সামিউল সোমবার স্কুলে যেতে চায়নি: এই শোক সইবার শক্তি আমাদের নেই
২১ জুলাই ২০২৫ বুঝি দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। এদিন দুপুরে, ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনের প্রবেশমুখে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান আকস্মিকভাবে বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিমান বিধ্বস্তের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সবার আগে এগিয়ে আসেন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকেরা। আসেন নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, ডাক্তার ও জরুরি সহায়তা দল। রক্ত প্রয়োজন শুনে জনসাধারণ হাসপাতালে চলে এসেছেন। মোটকথা যার যার অবস্থান থেকে সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
দুর্ঘটনার পরপর তেমন করে সব জানা যায়নি। তবে সময় যত গড়াচ্ছে, ততই আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার গল্পগুলো সামনে আসছে।
আমরা জানতে পেরেছি শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরীর গল্প। কিশোর আলোতে তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে, ‘মাহরীন চৌধুরীকে অশ্রুমাখা স্যালুট, যিনি শিশুদের বাঁচাতে জীবন দিলেন’। মাইলস্টোন স্কুলের কো-অর্ডিনেটর মাহরীন চৌধুরী, যিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। দুর্ঘটনার সময় তিনি ছিলেন স্কুলভবনে। ভবনটিতে আগুন লাগার সময় তিনি নিজের কথা ভাবেননি, বরং যতজন ছাত্রছাত্রীকে সম্ভব, তাদের বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এই অদম্য প্রচেষ্টায় তার শরীরের শতভাগ পুড়ে যায়। কঠিন সময়ে একজন শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকেন, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করে গেলেন। এর জন্য তাকে নিজের জীবন দিয়ে চরম মূল্য দিতে হলো।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ২২ জুলাই দুপুর ১২টা পর্যন্ত মোট ৩১ জন নিহত ও ১৬৫ জন আহত হয়েছেন।
একের পর এক এমন মানবিক গল্প সামনে আসছে। প্রথম আলোর সাংবাদিক মো. মামুন, যিনি দুর্ঘটনার সময় দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ছিলেন। তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে হৃদয়বিদারক কিছু মুহূর্ত। তিনি দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি লিখেছেন, ‘এর মধ্যে দেখতে পাই ভবনের ভাঙা অংশের একটু দূরে বিধ্বস্ত বিমানের আরও কিছু অংশ পড়ে আছে। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি পোড়া চেয়ার এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না এসব চেয়ার ভবনের নিচতলার ক্ষতিগ্রস্ত কক্ষের। পোড়া চেয়ারসহ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হঠাৎ চোখ আটকাল আধপোড়া কালো একটি জুতায়। এই জুতার ছবি-ভিডিও যখন করছিলাম, তখন কেন জানি, ভেতর থেকে কান্না আসছিল, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না...।’
প্রথম আলোর বরিশাল প্রতিনিধির পাঠানো খবরে জানা গেছে, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সামিউল করিম (১১) নিহত হয়েছে। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবার শোকে স্তব্ধ। সামিউলের মামা সৈয়দ মনির হোসেন জানান, ‘সামিউল সোমবার স্কুলে যেতে চায়নি। মায়ের কাছে আবদার করেছিল আজ সে বাসায় থাকবে। সকালে উঠে ছোটবেলার কটি খেলনা উড়োজাহাজ শোকেস থেকে নামিয়ে মুছে পরিষ্কার করে খেলছিল সামিউল। কিন্তু তার মা বুঝিয়ে-শুনিয়ে স্কুলে যেতে রাজি করান। এটা জানলে ওকে আমরা স্কুলে পাঠাতাম না…’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মামা মনির হোসেন।
প্রথম আলোর সখীপুর, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি আরেকটি মর্মান্তিক খবর জানিয়েছেন। প্রথম আলো অনলাইন সূত্রে জানা গেছে, বাবার কপালে চুমু দিয়ে প্রতিদিন ক্লাসে যেত মেহেনাজ আফরি হুমায়রা (৯)। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর সে আর কখনো বাবার হাত ধরে স্কুলে যাবে না। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মেহেনাজ। মেয়ের কফিনে বারবার চুমু খাচ্ছিলেন বাবা দেলোয়ার হোসাইন, যিনি নিজেও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ভাগ্যক্রমে তিনি ও তার স্ত্রী সুমি আক্তার প্রাণে বেঁচে গেছেন।
এমন অসংখ্য মানবিক গল্প ছড়িয়ে আছে চারপাশে, যা পুরো দেশকে কাঁদিয়ে চলেছে। এই শোক সইবার শক্তি হয়তো আমাদের নেই। আমরা শুধু এতটুকু বলতে চাই, যে নিষ্পাপ শিশুরা অকালে ঝরে গেল, যে শিক্ষিকা নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিলেন, যারা এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আমরা তোমাদের ভুলব না।