ঘুষির কেরামতি!

আচ্ছা, তোমরা কি কখনো কোনো খেলাধুলায় বিশেষ আগ্রহী হয়েছ? শখের বশে শুরু করে দিন-রাত কীভাবে তাতে ভালো করা যায়, সেসব ভেবেছ? পরিশ্রম করেছ নিজেকে আরও এগিয়ে নিতে? আমার মনে পড়ে যায় কৈশোরের দিনগুলোর কথা। ক্রিকেট খেলতে বড় ভালোবাসতাম আমরা। বিকেল হলেই ধুন্ধুমার পড়ে যেত কীভাবে বন্ধুদের এক জোট করে চলে যাওয়া যায় মাঠে। সবাই মিলে উল্লাস করে খেলাধুলা, তাতে হাঁপিয়ে গেলেও মহাসুখ! সন্ধেবেলা ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরতাম আবার পরদিন ওই একই আনন্দ লাভের আশা বুকে করে। তবে নিজেকে ভালো ক্রিকেটার করে তোলার জন্য সঠিক পথে হাড়ভাঙা খাটুনি করেছি, এমনটা দাবি করতে পারি না। সত্যি বলতে, শখ শখই থেকে গেছে, তা আর প্রগতি পায়নি। তবে আজ এমন একজনের গল্প করব, যে পেরেছিল নিজের শখকে যোগ্য সম্মান দিয়ে তাতে সাফল্য অর্জন করতে।

যে গল্পের কথা বলছিলাম, তা হলো ‘হাজিমে নো ইপ্পো’, যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়, ‘প্রথম পদক্ষেপ’। আর এই পদক্ষেপ নিয়েছিল তোমাদের মতোই এক কিশোর, ‘মাকনোইচি ইপ্পো’। জাপানিজ সফলতম মাঙ্গা সিরিজগুলোর মধ্যে মাঙ্গাকা মরিকাওয়ার এই গল্পটি অন্যতম। আর তারই ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে শতাধিক পর্বের অ্যানিমে ধারাবাহিক। যে খেলাটিকে কেন্দ্র করে গল্পের কাহিনি গড়ে উঠেছে, তা হলো ‘বক্সিং’ বা ‘মুষ্টিযুদ্ধ’।

গল্পের নাম চরিত্র ‘ইপ্পো’ সাধারণ এক বালক। স্কুলে পড়ে। নিতান্ত নিরীহ হওয়ার কারণেই একদল উগ্র সহপাঠী তার ওপর অত্যাচার চালায়। তাকে পেটায়, বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেয় তাকে দিয়ে। ইপ্পো সব সহ্য করে, কোনো প্রতিঘাত করতে পারে না। এমনই একদিন যখন ইপ্পো নির্যাতিত হচ্ছিল, তখন পথ দিয়ে যাচ্ছিল জাপানের অন্যতম প্রতিভাবান এক বক্সার, তাকামুরা মামোরু। সে উগ্র ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করে, ইপ্পোকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে নিজেদের জিম বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে অজ্ঞান ইপ্পো একপর্যায়ে চেতনা ফিরে পায়। সবকিছু দেখেশুনে অবাক হয় সে। ইতিপূর্বে বক্সিং সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকায় প্রথমটায় সে ভাবগতিক বুঝে উঠতে পারে না। তাকামুরাও তার পড়ে পড়ে মার খাবার প্রবণতা দেখে বিরক্ত হয়ে তাকে স্যান্ডব্যাগে সজোরে ঘুষি চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। ইপ্পো তা করতেই চমকে যায় তাকামুরা। বুঝতে পারে এই ছেলের আছে বক্সার হয়ে ওঠার মতো শক্তি। কিন্তু চাইলেই কি আর বক্সার হওয়া যায়? তার জন্য লাগে প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রম। আর তথাকথিত প্রতিভা ইপ্পোর প্রাথমিকভাবে না থাকায় তাকামুরা তাকে বক্সার করার পক্ষপাতী হয় না। ওদিকে ইপ্পো তাকামুরাকে দেখে প্রভাবিত হয়ে এবং বক্সিং সম্পর্কে জানা শুরু করে বুঝতে পারে এই খেলাটি হতে পারে তার জীবনের অবলম্বন। এতে আত্মনিয়োগ করে সে হয়ে উঠতে পারে সাহসী আর স্বাধীন। তাই তাকামুরার বারণ সত্ত্বেও বক্সিং শিখতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। তাকামুরা তাকে নিরস্ত করে একটি এমন কাজ দেয়, যা করা তার মতো একজন বক্সিং-অজ্ঞ নবীনের পক্ষে অসম্ভব।

ইপ্পোর হার না মানা সংকল্পের সেই শুরু। প্রতিভার ঘাটতি কাটাতে সে বেছে নেয় মোক্ষম এক অস্ত্র, অনুশীলন। মায়ের মাছধরা ব্যবসার কাজে সাহায্য করার ফাঁকে ফাঁকে পুরো অবসরটুকুই সে ঢেলে দেয় নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তাকামুরার দেওয়া কাজটি উদ্ধারে। যতই ব্যর্থ হয়, ততই বেশি চেষ্টা করে সে। ভাবে, কীভাবে তাকামুরা কাজটি করে দেখিয়েছিল। কীভাবে সে কাজটি করতে পারে। একটু একটু করে লক্ষ্যে পৌঁছায় সে।

সেই থেকে ছেলেটির যাত্রা শুরু। তাকামুরার জিমে ভর্তি হয়ে কোচের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠা। খুঁজে পাওয়া একজন সচেতন চির প্রতিদ্বন্দ্বীকে। পরিচিত হওয়া বন্ধুর মতো কয়েকজন অগ্রজের সঙ্গে। একে একে জয় করা সম্মান, শক্তি, কৌশল, শিরোপা, প্রেম, প্রভৃতি।

ভয় পেয়ো না। কাহিনির প্রায় কিছুই তোমাদের বলিনি। যেটুকু বলেছি, তা প্রথম কয়েক পর্বের রূপরেখা আর সামগ্রিক একটি সারাংশ। বাকিটা জানতে হলে তোমাদের বসে পড়তে হবে ‘হাজিমে নো ইপ্পো’ অ্যানিমেটি দেখতে।

সিরিজটি দেখার সবচাইতে বড় সুবিধা হলো বক্সিং বা মুষ্টিযুদ্ধ খেলাটি সম্পর্কে তোমার চমৎকার একটি ধারণা হয়ে যাবে। এ খেলা কীভাবে পরিচালিত হয়। সাধারণত কয় মিনিট খেলা হয় প্রতিটি রাউন্ড, কী কী হলে একজন খেলোয়াড় জিতে বা হারে, সেসব অনায়াসে জেনে ফেলবে একটু একটু করে। কীভাবে খেলা আয়োজিত হয়, র‌্যাংকিং কীভাবে কাজ করে, কেমন করে শিরোপা জেতা যায়, কিংবা বক্সিংয়ে খেলোয়াড়ের দৈহিক ওজনের গুরুত্ব ঠিক কতটা, তার একটা স্পষ্ট রূপরেখা তোমরা পাবে। মোদ্দাকথা হলো, এ খেলা তোমাদের কাছে আর দুর্বোধ্য থাকবে না। আমি তো প্রথমবার দেখার পর ঘরে একা একাই শ্যাডো-বক্সিং করতাম! এতটাই আক্রান্ত করে ফেলেছিল কাহিনির জাদুকরি মোহ। যদিও ঘুষির কেরামতিতে আজতক কাউকে কুপোকাত করার চেষ্টা চালাইনি, তাই স্বেচ্ছা প্রশিক্ষণের ফলাফলটা আর প্রমাণ করা যায়নি।

যেকোনো ভালো ধারাবাহিকের মতোই ‘হাজিমে নো ইপ্পো’র মূল শক্তি এর চরিত্রগুলো। এতগুলো চমৎকার হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো চরিত্রের সমাবেশ খুব কম অ্যানিমেই শুরুর অল্প কিছু পর্বের মধ্যে করতে পেরেছে। এখানে ইপ্পো নাম চরিত্র হলেও সে একমাত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনো অর্থেই নয়। আছে ‘তাকামুরা মামোরু’ আর কোচ ‘কামোগাওয়া’র মতো মোক্ষম দুটি চরিত্র। তাকামুরা শক্তির প্রতীক, সব সময় ইপ্পোকে সামনে থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখায় কীভাবে জেতা সম্ভব। তার তুলনা সে নিজেই। আর কোচ কামোগাওয়া যেভাবে নিজের সর্বস্ব দিয়ে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে গড়ে তোলেন, তা সত্যিই অনবদ্য। একজন ভালো প্রশিক্ষক যেমন একজন খেলোয়াড়কে অনুপ্রাণিত করতে পারেন, তেমনি একজন আদর্শ খেলোয়াড়ও উদ্বুদ্ধ করতে পারে একজন প্রশিক্ষককে। ইপ্পোর অধ্যবসায় আর অনুশীলন এবং মঞ্চে তার প্রয়োগ বারবার কামোগাওয়াকে নিজেকে উজাড় করে দিতে বাধ্য করেছে। অন্যদিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘মিয়াতা’ ইপ্পোকে অনুপ্রাণিত করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে।

এ ছাড়া গল্পে অবধারিতভাবে রয়েছে যুগল কমিক রিলিফ, ‘আওকি’ আর ‘কিমুরা’। এই দুজন বরাবর তাকামুরার ছায়ায় আচ্ছাদিত, তবু চেষ্টা করে যায় নিজেদের মতো লড়াইয়ের। চরিত্র হিসেবে এখানেই তারা অনন্য। হাসির মাঝে মাঝে তারা হয়ে ওঠে ভীষণ গম্ভীর। রসিকতা কাটিয়ে সেই সব অংশ অন্যভাবে ভাবায়।

মানুষের দায়িত্ববোধের জায়গাগুলো নিয়মিত প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে গল্পে। যেমন ইপ্পোর বাবা না থাকায় মায়ের ব্যবসায় সে সাহায্য করে। আবার মা, সে ইপ্পোকে তার মতো করে আনন্দে থাকতে দিতে বাড়তি পরিশ্রম করেন। যদিও এতে তাঁর ভয়ানক স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি রয়েছে। ইপ্পোর দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায় তার বন্ধু। ভয় থাকা সত্ত্বেও ইপ্পো সামাজিকতা রক্ষায় পিছপা হয় না। ইপ্পোর হতাশা বা বিপদের সময়ে সঙ্গীদের পাশে দাঁড়ানো, কিংবা তাকামুরাকে উৎসাহ দিতে ইপ্পোদের গলা ফাটিয়ে চিৎকার। এমনকি পরাজিতদের প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ বারবার মানুষের ভেতর থেকে ভালোটুকু ছেঁকে আনার বিষয়টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সে অর্থে বলতে গেলে ইপ্পোতে কোনো নিরেট খল চরিত্র নেই, বরং যে যার জায়গা থেকে নিজের মতো চেষ্টা করেছে উঠে দাঁড়ানোর। লক্ষ্যে পৌঁছাতে তারা লড়ছে ঠিকই, কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে আবার ঠিকই খুঁজে পেয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।

বক্সিংয়ের যেসব টেকনিক এতে দেখানো হয়েছে, তার সব কটি শতভাগ বাস্তব না হলেও অনেকগুলোই সত্যি। একটু আগে যেমন বলছিলাম শ্যাডো-বক্সিংয়ের কথা। এ হলো প্রতিপক্ষের কৌশল বা গতির একটি ছায়া কল্পনা করে সেই মতো নিজের রণ-কৌশল অনুশীলনের একটি পদ্ধতি। এটা বক্সাররা নিয়মিত চালিয়ে যান। কিংবা আছে আপারকাটের মতো মোক্ষম অস্ত্র। আর এই অস্ত্র প্রয়োগের যে কৌশল দেখানো হয়েছে, তা বাস্তব। বক্সিংয়ের ‘কাউন্টার’, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের শক্তি বা গতিকে তারই বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে কুপোকাত করার বেশ কিছু পদ্ধতি সঠিক। আছে জ্যাব বা দ্রুতগতির ঘুষি কিংবা হুকের মতো গদাম করে একপাশ থেকে বাতাস চিরে আঘাত শানার উপায়। না চাইলেও এসব প্রক্রিয়া তোমাদের মগজে গেঁথে যাবে।

‘হাজিমে নো ইপ্পো’ অ্যানিমেটির বেশ কয়েকটি সিজন রয়েছে। তোমরা যারা সবটা দেখতে চাও না, তারা ৭৫ পর্বের প্রথম সিরিজটি দেখতে পারো। এতে ইপ্পোর যাত্রার একেবারে শুরু থেকে একটি মোক্ষম শিরোপা জয় পর্যন্ত কাহিনি রয়েছে। এর সঙ্গে একটি বাড়তি পর্ব রয়েছে, যাতে তাকামুরার অতীতের কাহিনি দেখানো হয়। তবে যারা আরও বেশি দূর যেতে চাইবে, তাদের জন্য আছে যথাক্রমে ‘হাজিমে নো ইপ্পো নিউ চ্যালেঞ্জার’ ও ‘হাজিমে নো ইপ্পো রাইজিং’ শিরোনামের দুটি সিরিজ। নিউ চ্যালেঞ্জার সিরিজটি ২৬ পর্বের এবং রাইজিং সিরিজটি ২৫ পর্বের। এ ছাড়া এক ফাঁকে আছে কিমুরার লড়াইয়ের একটি বিশেষ পর্ব। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাজিমে নো ইপ্পো মাঙ্গাটি এখনো চলমান। সুতরাং ভবিষ্যতে আরও অ্যানিমে আসতে পারে ভক্তদের বিনোদন দিতে। সিরিজের দীর্ঘতা দেখে উপেক্ষা কোরো না। এমন চমৎকার অ্যাকশন-কমেডি-স্পোর্টস একটি অ্যানিমে তোমাদের অবশ্যই দেখা উচিত।

স্বাভাবিকভাবেই সিরিজে অনেকগুলো গান রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোকপাত করছি না। এই আবিষ্কারের আনন্দটুকু তোমাদের জন্য রইল। ইপ্পোর মিষ্টি রোমান্সের ব্যাপারটাও কিছুটা চেপে গেলাম, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মজার ছিল, এটুকু বলতে পারি। ভয়ানক সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইপ্পোর লড়াই তোমাদের কেমন লাগল, তা তো অবশ্যই জানতে আগ্রহী, তবে আমার বিশ্বাস আওকির লড়াইগুলো তোমাদের সবচেয়ে হাসিখুশি রাখবে। এ এমনই এক আয়োজন, যা সবার ভালো লাগতে বাধ্য! সে তোমরা খেলাধুলা করতে পছন্দ করো কিংবা না করো, তোমাদের বিশেষ কোনো শখে আগ্রহ থাকুক বা না থাকুক, যদি অ্যানিমে দেখতে ভালোবেসে থাকো, তবে ‘হাজিমে নো ইপ্পো’ অপেক্ষায় আছে তোমাদের জন্য।