আঁকিবুঁকির আঁকান্তিস!

গভীর মনোযোগে আঁকছে আঁকিবুঁকির দল
ছবি: তামান্না তাসমীম

রাস্তার পাশেই একটা চা-দোকানের পাশে বসে আছে কিছু তরুণ-তরুণী। সবার হাতেই একটা করে খাতা। পেনসিলে ঘষঘষ করে দ্রুত দাগ টেনে যাচ্ছে খাতায়! দোকানের ছেলেটা তাদের জন্য চা নিয়ে এসেছে। কাপ রাখতে গিয়ে খাতায় চোখ পড়তেই অবাক সে। আরে! খাতায় তো তারই ছবি! ওই যে চাওয়ালা মামা, তাদের ছোট্ট দোকানটা! এই তো পাশের বেঞ্চের লোক দুটো কথা বলছে! আর ওইটা কি পাশের আপুটার চেহারা না?

তার বিস্ময় দেখে হাসল খাতা হাতে নেওয়া তরুণ। অন্যদের খাতাও এ রকম নানা আঁকিবুঁকিতে ভরে উঠেছে—গাছে ঝুলে থাকা সাইনবোর্ড, কুণ্ডলী পাকানো তারের জালি, বেলুনওয়ালা, শুয়ে থাকা কুকুর...সব খাতাই এসব ছবিতে ভরপুর!

ব্যাপারটা কী? কৌতূহল নিশ্চয়ই হচ্ছে তোমারও। আসলে এরা সবাই আঁকান্তিস গ্রুপের সদস্য। আঁকান্তিস গ্রুপ? সেটা আবার কী? তাহলে খুলেই বলি।

যাত্রা হলো শুরু

আঁকান্তিস হচ্ছে বাংলাদেশি তরুণ আঁকিয়েদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম। এর শুরুটা হয় ২০১০-এ। ‘উন্মাদ’ এর কার্টুন বিভাগের নির্বাহী সম্পাদক কার্টুনিস্ট মেহেদী হকের হাত ধরে।

‘আমাদের দেশের আঁকাগুলোর তুলনায় বাইরের আঁকা ভালো। এর কারণ হলো আমাদের চারপাশটা দেখার মতো চোখের অভাব। এটা কাটিয়ে উঠতে স্কেচবুক-খাতা-পেনসিল ছাড়া গতি নেই।’—শিল্পী সব্যসাচী মিস্ত্রীর এই কথা থেকেই আঁকান্তিসের আইডিয়াটা পান তিনি।

‘আমাদের দেশের আঁকাগুলোর তুলনায় বাইরের আঁকা ভালো। এর কারণ হলো আমাদের চারপাশটা দেখার মতো চোখের অভাব। এটা কাটিয়ে উঠতে স্কেচবুক-খাতা-পেনসিল ছাড়া গতি নেই।’—শিল্পী সব্যসাচী মিস্ত্রীর এই কথা থেকেই আঁকান্তিসের আইডিয়াটা পান তিনি।

সব্যসাচী মিস্ত্রীর সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করে আরও গোছানো রূপ নেয় আঁকান্তিস। ‘Anyone can draw!’ স্লোগান নিয়ে শুরু হয় আঁকান্তিসের কার্যক্রম। শুরুর ধারণাটা ছিল কার্টুনিস্টদের একটা নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি করা। আঁকাআঁকিতে বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে নিজেদের ভিজ্যুয়ালটাকে আরও ভালো করা।

শুরু থেকেই আঁকান্তিসের সঙ্গে ছিলেন মিতু, শামীম, তন্ময়। সবার সামনে গাইড হিসেবে থাকতেন সব্যসাচী মিস্ত্রী। এসেছেন আরও অনেক নতুন আঁকিয়েও। আর নেতৃত্বের দায়িত্বটা চালিয়ে যাচ্ছেন মেহেদী হক।

খসড়া খাতার স্কেচবুকিং!

আঁকান্তিসের সবচেয়ে মজার জিনিসটাই স্কেচবুকিং। মানে নিজের স্কেচবুকটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়া। ক্লাসে-রাস্তায়-মাঠে-আড্ডায় যেখানেই হোক, চারপাশের অসংখ্য উপাদান নিয়ে ইচ্ছেমতো স্টাডি করা; আর সেসবের খুঁটিনাটি বুঝে স্কেচবুকে এঁকে ফেলা।

বিষয় বইমেলা। আসিফুর রহমানের স্কেচবুক থেকে

আঁকান্তিসের অন্যতম সদস্য কার্টুনিস্ট আসিফুর রহমান বলেন, ‘সাধারণত আমাদের আশপাশের জিনিসগুলোর কোনো রেফারেন্স পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের কিছু আঁকতে গিয়ে গুগল হাতড়েও কিছু পাই না। যেমন আমি বাসায় বসে একটা চায়ের দোকানের দৃশ্য আঁকতে চাই। তখন সাধারণভাবেই আমরা আমাদের স্মৃতি থেকে আঁকতে চাইব। কিন্তু ভালোভাবে আঁকতে চাইলে রেফারেন্স দরকার। চা জ্বাল দেওয়ার সময় চাওয়ালার হাতটা কেমন থাকে, লেবু কাটার সময় আঙুলগুলো কীভাবে নড়ে অথবা দোকানের নিচু বেঞ্চটায় বসার সময় লোকজনের আকৃতিটা কেমন থাকে, সেটা বোঝার জন্য সরাসরি দেখে আঁকা ছাড়া কোনো উপায় নেই! তাই স্কেচবুকে এসব খুঁটিনাটি দ্রুত তুলে রাখাটাই হলো স্কেচবুকিং। এর মাধ্যমে আমরা আসলে বাংলাদেশটাই আঁকি।’

আমরা আমাদের আশপাশটা প্রতিদিনই দেখলেও, অনেক কিছুই সেভাবে খেয়াল করি না। সে জন্যই গুগল দেখে স্ট্যাচু অব লিবার্টি এঁকে ফেলতে পারব, কিন্তু আমাদের রাজু ভাস্কর্য আঁকতে গেলে হয়তো আটকে যাব। তাই আমাদের দেখার চোখটাকে আরও মেলতে হবে।

প্রত্যেকে নিজের ইচ্ছেমতো তো আঁকেই। তবু আঁকান্তিস গ্রুপ থেকে প্রায়ই আয়োজন করা হয় স্কেচবুকিংয়ের। সবাই মিলে কোন একটা জায়গায় গিয়ে করা হয় স্কেচবুকিং। সময়-স্থান আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়, যেন আগ্রহী যে কেউই যোগ দিতে পারে এতে।

ঢাকা বাণিজ্য মেলা। মেহেদী হকের স্কেচবুক থেকে

স্বপ্ন আছে যত!

‘শুরুটা ছোট্ট হলেও আঁকান্তিসের স্বপ্ন অনেক বড়!’ বললেন মেহেদী হক। ‘আমাদের ধারণাটা ছিল নিজেদের একটা ফোরাম তৈরি করা। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পাঁচ বছরে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। ফেসবুকে আঁকান্তিস গ্রুপটা এখন তেরো শতাধিক মানুষের একটা পরিবার। শুধু স্কেচবুকিংই না, গ্রুপে শেয়ার হচ্ছে সব ধরনের পেইন্টিং, স্কেচ, ডুডল, ডিজিটাল ড্রয়িং, কার্টুনসহ সব ধরনের আঁকাআঁকিই। তাই এটা কাজ করছে একটা রিসোর্স সেন্টার হিসেবেও!’ যে কেউ অন্যের কাজ দেখতে বা নিজের কাজ দেখাতে পারছে, কোনো কিছুতে আটকে গেলে পারছে সমাধান চাইতে। ফলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটাও বাড়ছে। আর এভাবে আমরা সত্যিই বেশ কিছু ভালো মানের আর্টিস্ট পাচ্ছি।’

জানা গেল আঁকান্তিসের ড্রিম প্রজেক্টগুলোর কথা। আমাদের দেশে কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রটা তেমন বড় তো নয়ই, বরং চ্যালেঞ্জিং। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তাই আঁকান্তিসের স্বপ্নটা হলো ফোরাম তৈরির পাশাপাশি একটা ইনস্টিটিউশনও তৈরি করা। ‘শিখন্তিস’ নামের সে প্রতিষ্ঠানে যে কেউ পারবে ইচ্ছেমতো আঁকাআঁকি শিখতে। সেই স্বপ্নের পেছনেই কাজ করে যাচ্ছে আঁকান্তিস গ্রুপ।

আর সবার কাছে আঁকান্তিসকে পরিচিত করতে এ বছরই আঁকান্তিসের শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী করার পরিকল্পনাও আছে তাদের।

দেশের বিভিন্ন পরিবহন উঠে এসেছে স্কেচবুকের পাতায়

এবার পালা তোমারই!

পেছনের বেঞ্চের কেউ ঘুমিয়েও পড়েছে মাথা রেখে। যারা সামনের দিকে বসেছে, তাদের সেই সুযোগ নেই, তারা অতিষ্ঠ হয়ে উসখুস করছে। অঙ্ক ক্লাসে উপপাদ্যের একঘেয়ে লেকচারের সময় কথা বলতে গিয়ে স্যারের চোখে ধরা পড়ে কেউ কেউ খাচ্ছে স্যারের দশ কেজি ওজনের একেকটা ধমক। এ রকম বিরক্তিকর মুহূর্তে তোমার কি হাত চলে যায় খাতার শেষ কাগজটায়? সাদা পৃষ্ঠায় কলমের কালিতে স্যারের চেহারায় ঝাঁটার মতো গোঁফটা আরও বড় হয়ে যায় তোমার খাতায়? জানালার বাইরের বড় গাছটার ডালে পাখির বাসার বাচ্চাগুলোও কি কল্পনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে ধরা দেয় সেই কাগজে? বন্ধুরাও দেখে তোমাকে জোরাজুরি করে তাদের জন্যও কিছু এঁকে দিতে?

তাহলে তোমার মতো আঁকিয়েদের জন্যই আঁকান্তিস। চাইলে আজই যোগ দিতে পারো এখানে। আঁকান্তিসের ফেসবুক গ্রুপ ছাড়াও এদের খোঁজখবর জানতে ঘুরে আসতে পারো akantis.blogspot.com ঠিকানায়।

আঁকান্তিসে তুমি দেখতে পারবে অসংখ্য আঁকিয়ের কাজ, দেখাতে পারবে নিজেরটাও। সবার সহযোগিতায় সত্যিকারের এক আঁকিয়েতে পরিণত হবে ধীরে ধীরে। আর সপ্তাহান্তে মজার আউটডোর স্কেচবুকিং ইভেন্ট তো থাকছেই। চাইলে খাতা-কলম নিয়ে বিনা দ্বিধায় আসতে পারো সেখানেও। দেখবে বাসার নিচের সাধারণ গলিটাও কতটা অসাধারণ হয়ে ধরা দেয় তখন! একঘেয়ে ক্লাসের খুঁটিনাটি, স্যারের শার্টের ভাঁজ, মোটা ফ্রেমের চশমাটা, লেকচার শুনতে শুনতে বিরক্ত বন্ধুর হাই তোলার দৃশ্য আঁকতে আঁকতেই সময়টা কেটে যাবে! তাহলে আর দেরি কেন? স্কেচবুক আর পেনসিলে সীমাহীন সব কল্পনা ছড়িয়ে দাও আজই!

(কিশোর আলোর মার্চ ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)