আনা ফ্রাঙ্ক হওয়ার উপায়

যেবার ডায়েরি নিয়ে ধরা পড়লাম, সে দিনটি আমার পরিষ্কার মনে আছে। আমার বিছানার তোশকের নিচে আমি ডায়েরি লুকিয়ে রাখতাম, স্কুল থেকে ফিরে দরজা বন্ধ করে স্কুলের নানা ঘটনা নিয়ে লিখতাম। আজ কার কলম চুরি হয়েছে, কে কার প্রেমে পড়েছে, স্যারের চেয়ারে চুইংগাম লাগানোর অসাধারণ আইডিয়াটা যে আমারই, আরও কত কিছু। স্কুলের পাঠ্যবই হিসেবে আমরা আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি তত দিনে পড়ে ফেলেছি, তাই বহু বছর পর একদিন তোশক উল্টিয়ে কেউ আমার ডায়েরি পেয়ে যাবে এবং আমি বিখ্যাত হয়ে যাব, সেই সম্ভাবনাকেও পুরোপুরি উড়িয়ে দিতাম না। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটালেন আমার মা। স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা রেগে টং। তাঁর হাতে আমার লাল ডায়েরি। বেদম জেরায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আমাদের ক্লাসের সুমনকে কি আমি সত্যি ভালোবাসি? বাসার টিভির রিমোট কি আমিই জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছি? বাবা যেই পার্কার কলম খুঁজে পাচ্ছেন না, সেটি তাহলে আমি চুরি করেছি? এরপর ডায়েরিটা স্থান পেল মায়ের আলমারিতে।

কবি বলেছেন, যেজন লিখিতে চায়, তাকে কি আর আটকে রাখা যায়! দুই দিন পর আমি আবার ডায়েরি লেখা শুরু করলাম। নিউমার্কেটে তখন ছোট্ট তালাওয়ালা কিছু ডায়েরি পাওয়া যেত। টিফিনের টাকা জমিয়ে সেই ডায়েরি কিনলাম। সেই ডায়েরিতে পাড়ার তুখোড় ফুটবলার সামির আর ব্রায়ান অ্যাডামসের প্রতি আমার প্রেমের গল্পও ঠাঁই পেল। বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। ওই তালাচাবি ডায়েরির যেই চাবি, তা এতই ছোট যে একদিন পকেট থেকে পড়ে কোথায় জানি হারিয়ে গেল।

আমার বাবা ডাক্তার। তাই ওষুধ কোম্পানির কল্যাণে আমাদের বাসায় প্রচুর ডায়েরি থাকত। সেখান থেকে একটা পছন্দ করে আমার তিন নম্বর ডায়েরি লেখা শুরু করলাম। হ্যান্ডমেড কাগজ, প্রচ্ছদে জলরং দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করা। তত দিনে জীবনের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। তাই নিয়মিত ডায়েরি লিখতে পারতাম না। অনেক ভেবে একটা উপায় বের করলাম। যখন যেখানে থাকি, যা যা দেখে মজা লাগে বা মনে হয় লিখে রাখা উচিত, তা টুকরো কাগজে লিখে রাখতাম। পরে বাসায় এসে ডায়েরিতে স্টেপল বা আঠা দিয়ে সেঁটে দিতাম। ধীরে ধীরে আমার ডায়েরির ওজন যত বাড়তে থাকল, আমার আনা ফ্রাঙ্ক হওয়ার সম্ভাবনাও জোরদার হতে থাকলো।

ডায়েরি মানে শুধু দৈনন্দিন ঘটনার বিবরণ, তা কিন্তু নয়। প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে দেশের কোন আইনগুলো পাল্টে ফেলব, বিল গেটসের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে কী উপদেশ দেব, আমার প্রিয় প্লেনের ছবি, ওয়ারফেজের গানের লাইন, ই ই কামিংসের কবিতার প্রিয় অংশ, কত কিছুই না ছিল ডায়েরির পাতায় পাতায়। তারিখ দিয়ে এন্ট্রি করাতে হঠাৎ পাতা ওল্টালে তিন মাস আগে কী ভাবছিলাম, তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেকেই আমার মতো ডায়েরি লেখা বিষয়ে বেশ খুঁতখুঁতে। ভালো জেল কলম ছাড়া লেখা যাবে না, মার্জিন দিয়ে লিখতে হবে, লেখার মাঝখানে যাতে কলমের কালি শেষ না হয়ে যায়, ইত্যাদি।

২০০৪ সাল। ঢাকা শহরের অনেক ঘরেই ইন্টারনেট সংযোগ এসেছে। ই-মেইল অথবা ব্রাউজিংয়ের পাশাপাশি গেম খেলা ও ফোরামে লেখা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সেই সময়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে ব্লগিং ব্যাপারটা আবিষ্কার করলাম। মাইস্পেসে অ্যাকাউন্ট খুললেই ‘জার্নাল’ অপশন চালু হয়ে যায়, সেখানে কাগজ-কলম ডায়েরির মতো লেখা যায়। এটির মজার বিষয় হলো, যেকোনো জায়গা থেকে সেখানে নতুন লেখা যোগ করা যায়, পাসওয়ার্ডের সুবাদে মায়েদের হাতে ধরা খাওয়ার আশঙ্কা জিরো। এরপর ব্লগার আর ওয়ার্ডপ্রেসের সন্ধান পেলাম। ব্লগ অর্থাৎ ‘ওয়েব লগ’, ব্লগিং করা মানে ওয়েবে নিজের একটা ঠিকানা তৈরি করা, যেখানে নিতান্তই ব্যক্তিগত ভাবনা ‘পোস্ট’ আকারে প্রকাশ করা সম্ভব। ব্লগের লিংক ‘শেয়ার’ করলে সেই পোস্ট সবাই পড়তে পারবে, কমেন্টও করতে পারবে। ব্লগের ঠিকানা নিজ নামে দেওয়া যায়, যেমন kishoralo.blogspot.com। এর পাশাপাশি প্রতিটি ব্লগের নিজস্ব ডিজাইনের বাইরে ব্লগটিকে যেকোনো ‘থিমে’ সাজানো সম্ভব। যারা ভ্রমণপিয়াসী, তাদের জন্য যেমন প্লেন-বাসের ছবি দিয়ে থিম সাজানো যায়, যারা খুব ঘরকুনো, তারাও নিজ রুমের ছবি দিয়ে দারুণভাবে ব্লগ ডিজাইন করতে পারবে। ব্যক্তিগত ব্লগ সাজানোর জন্য কোনো প্রোগ্রামিং জানার প্রয়োজন নেই, কিন্তু যাদের খেলনা গাড়ির পার্টস খুলে দেখার অভ্যাস আছে, চাইলে কোডিং শিখে নিজের ব্লগকে ভেঙে ওয়েবসাইটে পরিণত করতে পারবে। এ সময়ে গুগল করলে ব্লগার আর ওয়ার্ডপ্রেস ছাড়াও অনেক ব্লগিং প্লাটফর্ম পাওয়া যায়, যেমন টামব্লার, টাইপপ্যাড ইত্যাদি।

(কিশোর আলোর জুলাই ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)