পৌরাণিক বিষয়, যার সঙ্গে সময়ের আগে কাজটি করার ব্যাপার যুক্ত। কী সেই পুরাণকথা?

সূর্যের গতি অনুসারে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। উত্তরায়ণ হলো মাঘ থেকে আষাঢ় (ডিসেম্বর থেকে জুন) এবং দক্ষিণায়ন হলো শ্রাবণ থেকে পৌষ (জুন থেকে ডিসেম্বর) মাস পর্যন্ত। ভারতীয় পুরাণ অনুসারে দেবকুল দক্ষিণায়নকালে সুপ্ত অবস্থায় থাকেন এবং উত্তরায়ণকালে থাকেন জাগ্রত অবস্থায়। শারদীয় আশ্বিন মাস দক্ষিণায়নকাল। কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’-এ উল্লেখ আছে, শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের জন্য দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হন এবং তাঁকে অসময়ে (শরৎকাল) জাগ্রত করে পূজা করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও শরৎকালে দুর্গাপূজা করার প্রচলন হয়। এই পূজাই অকালবোধন।

অক্রূর-সংবাদ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী (১৯২৯) উপন্যাস খুবই বিখ্যাত। বাংলা ধ্রুপদি পর্যায়ে যে কয়েকটি উপন্যাস উন্নীত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পথের পাঁচালী একটি। সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাস অবলম্বন করে একটি বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র বানিয়েছেন ১৯৫৫ সালে। উপন্যাসে তিনটি পর্বের মধ্যে একটির নাম হলো অক্রূর-সংবাদ। এই পর্বটি উপন্যাসের ৩০ থেকে ৩৫ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত। এখানে অপুদের কাশীর জীবনযাপন, পিতা হরিহরের মৃত্যু, পরে তাদের নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে আসার কাহিনি বর্ণিত। সম্পূর্ণ বাঙালি জীবন-পরিমণ্ডলে রচিত উপন্যাসটির একটি পর্বের নাম এমন কেন?

আদতে এখানে পৌরাণিক ভাবটি নেওয়া হয়েছে, অন্য কিছু নয়। ‘মহাভারত’-এ যদুবংশে জন্মগ্রহণকারী অক্রূরকে (যিনি ক্রূর হন না) অত্যাচারী কংস দূত হিসেবে বৃন্দাবনে পাঠান, যাতে তিনি কৃষ্ণ ও বলরামকে কৌশল করে তার কাছে নিয়ে আসেন। কংসের ইচ্ছা, কৃষ্ণ ও বলরামকে তিনি হত্যা করবেন। কিন্তু ধর্মনিষ্ঠ অক্রূর বৃন্দাবনে গিয়ে তাদের কাছে কংসের অত্যাচারের কথা তুলে ধরেন এবং মথুরাতে স্নিগ্ধ পরিবেশ সংস্থাপনের আহ্বান জানান। কৃষ্ণ ও বলরামের প্রতি নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসার আহ্বান ছিল অক্রূরের; পথের পাঁচালীতেও অপু ও অপুর মা সর্বজয়া কাশী থেকে ফিরে গেছে জন্মভূমি নিশ্চিন্দিপুরে। উভয় ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে জন্মভূমির প্রতি টান, ভালোবাসা—সংযোগটা এখানেই।