যেভাবে একটি ভবন হতে পারে ভূমিকম্প সহনশীল

শীতের সকালে কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামে শুয়ে আছি। হঠাৎ মায়ের ডাকাডাকি শুনে টের পেলাম ভূমিকম্প হচ্ছে, দ্রুত নিচে নামতে হবে। ভূমিকম্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়েছে। কিন্তু হুটোপুটি করে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হোঁচট খেয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফুলে ঢোল হয়ে গেল। এখন মাথায় বরফ দিতে দিতে ভাবছি, যেভাবেই হোক নিজের বাড়ি মজবুত করতে হবে! ভূমিকম্পের সময় যেন নিজের ঘরে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ হয়। তবে চলো একনজরে দেখে আসা যাক একটি বাড়িকে ভূমিকম্প সহনশীল করার কিছু কার্যকর পদ্ধতি।

লোকমুখে হয়তো শুনেছ, বাংলাদেশ এখন ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে বেশ কিছু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীতে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ধসে পড়ার ঝুঁকিতে থাকবে এক লাখ ভবন। অন্যদিকে রাজউকের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মধুপুর চ্যুতিরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় মারা যেতে পারেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ। অনেকেরই জানা আছে, ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে। তবু সম্প্রতি একটি ভূমিকম্পের সময় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আতঙ্কে তাড়াহুড়া করে কারখানা থেকে বের হওয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। বুঝতেই পারছ, ভূমিকম্পের সময় হুড়োহুড়ি করা বিপজ্জনক। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সবচেয়ে বেশি দরকার। কিন্তু ভূমিকম্প সহনশীল ভালো বাড়ি নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগ দেওয়াও জরুরি।

‘ভূমিকম্প-প্রুফ’ বাড়ি বানানোর তিনটি কার্যকর পদ্ধতি

বাড়ি তৈরিতে ফ্লেক্সিবল ফাউন্ডেশন

সাধারণভাবে চিন্তা করলে একটি ভূমিকম্প সহনশীল বাড়ির ভিত্তিকে অনড় হতে হবে। কিন্তু যেকোনো বাড়ির ভিত্তি অনড় হলে ভূমিকম্পে সেই বাড়ির ভেঙে পড়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এর কারণ বোঝা সহজ। ভূমিকম্পের উৎস হলো ভূ-অভ্যন্তরে থাকা প্রাকৃতিক শক্তি। এই শক্তি জমে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করলে ভূপৃষ্ঠে কম্পন দেখা যায়। ভূকম্পনে তরঙ্গের মতো মাটি কেঁপে ওঠে। আর সেই মাটির সঙ্গে কেঁপে ওঠে বড়সড় বিল্ডিংগুলোর ভিত্তি। এই কম্পনের পেছনকার শক্তিকে চাইলেই উধাও করে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, শক্তির বিনাশ নেই। এমন সমস্যা সমাধানের জন্য বেস আইসোলেশন নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

বাড়ি তৈরিতে বেস আইসোলেশনের ব্যবহার

নমনীয় ইস্পাত, রবার এবং সিসার মতো উপাদান ব্যবহার করে বিল্ডিংয়ের নিচে মাটির ভেতরে একটি ফ্লেক্সিবল ফাউন্ডেশন তৈরি করা হয় বেস আইসোলেশনে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে একটি বিল্ডিংয়ের আসল ভিত্তিকে মাটির ওপরে উঠিয়ে দেওয়া হয়। ভূমিকম্পের সময় মাটির ভেতরে থাকা ফ্লেক্সিবল ফাউন্ডেশন নড়াচড়া করলেও বিল্ডিংয়ের মূল কাঠামোটি স্থির থাকে। ফ্লেক্সিবল ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য ভূমিকম্পের শক্তিকে কাজে লাগানো। মানে ভূমিকম্পের সময় বিল্ডিংয়ের নিচে থাকা ফ্লেক্সিবল ফাউন্ডেশন কাঁপবে ভূমিকম্পের বল ব্যবহার করে। যার ফলে আসল বিল্ডিংয়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না ভূকম্পন।

বাড়ির সুরক্ষায় ড্যাম্পার

দশের লাঠি একের বোঝা, প্রচলিত এই উক্তি হয়তো তুমি শুনেছ। চাপের মধ্যে পড়লে মানুষ নিজের পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নিয়ে থাকে। ভূমিকম্পের সময় একটি বিল্ডিং অনেক চাপের মধ্যে পড়ে। এই চাপ কমাতে তেমন সাহায্য দরকার হয়। আর নতুন যুগের প্রকৌশলীরা সেই চাপের বোঝা ভাগ করে নেওয়ার জন্য বিশেষ ভাইব্রেশন কন্ট্রোল ডিভাইস ব্যবহার করে থাকে।

ড্যাম্পারের ব্যবহার

ভাইব্রেশন কন্ট্রোল ডিভাইসের কাজ অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো। এই পদ্ধতিতে ভূকম্পনের শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। একটি বিল্ডিংয়ের প্রতিটি কলাম এবং বিমের মধ্যে আড়াআড়িভাবে ড্যাম্পার নামক একধরনের ভাইব্রেশন কন্ট্রোল ডিভাইস স্থাপন করা হয়। ড্যাম্পার কিছুটা সিলিন্ডার আকৃতির হয়। সেই সিলিন্ডারের ভেতরে সিলিকন তেল আর পিস্টন থাকে। সুপারি কাটতে ব্যবহার করা সরতার মতো কাজ করে এই পিস্টন। যখন ভূমিকম্প হয়, বিল্ডিংয়ের কম্পনশক্তি ড্যাম্পারগুলোতে থাকা পিস্টনে স্থানান্তর হয়। এই পিস্টন আবার সিলিকন তেলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এর ফলে ড্যাম্পারের ভেতরে কম্পনশক্তি তাপে পরিণত হয় আর শেষমেশ বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে ভূমিকম্পের চাপ কমে আসে।

স্টিল ধরে রাখবে বাড়ির আকৃতি

তুমি নিশ্চয়ই জানো, যেকোনো গাড়ির চালক এবং যাত্রীদের জন্য সিটবেল্ট বাঁধা অপরিহার্য। মানুষের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সিটবেল্ট ব্যবহার করা হয়। একইভাবে ভূমিকম্পের সময় একটি বিল্ডিংয়ের সুরক্ষার কথা ভেবে স্টিলের তৈরি শিয়ার ওয়াল এবং মোমেন্ট-রেজিসটিং ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। এসব বিল্ডিংয়ের কাঠামোকে দৃঢ় আর সুরক্ষিত করতে সিটবেল্টের মতো কাজ করে।

শিয়ার ওয়াল একাধিক স্টিলের প্যানেল দিয়ে তৈরি হয়। এই ধরনের প্যানেলে ভূমিকম্পের শক্তি সমানভাবে ছড়িয়ে যায়। এর ফলে ভূমিকম্পের বল বিল্ডিংয়ের কোনো দুর্বল অংশে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। শিয়ার ওয়ালের প্যানেলের সঙ্গে ইংরেজি অক্ষর এক্সের মতো আকৃতির ক্রস ব্রেস লাগানো যায়। এই ক্রস ব্রেস বাতাস এবং ভূমিকম্পের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে শিয়ার ওয়ালের প্রতিটি প্যানেলকে স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে।

স্পেশাল স্টিল প্লেট শিয়ার ওয়াল

মোমেন্ট-রেজিসটিং ফ্রেম একটি বিল্ডিংয়ের কলাম এবং বিমের জয়েন্টের মাঝে বসানো হয়। এই ধরনের ফ্রেম কলাম আর বিমের ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ায়। ভূমিকম্পের সময় কলাম এবং বিম নড়তে পারে কিন্তু তাদের জয়েন্টগুলো অনড় থাকে। এর ফলে একটি বিল্ডিংয়ের দৃঢ়তা বজায় থাকে। পাশাপাশি ভূমিকম্পের চাপও সহ্য করতে পারে সেই বিল্ডিং। সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি এই ধরনের ফ্রেম ডিজাইনারদের বাকি কাজে কোনো সমস্যা তৈরি করে না।

ভূমিকম্প সহনশীল বাড়ি তৈরি করার এসব পদ্ধতিকে জটিল, ব্যয়বহুল এবং বাস্তবে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু নিজের বাড়িকে ভূমিকম্প সহনশীলভাবে নির্মাণ করা মোটেও কঠিন নয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদি হাসান আনসারীর মতে, একটি ভবনকে ভূমিকম্প সহনশীলভাবে নির্মাণ করতে প্রতি বর্গমিটারে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ টাকা খরচ হয়। আর ভবন নির্মাণের পর যদি তা ভূমিকম্প সহনশীল করতে হয়, তাহলে প্রতি বর্গফুটে খরচ পড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। নিশ্চয়ই নিজের স্বপ্নের বাসভবনে জীবনঝুঁকি নিয়ে থাকতে কেউ রাজি নয়। নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করার জন্য সবার উচিত নিজেদের বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ আশ্রয়স্থলকে ভূমিকম্প সহনশীল করে তোলা।