অ্যাডভেঞ্চারের আগে...

বর্ষাকাল মানেই পাহাড়প্রেমী আর ঝরনাপ্রেমীদের উৎসবের শুরু। দেশের পার্বত্য এলাকাগুলোতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য ঝরনা এই সময়ে তাদের পূর্ণ সৌন্দর্য মেলে ধরে। তাই এই ঋতুতে হাজারো কাজ এক পাশে সরিয়ে রেখে পাহাড়প্রেমীরা ছুট দেয় দুর্গম সবুজে।

কথায় আছে, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। অতিরিক্ত বাতাস যেমন প্রকাণ্ড ঝড়ে রূপ নিয়ে ধ্বংস ডেকে আনে, অতিরিক্ত রোদ যেমন নদী-খাল শুকিয়ে তীব্র খরা নিয়ে আসে, তেমনি অতিরিক্ত বৃষ্টিও খাল-বিল-নদী ছাপিয়ে বন্যা নিয়ে আসে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে জুন-জুলাই-আগস্ট অতিবৃষ্টির মৌসুম, ফলে এ সময় বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়।

এ রকম দুর্যোগের মৌসুমেও অনেককে দেখা যায় বিপজ্জনক জায়গাগুলোতে বেড়াতে যাচ্ছে, ভরা বর্ষায় অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে বিপদ-আপদের তোয়াক্কা না করেই ঢুকে যচ্ছে বান্দরবান, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, সীতাকুণ্ড, মৌলভীবাজার কিংবা সীতাকুণ্ড, মিরসরাইয়ের পাহাড়ি অরণ্যে। কেউ কেউ বিপদে পড়ছে, কেউ কেউ আবার নিজের বুদ্ধি বা ভাগ্যের সহায়তায় বেঁচেও ফিরছে। যারা বেঁচে ফিরছে তাদের অনেকে হয়তো জানেই না, পাহাড় কতটা ভয়ানক হতে পারে! ফিরে আসা দলটা তাদের ঝরনায় লাফানো, নদীতে ঝাঁপানো কিংবা দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারের ছবি শেয়ার করছে ফেসবুকে, সেটা দেখে অন্যরাও কিছু না জেনে, না বুঝে ছুটছে ভয়ানক পথে!

প্রথমত, যে কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে বুঝতে হবে তুমি বা তোমরা সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত কি না। অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ারও একটা বয়স আছে। সঙ্গে অভিভাবক কিংবা অভিজ্ঞ কেউ থাকলে ভিন্ন কথা, তবে বয়স ১৮ না হলে দুর্গম জায়গাগুলোতে যাওয়া একেবারেই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, এই জায়গাগুলো পালিয়ে যাচ্ছে না, সময় হলে ঠিকই যেতে পারবে।

আর এ ধরনের জায়গায় যাওয়ার আগে অবশ্যই জেনে নিতে হবে পরবর্তী কয়েক দিনের আবহাওয়ার খবর। আগে যারা গেছে, তাদের কাছ থেকে জেনে নেবে ওই এলাকার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। ভারী বৃষ্টিপাত, বজ্রপাতের আশঙ্কা থাকলে কোনোভাবেই সে জায়গায় যাবে না। সঙ্গে রাখতে হবে লাইফ জ্যাকেট, দড়িসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

এই বর্ষায় পাহাড়ে প্রায়ই ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড’ হয়। ফ্ল্যাশ ফ্লাড মানে হঠাৎ করে কোনো এলাকার পানি বেড়ে যাওয়া, এই মুহূর্তে একটা পাহাড়ি খালে যতটুকু পানি আছে, ঠিক ১০ সেকেন্ড পরই সেখানকার পানি মাথার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। খুব সাবধান না হলে এবং ভাগ্যের সহায়তা না পেলে এই ফ্ল্যাশ ফ্লাডের হাত থেকে বাঁচা মুশকিল। যারা ফ্ল্যাশ ফ্লাড সম্পর্কে জানে না, তারা ফ্ল্যাশ ফ্লাডে পড়ে গেলে নিজেদের কীভাবে উদ্ধার করবে, এটাও জানে না। কাজেই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে অতিবৃষ্টির সময়টুকু এড়িয়ে এরপর পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া। পাহাড়ে ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা থাকলে সময়টা ১৫–২০ দিন পিছিয়ে দেওয়া। নিদেনপক্ষে ফ্ল্যাশ ফ্লাডে পড়ে গেলে কীভাবে নিজেকে উদ্ধার করতে হয়, সেটা জেনে যাওয়া।

আমি নিজেই তিনবার ফ্ল্যাশ ফ্লাডে পড়েছিলাম, একবার সীতাকুণ্ড রেঞ্জের ভেতরে ঝরনার নিচে তাঁবুতে ঘুমাচ্ছি, রাত আনুমানিক দুইটার দিকে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো, তেমন কিছুই নয়, কিন্তু আমাদের দলের অপু ভাই আর লিমন ভাই সঙ্গে সঙ্গে তাঁবু থেকে বের হয়ে সবাইকে এমনভাবে ডাকতে লাগলেন, যেন ডাকাত পড়েছে। যে ঘুম থেকে ওঠেনি তাকে কিল-ঘুষি দিয়ে পিটিয়ে ওঠানো হয়েছে। তাঁবুর বাইরে এসে আমরা বিরক্ত, ঝরনা-পানি-খাল যেটা যেমন ছিল তেমনই আছে, কোনো নড়চড় নেই, শুধু শুধু আমাদের ঘুমটা ভাঙানো হলো। কারও কথায় কান না দিয়ে তাঁরা আমাদের স্রেফ দুই মিনিট সময় দিলেন, এর মধ্যে তাঁবু গুটিয়ে সবকিছু পাঁজাকোলা করে পাশের যেকোনো উঁচু গাছে উঠে বসতে হবে। যদিও রিমঝিম বৃষ্টিতে পুরো পরিবেশ শান্ত, তবু তাঁদের কথায় কিছু একটা বিপদ টের পাচ্ছিলাম। কেউ টুঁ–শব্দ না করে দুই মিনিটের মধ্যে এলাকা খালি করে বৃষ্টির মধ্যে গাছে চড়ে বসলাম, ঝরনায় কোনো পরিবর্তন নেই।

এরপর মিনিট তিনেক পর হঠাৎ করে শুরু হলো পানির আক্রমণ, হুড়হুড় করে ঝরনার পানি বাড়া শুরু করল, ওপর থেকে পাথর, নুড়ি, গাছের ডাল উড়ে উড়ে এসে নিচে পড়ছে, সাঁই সাঁই করে পানি কয়েক ফুট বেড়ে গিয়ে একটু আগে আমরা যেখানে ঘুমাচ্ছিলাম সেটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এক ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টি থামতেই সব পানি নেমে গেল, সবকিছু আগের মতো হয়ে গেল, এতক্ষণ যেখানে পানির দুর্দান্ত প্রতাপ ছিল, সেখানেই খাঁ খাঁ, দেখে মনেই হচ্ছে না একটু আগে কী অপার্থিব জলোচ্ছ্বাস ছিল এখানে! অভিজ্ঞ দুই ট্র্যাকার সতর্ক না করলে হয়তো ভেসে যেতাম আমরাও। তাই সব সময় অ্যাডভেঞ্চারে যেতে হবে অভিজ্ঞ কারও সঙ্গে, যারা প্রকৃতির পরিবর্তন দেখেই বলে দিতে পারে কী হতে যাচ্ছে।

এতক্ষণ যেখানে পানির দুর্দান্ত প্রতাপ ছিল, সেখানেই খাঁ খাঁ, দেখে মনেই হচ্ছে না একটু আগে কী অপার্থিব জলোচ্ছ্বাস ছিল এখানে!

তারপরও এ রকম ফ্ল্যাশ ফ্লাডে যদি তোমরা কখনো পড়ে যাও, তাহলে দিশেহারা না হয়ে নিচের কয়েকটা বিষয় একটু ভালোভাবে মনে রেখো:

  • ফ্ল্যাশ ফ্লাডের সময় কোনো অবস্থাতেই খাল, পাহাড়ি ছড়া বা নদী পার হবে না, হওয়ার চেষ্টাও করবে না। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানি সর্বোচ্চ ঘণ্টাখানেক বা ঘণ্টা দুয়েক থাকে, এরপরই ছড়া, খালের চেহারা আগের মতো হয়ে যায়, তখন পার হবে। প্রয়োজনে পানি না কমা পর্যন্ত এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকবে, তবু পার হওয়া যাবে না। কারণ, ফ্ল্যাশ ফ্লাডে শুধু পানিই প্রবাহিত হয়, এমন নয়, এর সঙ্গে পানির নিচে বড় পাথর, গাছের গুঁড়ি, ভাঙা বাঁশের মাথা-কঞ্চি এমন অনেক কিছুই থাকে, যা যেকোনো মুহূর্তে জীবনকে হুমকির মুখে ফেলবে।

  • কোমর ডুবে যায়, এমন স্থান দিয়ে বৃষ্টির সময় পার হবে না। কারণ, কোমর পর্যন্ত পানি উঠলেই ব্যালান্স হারিয়ে ফেলবে। আর ঢলে অনেক সময় গোড়ালি পর্যন্ত পানিও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

  • তুমি যেখানে আছ, সেখানে হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে না, চারপাশ হয়তো শুকনো খটখটে। কিন্তু মনে রাখবে যে পাহাড়ের ওপর কোথাও ওই সময় বৃষ্টি হতেও পারে, সেই বৃষ্টির পানিও ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণ হতে পারে। আর এ ঘটনাটা এতই দ্রুত ঘটবে যে তুমি ঠিকমতো বুঝে ওঠারও সময় পাবে না। কাজেই পানির উচ্চতার তারতম্য হচ্ছে কি না, এটা সব সময় খেয়াল রাখতে হবে।

  • আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পানির রং। নীল বা নীলচে রং অথবা পরিষ্কার পানি হলে ঠিক আছে। কিন্তু পানির রঙে যদি ন্যূনতম পরিবর্তন আসে বা ঘোলাটে হয়ে যেতে থাকে এবং পানির উচ্চতা বাড়তে থাকে, তাহলে বিন্দুমাত্র দেরি না করে ওই খাল বা ছড়া থেকে নিরাপদ উচ্চতায় উঠে যেতে হবে। কারণ, পানির রং ঘোলা হওয়া মানেই ওপর থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি আসছে।

  • সরু ঝিরি বা পাহাড়ি পানিসমৃদ্ধ ট্রেইলে ঝরনা দেখলেই বুনো আনন্দে উদ্ভট আর অশালীন হইচই বা চিৎকার না করে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, অনেক সময় হইচইয়ের কারণে ঝরনার ওপরের পানির গর্জন টের পাওয়া যায় না, ফলে আসন্ন ফ্ল্যাশ ফ্লাড সম্পর্কে কেউ অবগত হয় না।

  • পাহাড়ি ঢলের সময় খাল বা ছড়ার মাঝে নলখাগড়া–জাতীয় কিছু জঙ্গল দেখলে সেগুলোতে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। কারণ এগুলো ভাসমান এবং দুর্বল শিকড়ের। পানির তোড়ে এগুলো ভেসে যাবে।

  • এই মৌসুমে ঝরনার একেবারে তলায় মাথা দিয়ে গোসল করাটা বিপজ্জনক। কারণ, ঢলের কারণে ওপর থেকে বড় পাথর, নুড়ি পাথর বা গাছের গুঁড়ি ভেসে এসে মাথায় পড়তে পারে। এ ছাড়া ঝরনার নিচের পিচ্ছিল জায়গা যত দূর সম্ভব পরিহার করতে হবে।

  • বর্ষার সময়ের ট্রিপগুলোতে টিমের সঙ্গে বড় দড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। খাল, নদী, ঝিরি পার হওয়ার সময় কীভাবে দড়ি ব্যবহার করে পার হতে হয়, সেই টেকনিকগুলো আগে থেকে জেনে রাখা ভালো। অন্যথায় এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে আতঙ্কের জন্যই সব এলোমেলো হয়ে যেতে পারে।

  • ফ্ল্যাশ ফ্লাডের সময় সাঁতার কোনো কাজে আসবে না, তুমি যত ভালোই সাঁতার পারো না কেন, কোনো অবস্থাতেই ফ্ল্যাশ ফ্লাডের সময় নদী, খাল, ঝিরি পার হবে না। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানি সাধারণত ১-২ ঘণ্টার মধ্যে নেমে যায়, কাজেই তাড়াহুড়ো করে নদী পার হওয়ার চেষ্টা না করে কোথাও বসে অপেক্ষা করাই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।

  • সব সময় পাশের বন্ধুর দিকে সতর্ক খেয়াল রাখবে, এমন হতে পারে যে তুমি সব জানো, কিন্তু তোমার বন্ধু পাহাড়ে নতুন।

পানির অপর নাম যেমন জীবন, তেমনি পানি অনেক জীবননাশেরও কারণ। কাজেই ফ্ল্যাশ ফ্লাড সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব জেনেই বেড়াতে যাওয়া উচিত। মনে রাখবে যেকোনো দুর্গম অঞ্চল থেকে হাসপাতালের অবস্থান অনেক দূরে। একটা আঙুল মচকালেও নিকটবর্তী হাসপাতালে পৌঁছাতে পুরো একটা দিন লেগে যেতে পারে। কাজেই পাহাড়ে প্রথম সতর্কতা হলো সাবধানতা। যে যত বেশি সাবধান থাকবে, তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। তারপরও যদি খারাপ পরিস্থিতে পড়েই যাও, তাহলে মাথা ঠান্ডা রাখো। কারণ, মাথা ঠান্ডা রাখলেই বাঁচবে প্রাণ।