আঁকা-লেখায় সুকুমার

সুকুমার রায়

মনে মনে একজন মানুষের কথা ভাবো তো, যে ফিজিকস আর কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স করা, আবার লন্ডনে ফটোগ্রাফি আর লিথোগ্রাফি নামের এক বিশেষ ধরনের ছাপচিত্র নিয়ে কঠিন কঠিন পড়াশোনা করছে। কেমন হতে পারে সে দেখতে? চশমা? হ্যাঁ চশমা থাকতেই পারে, এত এত পড়াশোনা করলে চোখে চাপ পড়বেই। দাড়ি–গোঁফ? হুম, থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। মুখের ভাব? এটা অবশ্যই ভারিক্কি হবে, তাই না? আর স্বভাবে অবশ্যই গম্ভীর, তাই তো?

হলো না, এখানে এসে মিলল না!

কারণ, এই সব বর্ণনা আসলে বাংলা ননসেন্স হিউমারের রাজা সুকুমার রায়ের! যিনি তাঁর মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য রেখে গেছেন মজার মজার ছড়া আর লেখার অমৃত ভান্ডার।

তোমরা তো জানো যে তাঁর বাবা বাংলা সাহিত্যের দিকপাল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায় আবার সুকুমার রায়ের ছেলে। এটাও তোমাদের অজানা নয়। দুই দিকে দুই অসামান্য প্রতিভাবান মিলে একটা ব্র্যাকেটের মতো মাঝখানে ধরে রেখেছে যে ক্ষণজন্মা ডাবল অনার্স মোটা চশমার মানুষটাকে, সে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে একটু অন্য রকম হতে বাধ্য। এই অনন্য সাধারণ মানুষটার যা যা তোমরা হয়তো বিশদ জানো না, সেগুলো নিয়ে আজকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক।

মন্ডা ক্লাব

অথবা MONDAY CLUB। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় সুকুমার করেছিলেন ননসেন্স-ক্লাব। আর বিলেত থেকে ফিরে গড়ে তোলেন এই সোমবারের ক্লাব/ মান্ডে ক্লাব/ মন্ডা ক্লাব নামে এক সাহিত্য আসর। সে সময়ের গণ্যমান্য অনেকেই ছিলেন এই ক্লাবে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন এখানে। সবাই মিলে যাকে বলে এক্কেবারে ননসেন্স আড্ডা। ননসেন্সের মানে কিন্তু যা-তা বা যাচ্ছেতাই নয়, অনেকটা বলতে পারো হেঁয়ালিপনা। সেটার কিছু উদাহরণ আমরা একটু পরই দেখব, তার আগে দেখো ননসেন্স ক্লাবের বৈঠকের জন্য মাঝেমধ্যেই কী মজার সব ছড়া লিখেছিলেন সুকুমার রায়। একবার হঠাৎ ক্লাবের সম্পাদক সাহেবের খোঁজ নেই, মানে আড্ডা পণ্ড হয় হয় অবস্থা। তখন সুকুমার লিখলেন—

সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব-
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি ত যায় যায়।
তাই বলি, সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধূলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।
রকমারি পুঁথি যত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে।
করজোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।

ছন্দমিল, অন্ত্যমিল ইত্যাদির কথা না হয় বাদই দাও, এমন কলকল করে বয়ে যাওয়া ভাষায় কি জলবত্ তরলং বক্তব্য। পড়লে মনেই হবে না কোন ছড়া পড়ছি। মনেই হবে না কেউ বসে ভেবে মিলিয়েছে লাইনগুলো। মনে হবে এটাই বুঝি তাঁর ভাষা। সুকুমারের সহজাত রসবোধ আর একেবারেই অপ্রত্যাশিত সব শব্দের সঙ্গে শব্দের মিল—যাকে বলে একমেবাদ্বিতীয়ম!

তবে শুধু এই ছড়াতে থেমে গেলে তো আর তাঁকে এত বড় মানুষ বলা হতো না। এই মন্ডা ক্লাব বা ননসেন্স ক্লাব ছিল তাঁর ঘরোয়া আড্ডা। এর বাইরে কত কী যে তিনি লিখেছেন। প্রায় সব লেখাই বের হতো সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিষ্ঠিত সন্দেশ পত্রিকায়। এই সন্দেশ নিয়ে না বললে তাই সুকুমার রায়কে নিয়ে বলা সম্পূর্ণ হচ্ছে না।

সন্দেশ ও হাফটোন ব্লক প্রিন্ট

সন্দেশ মূলত শিশুদের জন্য উপেন্দ্রকিশোর রায় কর্তৃক প্রকাশিত একটি পত্রিকা। বলতে গেলে উপেন্দ্রকিশোর একাই বের করতেন ১৯১৩ সাল থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটি। সেটার লেখা, আঁকা, প্রুফ (বানান শুদ্ধি) মেলানো, এমনকি ছাপা এসব একাই করতেন তিনি।

সন্দেশ ছাপার প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলা দরকার। ঘটনাটা অবশ্য উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে (সুকুমার রায়কে বোঝার জন্য তাঁর বাবাকেও বোঝা জরুরি)। ঘটনাটা হলো উপেন্দ্রকিশোর এই সন্দেশ পত্রিকার ছাপা নিয়ে এতটাই সিরিয়াস ছিলেন যে কীভাবে ছাপা আরও ভালো করা যায়, সেটা ভাবতে ভাবতে ছাপার জগতে রীতিমতো নতুন একাধিক মুদ্রণ পদ্ধতিই আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন!

বাবার এই কাজের ধারাবাহিকতায় সুকুমার যে আরও এগিয়ে নেবেন সবকিছু তা তো বলাই বাহুল্য। আসলে বাবার ওই সন্দেশ পত্রিকা না থাকলে সুকুমার ঠিক সুকুমার হতেন কি না, তা বলা কঠিন। কারণ, বিলেত থেকে ফিরে এই সন্দেশ–এই সমানে লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর একেবারে পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেন সন্দেশ পত্রিকা আর বাবার প্রতিষ্ঠিত প্রেস ইউ রয় অ্যান্ড সন্সের। এরপর টানা আট বছর আমৃত্যু সেটার সম্পাদনা করে গেছেন সুকুমার রায়। এই পত্রিকাতেই প্রথম সুকুমারের অনবদ্য প্রতিভার প্রকাশ পায়, সন্দেশ–এ ছাপা হওয়া সুকুমারের প্রথম ছড়ার নাম ‘খিচুড়ি’ নাম শুনে হয়তো চিনলে না, কিন্তু তার প্রথম লাইনগুলো বললেই চিনে ফেলবে, লাইনগুলো হলো—

হাঁস ছিল সজারু (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল হাঁসজারু, কেমনে তা জানি না।

সেই ছড়াটা তোমাদের অনেকেরই মুখস্থ। সেই ছড়াতেই বাংলার পাঠক প্রথম শুনতে পায়, হাঁসজারু, বকচ্ছপ, বিছাগল আর গিরগিটিয়ার কথা। সুকুমারের আবোল তাবোল বইয়ের প্রায় সব ছড়াই কিন্তু আগে সন্দেশ–এ বের হয়েছিল। যদিও ভিন্ন নামে। রামগরুড়ের ছানা, বাবুরাম সাপুড়ে ইত্যাদি। তোমাদের সবার পড়া সেই অবাক জলপান নাটকটিও এই সন্দেশ–এই বের হয়েছে, আর সেই সঙ্গে আরও দুটো নাটক, ‘হিংসুটে’ ও ‘মামা গো’ সন্দেশ–এই প্রকাশিত। এ ছাড়া পাগলা দাশু, হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি, খাই খাই–এর মতো বিভিন্ন ছড়াও এখানেই বের হয়েছিল। তার মানে সন্দেশ আর সুকুমার একেবারে অবিচ্ছেদ্য। আমৃত্যু তিনি এই পত্রিকায় সংযুক্ত ছিলেন, এমনকি মৃত্যুর আগে অসুস্থ অবস্থাতেও এর কাজ থামাননি।

তবে সন্দেশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু রায় পরিবারের পত্রিকা হয়েই থাকেনি, এখানে লিখেছেন—

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ রায়, কামিনী রায়সহ আরও অনেকে।

ড্রয়িং

সুকুমার রায়ের আরেকটা অঙ্কন প্রতিভার কথা বলতেই হবে। বাবাও অাঁকতেন দুর্দান্ত, পরে তাঁর ছেলে সত্যজিৎ রায় তো একেবারে পেশাদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টিস্টই ছিলেন। মাঝে সুকুমার রায় তাঁর অনন্য ড্রয়িং দিয়ে ভরাট করে রেখে গেছেন পাতার পর পাতা। প্রায় সবই তাঁর নিজের লেখার জন্য অাঁকা। আর সেকি দারুণ সাবলীল লাইন। তাঁর এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনার দৃশ্যায়ন আসলে অন্য আর কেউ করতে পারত কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। কোন আঁকার কথা বলব বল?

যেহেতু সুযোগ পাওয়া গেছে আমি আমার পছন্দেরগুলো দিয়েই শুরু করি, সেটা হলো ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি’। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে মিল থাকলেও এর ক্যারেক্টারটা সুকুমার এমনই অন্য এক কল্পনা জগতে নিয়ে গেছেন যে তার ধারেকাছে আর কেউ ঘেঁষতেই পারবে না। গল্পটা আমি বলব না, কারণ অনেকেই পড়োনি হয়তো, মূল ভাবনাটা হলো এক পরিব্রাজকের ডায়েরি। তিনি তাঁর এক আজব অভিযানে যে অবিশ্বাস্য সব প্রাণীর দেখা পেয়েছেন, তারই বর্ণনা নিয়ে লিখেছেন, অনেকটা পরবর্তী সময়ে তাঁর ছেলে সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র প্রফেসর শংকুর মতো। সুকুমার রায়ের মতো এ রকম কনসেপ্ট আর্ট সে সময় বাঙালি কেউ করেছেন ভাবতেই কেমন একটা গা শিউরানো অনুভূতি টের পাচ্ছি। এবার হেঁসোরামের কিছু প্রাণীর নাম শোনো আর ছবি দেখো—

বাঁয়ে বেচারাথেড়িয়াম আর ডানে চিল্লানসোরাস। মানে কিনা বাঁয়ের জন বড়ই বেচারা, আর ডানেরজন চিলচিতকারে পটু নাম তাই চিল্লানসোরাস। কি অসাধারণ নামকরণ, ডাইনোসরের মতো নামের শেষে ‘সোরাস’ আর প্রথমে একেবারে আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি চিল্লানি আর ওদিকে বেচারা। কিন্তু কোথাও তাল কাটেনি। আর ড্রয়িংয়ে কার কী ভূমিকা, তা এক পলকেই বোঝা যাচ্ছে।
আর ল্যাগব্যাগে এই পাখির (!) নাম আর কী হবে, ল্যাগব্যাগর্নিস।
গোমড়ামুখো: গোমড়াথেরিয়াম
হ য ব র ল-এর বেড়াল
হেঁসোরামের বন্দুকের মাথায় রাখা ক্যাপ সবই এক

এরপর বলতে হবে তাঁর আরেক অবিশ্বাস্য ননসেন্স গল্প ‘হযবরল’–এর কথা। সেখানকার অসংখ্য চরিত্রের একটা হলো এক গণিতবিদ কাক- শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। ৪১ নম্বর গেছোবাজার, কাগেয়াপটির এই কাকেরা সব ধরনের হিসাবি ও বেহিসাবি, খুচরা ও পাইকারি সব গণনার কাজ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করে থাকে। এই বর্ণনার সঙ্গে যেন এই আঁকাটা না হলে সেটা অসম্পূর্ণই থেকে যেত। কাকের হাতে ধরা শ্লেট, মুখে চকখড়ি, সিরিয়াস মুখে সেটা ধরে আছে এক হাত নাকি পায়ে? নিচে ঝুলছে দলিল–দস্তাবেজ। একটা ব্যাপার দেখার আছে, সুকুমারের এই ড্রয়িংয়ে কিন্তু ক্যারেক্টারগুলো কার্টুন না। মানে মনে হচ্ছে একেবারে সত্যিকারের একটা কাকই এটা ধরে বসে আছে। সুকুমার যে কার্টুনের মতো করে কাক আঁকতে পারতেন না এমন না, তার মানে এখানে রিয়েলিস্টিক করে কাক আঁকার একটা কারণ হতে পারে সেটা হলো আঁকায় বিশ্বাসযোগ্যতা আনা। মানে দেখে মনে হবে একেবারে আসল কাক, মানে হয়তো আসলেই এই কাক্কেশ্বর কুচকুচে কোথাও না কোথাও আছেন, আর খুচরা-পাইকারি হিসাব মিলিয়ে যাচ্ছেন।

একই গল্পের আরেক চরিত্র গেছোদাদা, সে যে কখন কোথায় থাকে তা বলাই এক মুশকিলের ব্যাপার। আর হযবরল-এর সেই ফিচেল বেড়াল, যা কিনা সুকুমার সমগ্র বইয়ের প্রচ্ছদে এসে সব বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনে ঢুকে গেছে। সেটার এক চোখ টেপা বাঁকা হাসি যেন সুকুমারের গোটা সাহিত্যের মূল মেজাজটাই ধরে বসে আছে। এই বিড়াল যারা দেখেছ আর হ য ব র ল যারা পড়েছ, তার নিশ্চয়ই গল্পটার সঙ্গে লুই ক্যারলের অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর মিল পেয়েছ? বিড়ালটা সেই চেশ্যায়ার ক্যাটের মতো না? হেঁয়ালি ভরা উক্তিতে যে চেশ্যায়ার ক্যাটকেও ছাড়িয়ে গেছে, যে কিনা চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালের তালব্য শ (!) আর রুমালের মা মিলে যে বানিয়ে দিল চশমা। ননসেন্স মানে কিনা যার সরাসরি কোনো মানে হয় না কিন্তু কোথাও আবার কোনো ছন্দপতন নেই এমন প্রায় অসম্ভবের মতো সাহিত্যের এই ধারাটি কিন্তু পৃথিবীতেই সহজলভ্য না। লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, পৃথিবীর বহু দেশের বহু লেখকের লেখা তিনি পড়েছেন, অনেক ভাষা জানতেন বলে এমনকি অনেকগুলো মূল ভাষাতেই পড়েছেন কিন্তু সুকুমারের মতো এমন উইটি আর ননসেন্স এক করে লেখার মতো কাউকে পাননি। এ ব্যাপারে তাঁর মতে, সুকুমার রায়ই বিশ্বসেরা।

শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে
অবুঝ
দাঁড়ের কবিতা
গেছোদাদা

সুকুমার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আঁকাআঁকি শেখেননি, তাই প্রথম দিকের বেশ কিছু ড্রয়িংয়ে কিছুটা নবিশ ছাপ দেখা গেলেও পরের দিকে সেটা একেবারে পেশাদার আঁকিয়েদের মতো হয়ে গেছে। যেমন অবুঝ নামের ছড়ার এই আঁকা বা সাথের ‘দাঁড়ের কবিতা’র আঁকাটা খেয়াল করলেই তা বোঝা যাবে। যেমন কনফিডেন্ট লাইন, তেমনি রিদম আর কম্পোজিশন। বিশেষ করে দাঁড়ের কবিতার ড্রয়িং তো অনবদ্য। তবে আমার ব্যক্তিগত মত, সুকুমারের ড্রয়িংয়ের মধ্যে সবচেয়ে দারুণ কাজটা হলো তাঁর ট্যাঁশগরু, এখানে একই সঙ্গে যেমন ক্যারেক্টার ডিজাইন, তেমন আঁকাআঁকির ব্যাকরণের প্রয়োগ মেলে, যাকে বলে হিরণ্ময়—

কিম্ভূতকিমাকার এই গরু হারুদের অফিসে বসে যেন জাবর কাটছে সুখে। ড্রয়িংটার বিশেষত্ব হলো এখানে আঁকাআঁকির ব্যাকরণ অনেকটাই সার্থকভাবে মানা হয়েছে। ডান দিকের কোনাকুনি একটা লাইট আসছে বলে তার বাঁ পাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে ছায়ায় মেলানো। সেটা করা হয়েছে শুধু কলমের ক্রসহ্যাচ (কলমে এদিক–ওদিক টেনে জালের মতো করে যেই শেডটা দেওয়া) করে। আর পশুর অ্যানাটমিকে যথাসম্ভব সত্যিকারের মতো করে আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে, আবারও সেই বিশ্বাসযোগ্যতা। মানে কিনা এই জিনিস আসলেই আছে। আর শেষ মুনশিয়ানা হলো গলার মাফলারটা। একেবারে ১০০ শতাংশ দেশি বাঙালি বাবুটি যেন। চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখানা মসত, ফিটফাট কালোচুলে টেরিখানা চোস্ত। যে আবার খায় খালি সাবানের স্যুপ আর মোমবাতি। পায়ের কাছে সম্ভবত সে দুটোই পড়ে আছে। যেমন ড্রয়িং তেমনি তার বর্ণনা, দুর্দান্ত ননসেন্স ছন্দমিল-

ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।

...

একদিন খেয়েছিল ন্যাক্ড়ার ফালি সে-
তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে।

সুকুমারের ড্রয়িং আর তাঁর লেখা আসলে একটা ছাড়া অন্যটা সম্পূর্ণ হয় না। আর এই লেখার সঙ্গে এই ড্রয়িংও আসলে একজনই করতে পারতেন, সুকুমার নিজে।

আদিম কালের চাঁদিম হিম

ভাবতে পারো এই অসম্ভব গুণী মানুষটা মারা গেছেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে? এবং সেটা খুবই করুণভাবে। সে সময়ে একটা রোগ ছিল স্থানীয়ভাবে যাকে বলত কালাজ্বর। জীবনের শেষ আড়াই বছরের বেশির ভাগই তাঁর কেটেছে রোগশয্যায়। এর মধ্যেও তাঁর কাজ কিন্তু থেমে ছিল না। এমনকি প্রিন্টিং নিয়ে একাধিক নতুন টেকনিকের খসড়া করা ছিল তাঁর সে সময়ের নোটবুকে। নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও অসাধারণ মানসিক স্থৈর্যের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। লেখালেখি থামেনি। মুছে যায়নি মুখের হাসি। নিজের প্রথম বই আবোল–তাবোল তখনো প্রেসে, সেটার শেষ ছড়াটি তিনি লিখে শেষ করলেন বিছানায় শুয়ে।

আজকে দাদা যাবার আগে
বলব যা মোর চিত্তে লাগে-
নাই বা তাহার অর্থ হোক
নাইবা বুঝুক বেবাক লোক।

... ... ... ... ... ...

আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,
গানের পালা সাঙ্গ মোর।

ছড়াটিতেই কি টের পাচ্ছ না যে একটা বিদায়ের সুর তিনি দিয়ে যাচ্ছেন? তাঁর মৃত্যুর নয় দিন পর বের হয় আবোল তাবোল। উদ্ভট খামখেয়ালে বাঙালি-বাংলা ভাষাভাষীদের একেবারে চিত্তের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে বিদায় নেন সুকুমার। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘দেহ নহে মোর চির নিবাস, দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ’। সত্যি একেবারে তাই, দেহের বিনাশে তাঁর যেন কিছুই বিনাশ হয়নি। বরং নতুন করে প্রতিদিন তিনি জন্ম নিচ্ছেন প্রতিটি পাঠকের মধ্যে।

বি.দ্র : লেখাটির বেশ কিছু তথ্য দীপক সেনগপ্তের লেখা ‘চিরনবীন সুকুমার রায়’ নামের লেখা প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে।