জিন দেবে উত্তর

বংশগতিবিদ্যার জনক গ্রেগর জোহান মেডেল

একটা গমবীজ থেকে গমগাছই কেন হয়, যব বা ভুট্টা কেন নয়? ঘোড়া থেকে কেন আরেকটা একই রকম ঘোড়ার ছানাই জন্মায়? সন্তানেরা দেখতে তো মা-বাবার মতোই হয়, তবু সব বাচ্চাই কেন একই বৈশিষ্ট্যগুলো পায় না? আবার দাদা-দাদি, নানা-নানির কিছু বৈশিষ্ট্যও কেন দেখা যায় নাতিপুতির মাঝে! সভ্যতার শুরু থেকে এহেন কত প্রশ্নই জেগেছে মানুষের মনে। আর এসব কিছুর উত্তর আছে সব জীবের জীবনের ভিত্তি ‘জিন’-এ।

বংশগতির ধারক ও বাহক হলো ডিএনএ, যা থাকে ক্রোমোজমে। ডিএনএর কিছু অংশ হলো জিন, যা বংশগতির নিয়ন্ত্রক। কোনো জীব কী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে, তা ঠিক করে দেয় তার জিনগুলো। বংশগতির ধারায় এক প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মকে নিজের জিনগুলোর প্রতিলিপি প্রদানের মাধ্যমে তার বৈশিষ্ট্যগুলো সঞ্চারণ করে। অর্থাৎ, কোনো জীব, যেমন কিনা একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির গাছ কেমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হবে—ফুল লাল হবে নাকি সাদা, ফল গোলাকার হবে না লম্বাটে—ইত্যাদি তথ্যগুলো সংরক্ষিত থাকে জিনে। আর পূর্বপুরুষ থেকে ঠিক কী কী বৈশিষ্ট্য পাবে পরবর্তী প্রজন্ম, সেটাও নির্ভর করবে কোন জিন সঞ্চারিত হলো তার ওপর। এ কারণেই বংশানুক্রমে নির্দিষ্ট কোনো প্রজাতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঠিক একইভাবে সংরক্ষিত হয়। আর এই বংশানুক্রমের ধারক ও বাহক জিনের বিশদ পাঠ হয় জীববিজ্ঞানের যে শাখায়, তা-ই ‘বংশগতিবিদ্যা’ বা ‘জেনেটিকস’।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, বংশগতিবিদ্যা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খুব পুরোনো নয়, সাকল্যে ১০০ বছরের কিছু বেশি হবে। তবে কিসের সূত্র ধরে বংশগতিবিদ্যার শুরু, তার শিকড় প্রোথিত আরও পেছনে। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন গাছ সংকর করলে যে পূর্বপুরুষ থেকে বংশানুক্রমে বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে চলে আসে, তা মানুষ সংকরকৃত গাছের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে ধারণা করতে পারত। তবে সেকালে জিনের বিষয়ে কারও কোনো ধারণা না থাকায় কোন বৈশিষ্ট্য কীভাবে যাচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মে, এসব বহুকাল পর্যন্ত ধাঁধাই হয়ে ছিল। সব ধাঁধার জট খোলার ব্যাখ্যা যিনি প্রথম দিতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন গ্রেগর জোহান মেন্ডেল। বংশানুক্রমিক বৈশিষ্টে্যর সঞ্চারণ যে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে চলে, তা আবিষ্কার করায় এই গবেষককে বলা হয় ‘বংশগতিবিদ্যার জনক’।

জোহান মেন্ডেলের জন্ম ২২ জুলাই ১৮২২ সালে মধ্য ইউরোপের অস্ট্রিয়ায়। আজ যিনি এত বিখ্যাত, তিনি ছিলেন সাধারণ অখ্যাত এক ধর্মযাজক; যদিও তাঁর ছিল কৃতিত্বপূর্ণ শিক্ষাজীবনের ইতিহাস। কৃষক পরিবারের ছেলে হওয়ায় ছোটবেলাতেই হয় কৃষিকাজে হাতেখড়ি। মাত্র ১১ বছর বয়সেই তাঁর শেখার আগ্রহ দেখে এক শিক্ষক তাঁকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সুপারিশ করেন। এরপর কৃতিত্বসহ সম্মান ডিগ্রি অর্জন, অলমুটজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফিক্যাল ইনস্টিটিউটে পদার্থ ও গণিতশাস্ত্র শিক্ষা, ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও পদার্থ, গণিত ও উদ্ভিদবিজ্ঞান শিক্ষা তাঁর জ্ঞানের ভান্ডারকে করে সমৃদ্ধ। ২১ বছর বয়সে তৎকালীন ব্রু্যনের সেইন্ট থমাস মঠে ধর্মযাজক হিসেবে যোগদানকালে গ্রেগর যুক্ত হয় তাঁর নামের সঙ্গে। এ মঠেই শিক্ষকতা জীবনের শুরু তাঁর। এর পাশাপাশি মঠের বাগানে শুরু করেন মটরশুঁটি নিয়ে তাঁর গবেষণাকাজ, যা তাঁকে আজ অমর করেছে।

নিজের গবেষণায় মেন্ডেল দেখিয়েছেন কী নীতি মেনে গাছের বৈশিষ্ট্য একটা নির্দিষ্ট ধারা বজায় রেখে সঞ্চারিত হয়। ১৮৫৬ সাল থেকে মটরশুঁটির সাতটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে দীর্ঘ আট বছরের এই গবেষণায় তিনি পরীক্ষা করেছেন প্রায় ৩০ হাজার মটরশুঁটিগাছ। দুঁদে গবেষকের মতোই প্রতিবার গবেষণার সব ফল নথিবদ্ধ করেছিলেন। আর তা থেকেই এসেছে চমকপ্রদ সব পর্যবেক্ষণ।

যেমন লম্বা আর খাটো মটরশুঁটিগাছের সংকরে প্রথম প্রজন্ম সব লম্বা হয়, খাটো বৈশিষ্ট্যটি যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায়! এদের নিজেদের সঙ্গেই আবার সংকর করা হলে দ্বিতীয় প্রজন্মে খাটো গাছের পুনরাবির্ভাব ঘটে। এহেন আরও নিরীক্ষা থেকে তাঁর প্রস্তাবিত বংশগতি ধারার ধারণাগুলো আজ মেন্ডেলের ‘বংশগতির তিনটি নীতি’ হিসেবে গৃহীত। এগুলোই আধুনিক জেনেটিকসের ক্রোমোজোম, ডিএনএ ও জিনের ধারণার মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করেছে।

মটরশুঁটির সাতটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে দীর্ঘ আট বছরের গবেষণায় মেন্ডেল পরীক্ষা করেছেন প্রায় ৩০ হাজার মটরশুঁটিগাছ
ছবি: সংগৃহীত

বৈশিষ্ট্য সঞ্চারণের ধাঁচ পর্যবেক্ষণ করে তিনি ধারণা করেছেন যে বংশগতির বৈশিষ্টে্যর বাহন হিসেবে কিছু নির্দিষ্ট উপাদান আছে। তাঁর মতে, এগুলো হলো ‘হেরিডিটারি ফ্যাক্টর’, আজ যাকে আমরা জিন বলে জানি। তিনি আরও ধারণা দিয়েছেন, প্রতি বৈশিষ্ট্যের জন্য একটি নির্দিষ্ট ধরনের ‘উপাদান’ এক জোড়া করে আছে এবং তার দুই রকম ‘রূপ’ আছে। আজ আমরা জানি, ক্রোমোজোম জোড়া করে থাকে বলে তার প্রতিটায় একটা নির্দিষ্ট জিনও এক জোড়া করে থাকে। আর জিনের একটি রূপ বা ‘অ্যালিল’ হলো ‘ডমিন্যান্ট’, যা অন্য অ্যালিল ‘রিসেসিভ’কে প্রকাশিত হতে বাধা দেয়। এটি সত্যি বলেই মেন্ডেলের গবেষণায় ‘ডমিন্যান্ট’ অ্যালিলের উপস্থিতিতে গাছগুলো সব লম্বা হওয়া সম্ভব হচ্ছিল।

তাঁর এ অসাধারণ গবেষণাকাজ ১৮৬৬ সালে ‘এক্সপেরিমেন্টস অন প্ল্যান্ট হাইব্রিডস’ শিরোনামে ব্রু্যনের ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র জার্নালে প্রকাশিত হয়। স্রেফ সংকরায়ণের গবেষণা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় বংশগতিবিষয়ক বিশ্লেষণ হিসেবে এর কোনোই কদর হয়নি। তাই ১৮৮৪ পর্যন্ত তাঁর জীবদ্দশায় বংশগতিবিদ্যার প্রবক্তা হিসেবে প্রাপ্য খ্যাতিটুকু তাঁর আর পাওয়া হয়নি। তাঁর এ কাজ পুনরুদ্ধার হয় প্রায় ৩৫ বছর পর, যখন তিনজন গবেষক ১৯০০ সালে আলাদাভাবে একই গবেষণা করার পর খুঁজে পান যে বহু আগেই মেন্ডেল তা করে গেছেন। বংশগতির নীতিগুলোর বিশদ ধারণাও দিয়ে গেছেন, যা এত দিন অন্তরালেই ছিল। এর পরই সত্যিকারের জেনেটিকসের চর্চা শুরু।

বংশগতিবিদ্যার জনক গ্রেগর জোহান মেন্ডেল

মেন্ডেলের দেওয়া ধারণা আভাস দিয়েছিল, জিনেই রয়েছে জীবের যত রহস্যের চাবিকাঠি। তাই তো এখন বিশ্বব্যাপী চলছে জিন বা ডিএনএর আণবিক পর্যায়ের গবেষণা। কোন জিনে কী বৈশিষ্টে্যর তথ্য আছে, তা জানতে রয়েছে ডিএনএ সিকুয়েন্সিং পদ্ধতি। জিনের সিকুয়েন্স তথ্য জানলে বলা যাবে বংশপরম্পরায় কেউ কোনো রোগে আক্রান্ত হবে কি না ইত্যাদি। এভাবেই সাড়াজাগানো ‘হিউম্যান জিনোম সিকুয়েন্সিং প্রজেক্ট’ আর বংশগতিবিদ্যা দিয়ে সম্ভব সম্যক মানবকল্যাণ সাধন।

(কিশোর নববর্ষ ১৪২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)