আদিম গুহায় খরগোশ ও টিয়া পাখি

ঘাসে ঢাকা গুহার প্রবেশপথ

গুহার নাম ‘ইন্ডিয়ান ইকো ক্যাভার্নস’। আমরা ওখানে বেড়াতে যাই আদেমিরা আদেমভকে নিয়ে। সঙ্গে ছিল আমাদের পোষা খরগোশ পাতাবাহার। আদেমিরা আমাদের প্রতিবেশীর আট বছরের ছোট্ট মেয়ে। সে খরগোশ খুব ভালোবাসে। গুহায় যাওয়ার পথে তুলতুলে লোমশ পাতাবাহার আদেমিরার কোলে বসে ছিল।

আমরা তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর শহরে থাকি। বসনিয়ায় যুদ্ধ চলছে, তাই আদেমিরার মা-বাবা বসনিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করতে এসেছেন। খুবই হাসিখুশি মেয়ে আদেমিরা, স্কুলে তৃতীয় গ্রেডে পড়ছে। তবে সে জন্ম থেকে কথা বলতে পারে না। কানেও শুনতে পায় না। যুক্তরাষ্ট্রে এসে সে সাইন ল্যাংগুয়েজ বা ইশারায় কথা বলা শিখেছে। স্কুলে পড়াশোনা করতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। তার সঙ্গে স্লেট-পেনসিলের মতো ছোট্ট একটি বোর্ড ও মার্কার থাকে। যারা সাইন ল্যাংগুয়েজ বুঝতে পারে না, তাদের সঙ্গে সে বোর্ডে মার্কার দিয়ে লিখেও কথা বলতে পারে।

কিছুদিন আগে আমরা জাহাজে চড়ে ক্যারিবিয়ান সাগরের বাহামা দ্বীপে বেড়াতে যাই। তখন সমস্যা দেখা দেয় পাতাবাহারকে নিয়ে। কারণ, পোষা জীবজন্তু নিয়ে জাহাজে চড়া নিষেধ। তাকে বাসায় তো একা রেখে যাওয়া যায় না। তখন আদেমিরা পাতাবাহারকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়। সে তাকে শাকসবজি ও গাজর খাওয়াতো। সপ্তাহে দুবার গোসলও করিয়েছে। আর বিকেলবেলা ঘাসের চত্বরে পাতাবাহারকে একটু হাঁটাহাঁটিও করিয়েছে সে।

ইন্ডিয়ান ইকো ক্যাভার্নসের গুহায় ছুটির দিনে পোষা জীবজন্তু কোলে নিয়ে ঢোকা যায়। বাল্টিমোর শহর থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা চলে আসি গুহার প্রবেশমুখে। গুহার অবস্থান সোয়াতারা নামক পাহাড়ি ঝোরার পাশে। লতানো সবুজ ঘাসে ঢাকা গুহার প্রবেশমুখে আছে সুড়ঙ্গ। কিন্তু আসামাত্র গুহাতে ঢুকে পড়া যায় না। ছোট্ট একটি সমস্যা দেখা দেয়। যে গাইড সবাইকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গুহার সবকিছু দেখাচ্ছেন, তিনি আমাদের অপেক্ষা করতে বলেন। কারণ, তিনি সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলতে পারেন না। স্থানীয় হাইস্কুলের একটি মেয়ে জেসিকা সাইন ল্যাংগুয়েজ জানে। জেসিকা এখানেই আছে। কথা বলতে পারে না বা কানে শোনে না—এ রকম কেউ ছুটির দিনে গুহাতে এলে জেসিকা তাকে সাহায্য করে।

আদিবাসী ইন্ডিয়ান সেজেছে অনেকে

আমাদের বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হয় না। জেসিকাকে পাওয়া যায় ঘাসের চত্বরে। সে চার-চারটা কুকুর কোলেকাঁখে নিয়ে বসে আছে। বেশ বড়সড় মেয়ে জেসিকা। এবার নবম গ্রেড থেকে উঠবে দশম গ্রেডে। সাইন ল্যাংগুয়েজে গুহা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলার কাজ সে করে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে। জেসিকা কুকুর খুব ভালোবাসে। ছুটির দিনে সে কুকুরের দেখাশোনা করে অল্প কিছু পয়সার বিনিময়ে। গুহায় আজ ছোট্ট ছোট্ট পোষা প্রাণীদের কোলে নিয়ে ঢুকতে দিচ্ছে। তবে খাঁচায় করে না আনাতে চারটি কুকুরকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাই জেসিকাকে দেখাশোনার ভার দিয়ে কুকুরের মালিকেরা গুহায় ঢুকেছে। তারা গুহা থেকে বেরোলেই সে আদেমিরাকে সাহায্য করবে। জেসিকা আমাদের ৩০-৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে।

আমরা সময় কাটানোর জন্য চলে আসি গুহার শপিং সেন্টারে। ওখানে বিক্রি হচ্ছে গুহার ছবি, মানচিত্র, খনিজ পাথরের নমুনা, পটেটো চিপস, ক্যান্ডি ও চকলেট বার। আর ভাড়ায় পাওয়া যাচ্ছে রাজকন্যা, যোদ্ধা-বীর বা দেবদূতের পোশাক-আশাক। বাচ্চারা চাইলে তাদের পছন্দমতো পোশাক ভাড়া নিয়ে তা পরে গুহায় ঢুকতে পারে। দু-তিনটি ছেলেমেয়ে আমাদের সামনে ভাড়া করে আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের রংচঙে কাপড়চোপড়। তারা ড্রেসিংরুম থেকে তা পরে বেরিয়ে এলে তাদের অন্য রকম দেখায়। আদেমিরা কিন্তু রাজকন্যা, দেবদূত বা জাদুকরের ড্রেস ভাড়া করতে চায় না। সে পাতাবাহারকে কোলে চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। পাতাবাহার খরগোশ হলেও বেড়াতে খুব পছন্দ করে। সে দুটি দেশ, অনেকগুলো শহর, পাহাড় ও পাইনবনে আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে। বেড়াতে এলে সে ভয় পায় না একেবারে। তবে যতটা না দেখে, তার চেয়ে কান খাড়া করে শোনে আরও বেশি।

চুইয়ে পড়ছে পানি

শপিং সেন্টারে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে আদেমিরার দেখা হয়। তার নাম আমানদা। সে তার পোষা টিয়া নিয়ে গুহা দেখতে এসেছে। সবুজ এ টিয়া পাখির নাম ভায়োলা। আমানদা আদেমিরাকে বলে যে ভায়োলা হচ্ছে বেহালার মতো একটি বাদ্যযন্ত্র। তার টিয়া গান ভালোবাসে বলে তার নাম দেওয়া হয়েছে ভায়োলা। আদেমিরার সঙ্গে কথাবার্তা চালাচালিতে আমানদার কোনো অসুবিধা হয় না। সে তার বোর্ডে মার্কার দিয়ে লিখে জানায় যে তার মা পাখি পুষতে ভালোবাসেন। তার বাসায় আছে পাখিদের জন্য একটি ক্লিনিক। অসুস্থ কোনো পাখিকে তাদের বাসায় নিয়ে এলে তার মা তার চিকিৎসা করে দেন। আমানদা উজ্জ্বল রং ভালোবাসে। তাই নখে সে নীল ও কমলা রঙের নেইলপলিশ দিয়েছে। টিয়া পাখির সবুজ রংও তার খুব প্রিয়।

শপিং সেন্টারে আদেমিরার বয়সী দুটি বাচ্চা নিয়ে অপেক্ষা করছেন এক চীনা দম্পতি। এঁরা আদিতে চীনের লোক হলেও যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন। অনেক বছর আগে মা-বাবা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে চাকরি করতে আসেন। তাঁদের ছেলেমেয়ে দুটির জন্ম এখানে, গুহার কাছেই লেনকাস্টার শহরে। তাঁদের ছেলেটি সিরামিকের কৌটায় করে তার পোষা ঝিঁঝি পোকা নিয়ে এসেছে। নতুন কারও সঙ্গে দেখা হলে আমার কথাবার্তা বলতে খুব ভালো লাগে। তাই তার কাছে ঝিঁঝি পোকা সম্পর্কে জানতে চাই। সে বলে যে, ঝিঁঝি আছে অনেক প্রকারের। তবে সে যে ঝিঁঝি পোকা পালছে, তা হচ্ছে ‘অচেটা ডমেসটিকাস’ প্রজাতির ঝিঁঝি। এদের লালন-পালন করা খুব সহজ। ঘরের অন্ধকার কোণ, টেবিলের তলা বা ড্রেসিং টেবিলের পেছনে এরা বসবাস করতে ভালোবাসে। সন্ধ্যার দিকে তার ঝিঁঝি পাখায় পাখা ঘষে আওয়াজ করে। তা শোনায় যন্ত্রসংগীতের মতো। দিনে সে পড়ে পড়ে ঘুমায়, গান করতে তার মন চায় না। তবে খিদে পেলে পনেরো সেকেন্ড পরপর আওয়াজ করে—‘গ্রিও মিও ড্রিও।’

পাতাবাহার কোলে আদেমিরা

ঝিঁঝি পোকাওলা ছেলেটির ছোট বোন কাচের বয়ামে করে নিয়ে এসেছে একটি গোল্ডফিশ। আমি তার কাছে জানতে চাই—তোমার মাছ বেড়াতে পছন্দ করে? মেয়েটি লাজুক, সে মিনমিনিয়ে জবাব দেয়, গোল্ডফিশটি কোথায় কী হচ্ছে বিশেষ কিছু বুঝতে পারে না। তবে সে খুশি হলে চোখের তারায় সবুজ আলো জ্বেলে বয়ামের ভেতর লেজে ঘাই মেরে মেরে সাঁতরায়।

গাইডের সঙ্গে জেসিকা এসে পড়তেই আমরা সবাই গুহায় ঢুকি। প্রবেশপথ একটু অন্ধকার। কাঠের সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে হয় বেশ নিচে। কাছেই পাহাড়ি ঝোরা সোয়াতারা ঝিরঝিরিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তার শব্দ গুহার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। তাতে সবকিছু মনে হয় খুবই রহস্যময়। যেতে যেতে গাইড গুহা সম্পর্কে কথাবার্তা বলেন। জেসিকা সাইন ল্যাংগুয়েজের ইশারায় তা আদেমিরাকে বুঝিয়ে বলে।

গাইড আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ান ‘সাসকেহানোক’ গোত্রের লোক। তিনি মাথায় পালকের মুকুট পরে আছেন। তাঁর নাম ‘উইকাপি ওয়ানকাতুইয়া’। এ নামের অর্থ হচ্ছে ‘আকাশের তারকা’। তাঁর আদিবাসী গোত্রে মানুষের নাম হয় বেশ মজার। তাঁর বোনের নাম ‘সমুদ্রের প্রবাল’, আর খালার নাম ‘পাহাড়ের পাইনবন’। আজ থেকে চার শ বছর আগে এ গুহার পাশে বাস করত তাঁর পূর্বপুরুষ ‘সাসকেহানোক’ গোত্রের আদিবাসী ইন্ডিয়ানরা। তাদের পেশা ছিল শিকার ও মাছ ধরা। পরে এ এলাকায় শিকার করা যায় এমন পশুপাখির সংখ্যা কমে আসে। তখন তারা চলে যায় অন্য এলাকায়। সাসকেহানোক গোত্রের কিছু কিছু মানুষ বর্তমানে বাল্টিমোর শহরে বাস করে। গাইড নিজেও বাল্টিমোরে বাস করেন।

আমানদার পোষা টিয়া—ভায়োলা

আমরা চলে আসি মাটির অনেক নিচে বেশ বড়সড় একটি জায়গায়। গাইড এবার জানান যে লাখ লাখ বছর আগে এখানে ছিল চুনাপাথরে তৈরি একটি পাহাড়। এ বিশেষ ধরনের চুনাপাথরের নাম ‘বেকমানটাউন’। ঝোরার পানি পাহাড়ে চোয়াতে শুরু করলে চুনাপাথরে ক্ষয় হয়। পাথর পানিতে ক্ষয় হতে হতে অনেক বছরে তৈরি হয়েছে এ গুহা। এর বয়স ৪৪০ মিলিয়ন বছর। অনেক বছর আগে এখানে আদিবাসীরা মশাল জ্বালিয়ে মাদল বাজিয়ে নাচগান করত। এ জন্য এ জায়গার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান বলরুম’ বা ‘আদিবাসীদের নাচঘর’। এ নাচঘরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এখানে কথা বললে প্রতিধ্বনি হয়। গাইড বিষয়টি পরিষ্কার করে বোঝানোর জন্য একটু বাঁশি বাজিয়ে শোনান। বাঁশির সুর সত্যিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তিনি বাঁশি রেখে আদিবাসীদের ভাষায় গান ধরেন। গানের কথা খটোমটো হলেও তাতে চমৎকার সুর খেলে। তিনি গেয়ে চলেন: ‘কানুপা ওজইয়াপি ওলোওয়ান/ টাটিওয়ি টয়ে ওলোয়ান’। এ গানের অর্থ হচ্ছে, ‘বাজাও বাঁশরী হে বন্ধু/ ছড়িয়ে দাও সুর চারদিকে’।

তিনি আবার বাঁশরীতে সুর তুললে অবাক হয়ে দেখি আমানদার পোষা টিয়া ভায়োলা মাথা দোলাচ্ছে। সে ডানার পালক কাঁপিয়ে, মাথা হেলিয়ে-দুলিয়ে সুরে-তালে যেন নাচে। আমানদা বোর্ডে মার্কার দিয়ে লেখে, ভায়োলা যখন প্রথম আমাদের বাসায় আসে, তখন সে ছিল ছোট্ট পাখির ছানা। আমার মা তাকে প্রতিদিন রেকর্ড বাজিয়ে গান শোনাত। ভায়োলা কিছু কিছু সুর খুব পছন্দ করে। একটি নাচের সংগীত তার খুব প্রিয়। এ সংগীতের নাম ‘বলেরো’।

টর্চলাইটের আলোয় আরেকটি সুড়ঙ্গ ধরে আমরা সামনে এগিয়ে যাই। দুপাশে দেয়াল থেকে ঝুলছে নানা আকারের পাথর। সাদাটে রঙের কিছু পাথর থেকে চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে জল। একটি ছেলে তার পোষা গিরগিটিকে জলের ফোঁটার কাছে তুলে ধরে। গিরগিটি জিব বের করতে যায়, কিন্তু গাইড তাকে নিষেধ করেন। ছেলেটি আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের মতো পোশাক পরেছে। সে গিরগিটিকে তার মাথায় পালক বসানো টুপিতে বসিয়ে দেয়। গাইড তাতেও বিরক্ত হন। তিনি তাকে গিরিগিটিকে হয় খাঁচায় ঢোকাতে, না হয় দুহাতে ধরে থাকতে বলেন। কারণ গিরগিটি যদি ছুটে পালায়, তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এখানে সুড়ঙ্গের ছাদে ঝুলছে কিছু বাদুড়।

চুইয়ে পড়ছে পানি

এবার আমরা চলে আসি পাথরে খোদাই করা এক পুকুরের পাড়ে। এ পুকুরের পানির রং সবুজাভ। গাইড বাতি নিভিয়ে দিয়ে আমাদের চুপচাপ দাঁড়াতে বলেন। তারপর তিনি বাতি জ্বালালে দেখি ভাসছে কয়েকটি মাছ। আলো জ্বলতেই মাছগুলো ডুবে যায়। মাছগুলো অন্ধ। তাদের জন্ম গুহার এ অন্ধকার পুকুরে। এরা কখনো সূর্যের আলো দেখেনি, তাই তাদের চোখও ফোটেনি। আদিবাসীরা বিশ্বাস করে, অন্ধ মাছ দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যের লক্ষণ।

হঠাৎ দেখি একটি ছেলে তার পোষা সাপ ছেড়ে দিয়েছে পুকুরের পাড়ে। পোষা সাপে বিষ থাকে না, তাই ভয়ের কিছু নেই। সাপ ছেড়ে দেওয়া ছেলেটিও পরে আছে আদিবাসীদের পোশাক। তার চেহারার সঙ্গে গিরগিটি ছেড়ে দেওয়া ছেলের মুখের মিল আছে। সম্ভবত এরা চাচাতো বা খালাতো ভাই। গাইড তাকে কঠোর ভাষায় সাপটি খাঁচায় পুরতে বলেন। কারণ পোষা সাপটি পুকুরের পানিতে সাঁতার দিলে অন্ধ মাছগুলো ভয় পেয়ে যাবে।

আমাদের গাইডের নাম আকাশের তারকা। এখন তাঁর টর্চলাইটের আলোয় গুহার দেয়ালেও ফুটছে লাল-নীল-বেগুনি তারার নকশা। তিনি আদিবাসীদের পোশাক পরা ছেলে দুটির পেছন পেছন হাঁটছেন আর কড়া নজরে রাখছেন, যাতে তারা গিরগিটি বা সাপ ছাড়তে না পারে। আমরা সরু ভিজে পথ ধরে পা টিপে টিপে চলে আসি সুন্দর এক জায়গায়। হলঘরের মতো এ জায়গার নাম ‘ওয়েডিং চ্যাপেল’ বা ‘বিয়ের গির্জা।’ সত্যি সত্যিই এক দম্পতি এখানে বিয়ে করতে এসেছে। তরুণ ছেলেটি কালো স্যুটের সঙ্গে সবুজ বো টাই পরেছে। কনেটির পরনে সাদা গাউন। তার মাথার টায়রাটি সবুজ রঙের। তাদের সামনে পাথরের ওপর রাখা রাংতায় মোড়া কেক। পাশে রাখা কেক কাটার ছুরি। বিয়ের কেক খুব মজাদার হয়। আদেমিরাও কেক খেতে ভালোবাসে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। একটু লোভ হয়। ভাবি, পুরোহিত বিয়ে পড়িয়ে দিলেই কনে কেক কাটবে। তখন হয়তো আমাদেরও ভাগ দেবে। গাইড আমাদের মনের ভাব বুঝতে পেরে ফিসফিসিয়ে বলেন, গুহায় খাবার নিয়ে ঢোকার নিয়ম নেই। বিয়ের এ কেকটি নকল, পাথরের তৈরি। বর-কনে ছবি তুলবে। বিয়ের ছবিতে কেক থাকলে ভালো দেখায়, তাই নকল কেকটি সামনে রাখা হয়েছে।

কুকুর কোলে জেসিকা

গাইড ও জেসিকাকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু মজাদার বিয়ের কেকের কথা আমি ভুলতে পারি না। তো শপিং সেন্টার থেকে কিনে ফেলি এম অ্যান্ড এনের চকলেট চিপস দেওয়া কয়েকটি কাপ-কেক। কাপ-কেক বিয়ের কেকের মতো না হলেও খেতে দারুণ মিষ্টি। ঘাসের চত্বরে পাতা আছে কাঠের বেঞ্চ ও টেবিল। তাতে বসে আমরা মজা করে কাপ-কেক খাই। অনেকক্ষণ আদেমিরার কোলে বসে থেকে পাতাবাহার অস্থির হয়ে পড়েছে। তাকে ঘাসে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমানদা তার সিডি-ওয়াকম্যানে ‘বলেরো’ মিউজিকটি বাজিয়ে আদেমিরাকে শোনায়। তারপর ইয়ারফোন একটি ক্লিপ দিয়ে ভায়োলার গলার কাছে আটকে দেয়। গান শুনতে পেয়ে সে মাথা দোলায়। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি, টিয়ে পাখিটি বাদ্যের তালে টেবিলের ওপর নড়েচড়ে পাখা ঝাপটিয়ে নাচছে।

আমানদা আদেমিরার বোর্ডে লিখে ভায়োলার কাহিনি বলে। তাদের এক বৃদ্ধা প্রতিবেশী টিয়া পাখির ছানা ভায়োলাকে উপহার হিসেবে পান ক্রিসমাসের সময়। ছোট্ট পাখির ছানাটি কিছু খেতে চাইত না। তার মাকে ছেড়ে এসেছে তো, তাই ছানাটি সারা রাত কুঁইকুঁই করে কাঁদত। বৃদ্ধা তাকে নিয়ে আসেন আমানদার মায়ের পাখির ক্লিনিকে। ওখানে ছানাটিকে ড্রপার দিয়ে খাওয়ানো হয়। তারপর আমানদার মা তাকে গানের রেকর্ড বাজিয়ে শোনাতেন। গান শুনলে পাখির ছানাটি শান্ত হতো। বিশেষ করে ‘বলেরো’ বলে মিউজিকটি বাজানোর সময় তিনি নিজেও একটু একটু নাচতেন। ভায়োলা তার মায়ের নাচ দেখে দেখে নিজেও মাথা দুলিয়ে পালক ছড়িয়ে নাচতে শুরু করে। প্রতিবেশী বৃদ্ধা পাখির যত্ন নিতে পারতেন না। তাই তিনি ভায়োলাকে ক্লিনিকে দান করে দেন।

আজকে গুহায় পাতাবাহার ও ভায়োলাকে নিয়ে বেড়াতে পেরে খুব ভালো লাগল। আদেমিরা ও আমানদা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠছে। আমানদা বুঝতে পেরেছে যে আদেমিরাকে সবকিছু বোর্ডে লিখে দিয়ে বোঝাতে হয় না। হাতের ইশারায় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বললেও চলে। কারণ, একটু আস্তে কথা বললে আদেমিরা আমানদার ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে বুঝতে পারে সে কী বলছে। কথা হয় যে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব আর কোন গুহায় পোষা পাখি বা খরগোশ নিয়ে ঢুকতে দেয়। এ তথ্য পাওয়ার পর আগামী কোনো ছুটির দিনে পাতাবাহার ও ভায়োলাকে নিয়ে অন্য কোনো গুহায় বেড়াতে যাব।

(কিশোর আলোর মে ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)