পাইলট ছাড়াই ১০ মিনিট যেভাবে আকাশে উড়ল বিমান

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে স্পেনের সেভিলের দিকে যাওয়া জার্মান বিমান সংস্থা লুফথানসার একটি এয়ারবাস এ৩২১ বিমানে এই ঘটনা ঘটেছিলছবি: সিএনএন

সম্প্রতি স্প্যানিশ মিনিস্ট্রি অব ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবল মবিলিটি কর্তৃপক্ষের একটি রিপোর্টে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর জার্মানি থেকে স্পেনের উদ্দেশে রওনা হওয়া একটি বিমানের কো-পাইলট ককপিটে জ্ঞান হারান। এতে প্রায় ১০ মিনিট পর্যন্ত বিমানটি পাইলটের সাহায্য ছাড়াই আকাশে উড়েছে।

স্প্যানিশ সরকারের সিভিল এভিয়েশন অ্যাক্সিডেন্ট অ্যান্ড ইনসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিশন (CIAIAC) গত সপ্তাহে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে স্পেনের সেভিলের দিকে যাওয়া জার্মান বিমান সংস্থা লুফথানসার একটি এয়ারবাস এ৩২১ বিমানে এই ঘটনা ঘটেছিল।

রিপোর্ট লেখা হয়েছে, বিমানের প্রধান পাইলট যখন টয়লেটে যাওয়ার জন্য ককপিট থেকে বেরিয়ে আসেন ঠিক তখনই কো-পাইলটের অজানা এক স্নায়বিক সমস্যার কারণে খিঁচুনি শুরু হয়। এর ফলে পাইলট ও বিমানের ক্রু সদস্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রায় ১০ মিনিট ধরে বিমানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে, অর্থাৎ অটোপাইলট মোডে চলে। তখন বিমানটি কোনো পাইলটের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এই ঘটনাটি যখন হয় তখন বিমানে ১৯৯ জন যাত্রী ছিল।

সকাল ১০টা ৩৯ মিনিটে পাইলট যখন বাথরুম থেকে ফিরে আসেন, তখন তিনি ককপিটে ঢুকতে পারেননি। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন হয়তো ভুল অ্যাক্সেস কোড দিয়েছেন।

এই ঘটনার পরপরই একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়। তদন্তে উঠে এসেছে ককপিট থেকে একজন পাইলটকে বাইরে যেতে হলে অবশ্যই অন্য একজন ব্যক্তিকে ফ্লাইট ডেকে থাকতে হবে। জার্মানির বিমান সংস্থা লুফথানসার এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত বলে জানিয়েছে। তারা স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ সহযোগিতা করার পাশাপাশি নিজেরাও একটি তদন্ত করেছে।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যান্ত্রিক ত্রুটি, পাইলটের ভুল, মাঝ আকাশে দুর্ঘটনা—এসবের মতো কিছু ঘটনা বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। ফলে বিমানে ভ্রমণের বিষয়ে যাত্রীদের উদ্বেগ কিছুটা বেড়েছে। যদিও বিমান বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, ‘এ ধরনের সমস্যা খুবই বিরল। বিমান ভ্রমণ এখনও পরিবহনের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম।’

বিমানের ক্রু সদস্যরা কো-পাইলটকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। ফ্লাইটের একজন যাত্রী ছিলেন ডাক্তার
ছবি: ডাগেন্স

রিপোর্টে ৪৩ বছর বয়সী যে লুফথানসা পাইলটের কথা বলা হয়েছে তিনি সকাল ১০টা ৩১ মিনিটে বাথরুমে যাওয়ার জন্য ককপিট ছাড়েন। এর আগে তিনি তাঁর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩৮ বছর বয়সী কো-পাইলটের সঙ্গে আবহাওয়া ও বিমান পরিচালনা নিয়ে কথা বলেন। ৪৩ বছর বয়সী পাইলট জানান, ‘ককপিট ছাড়ার আগে কো-পাইলটকে ‘সুস্থ’ ও ‘মনযোগী’ মনে হয়েছিল।’

সকাল ১০টা ৩৯ মিনিটে পাইলট যখন বাথরুম থেকে ফিরে আসেন, তখন তিনি ককপিটে ঢুকতে পারেননি। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন হয়তো ভুল অ্যাক্সেস কোড দিয়েছেন। কিন্তু পাঁচবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। পরে ইন্টারকমে যোগাযোগ করেন। সেখানেও কোনো জবাব পাওয়া যায় না। পাইলট একটি আলাদা কোড ব্যবহার করে জরুরি দরজা খোলার চেষ্টা করেন।

বিমান অবতরণের পর কো-পাইলটকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি জানিয়েছেন যে, স্পেনের জারাগোজা শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার কথা তার মনে আছে।

এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই কো-পাইলট ভেতর থেকে দরজা খুলে দেন। কিন্তু তার অবস্থা ছিল গুরুতর। তার মুখটা তখন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। অনেক বেশি ঘামছিলেন ও অদ্ভুতভাবে নড়াচড়া করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই পাইলট ক্রুদের সাহায্য চান ও সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন।

আরও পড়ুন

বিমানের ক্রু সদস্যরা কো-পাইলটকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। ফ্লাইটের একজন যাত্রী ছিলেন ডাক্তার। তিনিও সাহায্য করেন। প্রাথমিকভাবে ডাক্তার জানান, ‘কো-পাইলট হয়তো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।’ পাইলট একটি জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণা করেন। ফলে বিমানটিকে পাইলট মাদ্রিদের অ্যাডলফো সুয়ারেজ মাদ্রিদ বারাজাস বিমানবন্দরের (Adolfo Suárez Madrid Barajas Airport) দিকে ঘুরিয়ে দেন। প্রায় ২০ মিনিট পর সেখানে নিরাপদে অবতরণ করে বিমানটি।

কো-পাইলট বাদে সকল যাত্রীসহ বিমানের ক্রু সবাই সুস্থ ছিল বিমান অবতরণ পর
প্রতিকি ছবি

বর্তমানে কিছু বিমান নির্মাতা সংস্থা ফ্লাইটে প্রয়োজনীয় পাইলটের সংখ্যা কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পাইলট ইউনিয়নসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এই ধরনের ‘পাইলট ইনক্যাপাসিটেশন’ অর্থাৎ পাইলটের অক্ষমতা ঘটনাগুলোকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেন, ‘ককপিটে সবসময় দুইজন পাইলট থাকা জরুরি। যেমন, গত অক্টোবরে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একজন পাইলট সিয়াটল থেকে ইস্তাম্বুল যাওয়ার সময় মারা গিয়েছিলেন। সেই ফ্লাইটে ককপিটে আরও দুইজন পাইলট থাকায় তারা নিউইয়র্কে জরুরি অবতরণ করতে পেরেছিলেন।’

যদিও এই ধরনের ঘটনা প্রায়ই সামনে আসে। তবে শারীরিক সমস্যার কারণে বিমানে পাইলটের অক্ষমতার ঘটনা সত্যিই বিরল। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিমান চলাচল সুরক্ষা সংস্থার (EASA) প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, প্রতি ১ কোটি ফ্লাইট ঘণ্টার মধ্যে এমন ঘটনা মাত্র ০.৪৫ বার ঘটে থাকে। এই সমস্যা সমাধানে পাইলটদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিচ্ছে বিমান সংস্থা।

আরও পড়ুন
বিমানের ক্রু সদস্যরা কো-পাইলটকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। ফ্লাইটের একজন যাত্রী ছিলেন ডাক্তার। তিনিও সাহায্য করেন। প্রাথমিকভাবে ডাক্তার জানান, ‘কো-পাইলট হয়তো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।’

সিআইএআইএসি রিপোর্ট পাইলটের স্বাস্থ্য নিয়ে বলা হয়েছে, ৩৮ বছর বয়সী কো-পাইলটের প্রায় নয় মাস আগে মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছিল। তার মেডিকেল ছাড়পত্র আরও সাড়ে তিন মাস পর্যন্ত মেয়াদ ছিল। বিমান অবতরণের পর কো-পাইলটকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি জানিয়েছেন যে, স্পেনের জারাগোজা শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার কথা তার মনে আছে। এরপর হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু কখন, তা তিনি মনে করতে পারেননি। তদন্ত চলার সময় কর্তৃপক্ষ তার বিমান চালানোর মেডিকেল সার্টিফিকেট বাতিল করেছে। তবে কো-পাইলট বাদে সকল যাত্রীসহ বিমানের ক্রু সবাই সুস্থ ছিল বিমান অবতরণ পর।

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন, সিবিএস নিউজ

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন