বাড়ি থেকে পালিয়ে বদলে দিলেন নার্সিং, বাঁচালেন হাজারো জীবন

১২ মে আজ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন। ১৮২০ সালের এই দিনে ইতালিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন রোগীদের সেবায়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ২০৩তম জন্মদিনে কিশোর আলোর পক্ষ থেকে এই মহীয়সী নারীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

১৮৫৪ সাল। রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ করছে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও তুরস্ক। যুদ্ধ চলেছে টানা ছয় মাস। দুই পক্ষের অনেক সৈনিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। যুদ্ধে জয়লাভ করেছে যৌথভাবে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও তুরস্ক। আহত যোদ্ধাদের জায়গা হয়েছে হাসপাতালে। আহত ব্যক্তিদের কোনোরকমে হাসপাতালে নিয়ে ফেলতে পারলেই যেন সরকারের দায়িত্ব শেষ। দিনের পর দিন এভাবে পড়ে থাকতেন তাঁরা। তাঁদের দেখার সে রকম কেউ ছিল না। এখন যেমন সব হাসপাতালেই কমবেশি নার্স থাকেন, সে সময় এমন ছিল না। সব হাসপাতালে পাওয়া যেত না সেবিকা। শুধু স্থানীয় চিকিৎসকেরা কোনোরকম চিকিৎসা করতেন। কারণ, নার্স হতে চাইতেন না কেউ। নার্সদের সম্মান ছিল সবচেয়ে নিচু স্তরে। ফলে আহত যোদ্ধাদের জীবনে আরও ঝুঁকি দেখা দিল। এই যখন অবস্থা, তখন আলো হাতে এগিয়ে এলেন ৩৪ বছর বয়সী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। তিনিই আধুনিক নার্সিংয়ের সূচনা করেছেন।

১৮২০ সালের ১২ মে। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে একটি ফুটফুটে কন্যাশিশু। নাম রাখা হয় নাইটিঙ্গেল। শহরের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা উইলিয়াম ছোট্ট শিশুটির নাম রাখলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। শিশুটির বাবা উইলিয়াম নাইটিঙ্গেল ছিলেন সুশিক্ষিত। ফ্লোরেন্সের মা ফ্রান্সিস স্মিথও ধনী এবং শিক্ষিত ছিলেন। তবে তিনি বেশির ভাগ সময়ই অবসর জীবন যাপন করতেন। এই তিন সদস্যের বাইরে পরিবারের অন্য সদস্য ছিলেন একমাত্র বড় বোন ফ্রান্সিস পার্থেনপ।

ফ্লোরেন্স ইতালিতে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর মা–বাবা ব্রিটেনের নাগরিক। উইলিয়াম ও স্মিথ বিয়ের পর প্রথম দুই বছরের জন্য ঘুরতে বের হন ইউরোপে। দ্বিতীয় বছরে তাঁরা ইতালিতে অবস্থানকালে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লোরেন্স। তাঁর বয়স এক বছর হলে উইলিয়াম দম্পতি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।

ছোটবেলায় বাবার কাছেই পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় দুই বোনের। বড় বোনের পছন্দ ছবি আঁকা আর সেলাই করা। কিন্তু ফ্লোরেন্সের পছন্দ গণিত শেখা। তবে একটি জায়গায় দুই বোনের পছন্দ মিলে যেত। দুজনই গ্রামে ঘুরতে পছন্দ করতেন। ঘুরতে গিয়ে দেখা ফুলগুলো তাঁরা খাতায় নোট করে রাখতেন। বাসায় এসে হিসাব কষতেন, কোন ফুলের সংখ্যা বেশি। একটু বড় হলেই বাবার কাছে ইউক্লিড, অ্যারিস্টটল, বাইবেল ও রাজনৈতিক নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন নাইটিঙ্গেল। ফ্লোরেন্সকে তাঁর বাবা একটি নামীদামি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। নাইটিঙ্গেল সেখানে ফারসি, জার্মানি, লাতিন, দর্শন ও গণিত শিখতে থাকেন।

শৈশবেই ফ্লোরেন্স অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিলেন। তাঁর মা বেশির ভাগ সময় অবসর জীবন যাপন করতেন। তিনি প্রায়ই বাইরে ঘুরতে যেতেন, বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা দিতেন। কখনো যেতেন পার্টিতে। তাঁদের সমাজব্যবস্থাই ছিল এ রকম। অবসর সময়ে আড্ডা দেওয়া। ফ্লোরেন্সের বোনও মায়ের মতোই হয়েছিলেন। কিন্তু ফ্লোরেন্স এসব পছন্দ করতেন না। তিনি যেন এক অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি অবসর সময়ে খুঁজে দেখতেন আশপাশে কে অসুস্থ। একটু বড় হলেই যেতেন হাসপাতালে রোগী দেখতে। হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। রোগীদের দেখে নিজেই ব্যথিত হতেন। মরিয়া হয়ে উঠতেন সাহায্য করতে।

১৮৪০ সাল। ফ্লোরেন্সের বয়স ২০ ছুঁই ছুঁই। তিনি মা–বাবার কাছে এক আবদার করে বসলেন। সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু গণিত নিয়ে পড়তে চান নাইটিঙ্গেল। এ কথা শুনেই তাঁর মা উঠলেন খেপে, ‘বলে কী মেয়ে! তুমি গণিত শিখবে মেয়ে হয়ে? গণিত কি মেয়েদের পড়ার বিষয়?’ তবে তাঁর বাবা কিন্তু তেমন উচ্চবাচ্য করলেন না। কারণ, মেয়ের মধ্যে গণিতের প্রতি যে ভালোবাসা, তা তো তিনিই শৈশবে জ্বালিয়েছিলেন। তবে তিনি ফ্লোরেন্সকে বোঝালেন, মেয়েদের জন্য গণিত ছাড়া আরও অনেক ভালো বিষয় আছে। সেগুলোর কোনো একটা পড়ার উপদেশ দিলেন। কিন্তু নাইটিঙ্গেলকে বোঝানোর সাধ্য কার! তাঁর এককথা, ‘গণিত নিয়েই পড়ব।’ অবশেষে মা–বাবা রাগ ভুলে মেয়েকে অনুমতি দিলেন গণিত পড়ার। তবে শর্ত আছে। স্কুল বা কলেজে গিয়ে গণিত শেখা যাবে না। সমাজের তো একটা নিয়ম আছে। তাই ঠিক হলো, বাসায় গৃহশিক্ষকের কাছেই গণিতের চর্চা করবেন তিনি। রাজি হলেন ফ্লোরেন্স।

দুই

ফ্লোরেন্সকে পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো সিলভাস্টার নামের এক শিক্ষককে। এই শিক্ষকই পরে গণিতের ইনভ্যারিয়েন্ট তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। ফ্লোরেন্সেরও জানার আগ্রহ ছিল প্রচুর। অল্প দিনেই সিলভাস্টারের প্রিয় ছাত্রী হয়ে ওঠেন ফ্লোরেন্স। দ্রুত আয়ত্ত করলেন পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতিসহ গণিতের নানা শাখা। এরপর ফ্লোরেন্সের পরিচয় হয় বেলজিয়ামের আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ কুইলেটের সঙ্গে। তিনি ফ্লোরেন্সকে পরিসংখ্যান শিখতে সাহায্য করেন।

১৮৪৫ সালে আবার একটি বুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ফ্লোরেন্সের। তিনি নার্সিং শেখার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে চান। মা–বাবা এবারও যথারীতি খেপে উঠলেন। তাঁর এই চিন্তাভাবনাকে কঠোর হস্তে দমন করলেন উইলিয়াম ও স্মিথ। সে সময় নার্সিং পেশাকে ভালো চোখে দেখা হতো না। এবার ফ্লোরেন্স সফল হলেন না। তাই বাধ্য হয়ে আশপাশের অসুস্থ রোগীদের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে তাঁদের সেবাযত্নও করতেন। এতে ভীষণ বিরক্ত হতেন তাঁর মা ও বড় বোন। তাঁদের মানসম্মান নিয়ে যে টানাটানি পড়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ফ্লোরেন্সের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করতেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের কথায় কান দেননি ফ্লোরেন্স।

১৮৪৯ সাল। মা ও বোনের ওপর রেগে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ফ্লোরেন্স। সঙ্গে দুই পারিবারিক বন্ধু চার্লস ও সেলিনা। ঠিক করলেন, মিসর ও ইউরোপে ঘুরে বাড়িতে ফিরবেন। মিসরে গিয়ে নাইটিঙ্গেলের স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে গেল। সেখানকার বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সিং শেখার সুযোগ পেলেন। ১৮৫০ সালের শুরুর দিকে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার সেন্ট ভিনসেন্ট ডি’পল ইনস্টিটিউটে নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। একই বছর জুলাই মাসে ধর্মযাজক থিয়েডর ফিলেন্ডারের হাসপাতালটিও পরিদর্শন করেন। সেখানে চার মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে যান প্যারিসের সেন্ট জার্মেই হাসপাতালে। এক বছর ভবঘুরের মতো ঘুরেফিরে বিভিন্ন হাসপাতালে কাজের অভিজ্ঞতা খাতায় টুকে রাখলেন। ৩২ পৃষ্ঠার সেই খাতা ১৮৫১ সালে ছদ্মনামে প্রকাশ করেন ফ্লোরেন্স।

১৮৫৩ সাল। ফ্লোরেন্সের বয়স ৩৩ বছর। বিভিন্ন দেশ ঘুরে সেবিকার কাজ যথেষ্ট শিখে বাড়িতে ফিরলেন। ফিরতেই পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেধে গেল। পরিবারের সবার একই কথা—নার্সিংকে ভুলে যেতে হবে। তাঁর মায়ের মতে, ফ্লোরেন্সের জন্য পরিবারের মানসম্মান ডুবতে বসেছে। এমতাবস্থায়, ফ্লোরেন্স বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। লন্ডনের একটি হাসপাতালে সেবিকার চাকরি নিলেন। চাকরি নিতে অসুবিধা হলো না। ইতিমধ্যে তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছে বিভিন্ন দেশে সেবিকার কাজের অভিজ্ঞতা। নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে সেখানকার ব্যবস্থাপনা নতুন করে সাজালেন তিনি। ফ্লোরেন্স আসার আগে রোগীদের সাধারণ পানি খাওয়ানো হতো। ফ্লোরেন্স পানি ফুটিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। খাবার যেন পুষ্টিকর হয় এবং সহজেই গরম করা যায়, মনোযোগ দিলেন সেদিকেও। উন্নত হলো বিছানা, সরঞ্জাম ও খাবারের গুণগত মান। এক মাসের মধ্যে হাসপাতালের চেহারাই পাল্টে গেল। অসুস্থ রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। স্বাস্থ্যসেবায় দ্রুত উন্নতি করায় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

তবে ফ্লোরেন্স বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁর বাবা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে মাসিক খরচ হিসেবে ৫০০ ডলার পাঠাতেন মেয়েকে। তখনকার ৫০০ ডলার বর্তমান সময়ের ৬০ থেকে ৭০ হাজার ডলারের কাছাকাছি। সব টাকা খরচ করতেন না ফ্লোরেন্স। যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু খরচ করতেন তিনি। বাকি টাকা জমা করতে লাগলেন।

তিন

১৮৫৪ সাল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলছে ছয় মাসব্যাপী ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। ব্রিটিশ সরকার ফ্লোরেন্সকে অনুরোধ করল তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে যাওয়ার জন্য। তাঁর কাজ যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা করে সুস্থ করে তোলা। ফ্লোরেন্স দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলেন। তাঁকে ইস্তাম্বুলের কাছের একটি হাসপাতালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হলো। বলা হলো, তাঁর যা যা দরকার, সব সেখানেই আছে। আরও যদি কিছু দরকার হয়, তাহলে সরকার থেকে পাঠানো হবে। এরপর ফ্লোরেন্স নার্স বাছাই করতে শুরু করলেন। মোট ৩৮ জনের একটি দল তৈরি করে রওনা দিলেন ইস্তাম্বুলের দিকে।

হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, সরকারের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তো দূরের কথা, বিছানা পর্যন্ত নেই। আহত সৈনিকদের খালি মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মেঝে অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। ফলে বেশির ভাগ রোগীই কলেরায় আক্রান্ত। অনেকের ক্ষতস্থান পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এদিকে আরেক ঝামেলা শুরু করেছেন সেখানকার স্থানীয় চিকিৎসকেরা। তাঁরা নাইটিঙ্গেলের দলের কাউকে কাজ করতে দিতে রাজি নন। কোনো উপায় না পেয়ে নাইটিঙ্গেল তাঁর দলবল নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তবে নষ্ট করার মতো খুব বেশি সময়ও ছিল না তাঁর কাছে। যত দ্রুত সম্ভব, সরকারের কাছে বিভিন্ন জিনিসের জন্য সাহায্য চাইলেন ফ্লোরেন্স। কিন্তু সরকার তাঁকে কোনোভাবেই সাহায্য করল না। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সাহায্য করা যায়নি। এদিকে সরকারের আশায় বসে থাকলেও চলবে না। মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্থানীয় চিকিৎসকেরাও বাধ্য হলেন ফ্লোরেন্সের দলকে কাজ করতে দিতে। কিন্তু কাজ করবেন কী করে! হাসপাতাল যে গড়ের মাঠ। নিরুপায় হয়ে ফ্লোরেন্স নিজের জমানো টাকা কিছু কিছু খরচ করতে শুরু করলেন রোগীদের সেবায়। আর পত্রিকায় আবেদন করলেন সাহায্যের জন্য।

সৈনিকদের সুস্থ করে তুলতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন ফ্লোরেন্স। তারপরও প্রথম শীতে হাসপাতালের প্রায় চার হাজার সৈন্য মারা গেলেন। ফ্লোরেন্স এবার গণিতের সাহায্য নিলেন। হিসাব রাখতে শুরু করলেন, কোন মাসে কত জন সৈনিক মারা যাচ্ছেন। তাঁদের মারা যাওয়ার পেছনে কারণই বা কী? কে কোন অবস্থায় মারা গেলেন? হিসাব কষে একটি তালিকা তৈরি করলেন। মৃত্যুর কারণ তাঁর কাছে পরিষ্কার। তিনি প্রথমেই প্রতিটি কক্ষ ধুয়ে–মুছে পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। চারদিক থেকে যাতে বায়ু চলাচল করতে পারে, সে ব্যবস্থা করলেন। বিছানার ফাঁকে ফাঁকে যাতে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা থাকে, সে ব্যবস্থা করলেন। ময়লা–আবর্জনাযুক্ত ড্রেন পরিষ্কার করার দায়িত্ব দিলেন সরকারি কর্মচারীদের। চুনের পানি দিয়ে দেয়ালগুলো দুই–তিনবার ধুয়ে–মুছে পরিষ্কার করালেন।

এক সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নেমে এল। তিনি বুঝতে পারলেন, আহত সৈনিকদের জন্য আরও পুষ্টিকর খাবার দরকার। ফ্লোরেন্স সৈনিকদের টাকা বাড়িতে পাঠানোর একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাঁরা আরও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। সৈনিকদের জন্য একটি কফির দোকান খোলা হয়েছিল। তাঁদের মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য খবরের কাগজ ও বই পড়তে দেওয়া হতো।

শুধু সেবিকা নন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল একাধারে একজন বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, তথ্য সংগ্রহকারী, লেখক, সংগঠক, প্রচারক ও বিশ্লেষকও ছিলেন। একটানা কাজ করতে করতে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। ওদিকে তুরস্কেও সফল হওয়ার কারণে ফ্লোরেন্সের নাম আবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর মা ও বোন তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন। ফ্লোরেন্সের কাজকে সম্মানের সঙ্গে মেনে নেন এবং তাঁর জন্য তাঁরা গর্ব বোধ করেন। ফ্লোরেন্স ইস্তাম্বুল থেকে দেশে ফিরে এলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

চার

একসময় পত্রিকায় সাহায্য চেয়েছিলেন ফ্লোরেন্স। বেশ ভালো অঙ্কের টাকাও পেয়েছিলেন। সেখান থেকে কিছু খরচ হয়ে গেছে রোগীদের ওষুধ ও সামগ্রী কেনার জন্য। বাকি টাকা জমিয়ে রেখেছেন। সেই সঙ্গে নিজের জমানো সব টাকা মেলালেন। ১৮৬০ সালে সেই টাকায় লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে ট্রেনিং স্কুল চালু করেন ফ্লোরেন্স। সেখানে সেবিকাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই স্কুল নির্মাণের মাধ্যমে নার্সিং পেশাকে মানুষ সম্মানের চোখে দেখতে শুরু করে। মেয়েরা আগ্রহ নিয়ে নার্সিংকে পেশা হিসেবে নিতে শুরু করলেন। এর এক বছর আগে ১৮৫৯ সালে প্রথম নারী হিসেবে রয়েল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন ফ্লোরেন্স। ১৮৬৩ সালে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই নোটস অন হসপিটাল প্রকাশ করেন।

স্বাস্থ্যসেবায় পরিসংখ্যান ব্যবহার করে আধুনিক নার্সিংয়ের প্রতিষ্ঠা করেছেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। ভারতে থাকা ব্রিটিশ সৈনিকদের ওপরও তিনি ব্যাপক গবেষণা করেছেন। যদিও ভারতবর্ষে কখনো আসেননি তিনি। ব্রিটিশ সৈনিকদের মৃত্যুর হার হাজারে ৬৯ থেকে ১৮–তে নামিয়ে এনেছিলেন ফ্লোরেন্স। ব্রিটেনের মানুষের গড় আয়ু বাড়াতেও ব্যবহার করেছিলেন পরিসংখ্যান।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অপরের সেবায় নিজেকে সারা জীবন নিয়োজিত রেখেছেন। বিয়ে পর্যন্ত করেননি। তিনি মনে করতেন, সেবা করার জন্যই সৃষ্টিকর্তা তাঁকে পাঠিয়েছেন। তাঁর এই অমূল্য কাজের জন্য ১৮৮৩ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে রয়েল রেডক্রস পদক পেয়েছেন। রানি তাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। রানির সঙ্গে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে সঙ্গী হতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ফ্লোরেন্স প্রথম নারী হিসেবে ১৯০৭ সালে অর্ডার অব মেরিট পুরস্কার লাভ করেন।

৭০ বছর বয়সে ফ্লোরেন্স অসুস্থ হয়ে পড়েন। চলাফেরা কমিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট লন্ডনে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান এই মহীয়সী নারী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। ওয়েস্ট মিনার অ্যাবেতে শ্রেষ্ঠ মানুষদের পাশে তাঁকে কবর দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকেরা তাঁর দেহ গবেষণার জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও হয়নি। তাঁকে এম্বালি পার্কে সেন্ট মার্গারেট চার্চে মা–বাবার পাশে কবর দেওয়া হয়েছে। ফ্লোরেন্সকে সম্মান জানাতে বিদায়বেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন ব্রিটেনের রাজা সেন্ট পল ক্যাথেড্রাল। তাঁর মৃত্যুতে এক হাজার সেবিকা গান গেয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন।

সূত্র: ফেমাস সায়েন্টিস্ট ডট ওআরজি এবং ম্যাথ হিস্ট্রি ডটকম