‘আমি চড়লেই ঘোড়া কথা শোনে’ — তাসমিনা আক্তার

বিশাল সবুজ মাঠটার চারপাশে শত শত মানুষ। বেশ উত্তেজনা সবার মধ্যে। এক পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি ঘোড়া। একেকটার গায়ের রং একেক রকম। সাদা, কালো কিংবা বাদামি। প্রতিটি ঘোড়ার ওপর বসে আছে একজন করে ঘোড়সওয়ার। সবাই বেশ শক্তসমর্থ। তাদের এক হাতে ধরা ঘোড়ার লাগাম, অন্য হাতে চাবুক। চোখে-মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। বাঁশি ফুঁ দিলেই ছুটতে হবে সামনে। যার ঘোড়া সবার আগে সীমানারেখা ছোঁবে, সে হবে প্রথম! আর প্রথম হলেই পুরস্কার।

বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার আগে ঘোড়সওয়ারদের দিকে একবার তাকালেন খেলা পরিচালনাকারী। সবার মুখেই উত্তেজনা। কিন্তু এক পাশে সাদা ঘোড়ার ওপর শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে ১০-১১ বছর বয়সী একটা মেয়ে। বড় বড় ছেলের সঙ্গে এই মেয়ে ঘোড়া ছোটাবে? পারবে মেয়েটা? যদি পড়ে যায়? একটু ভেবে বাঁশিতে ফুঁ দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ধুলো উড়িয়ে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াগুলো। দর্শকদের তুমুল করতালি আর হইহুল্লোড়ের মধ্যে ঘোড়াগুলো তিরবেগে চক্কর দিচ্ছে মাঠে। হাততালি, ঘোড়সওয়ারের চাবুক মারার শপাং শপাং শব্দ আর ঘোড়ার খুরের টগবগ। সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর একটা পরিস্থিতি। কে জিতবে শেষ পর্যন্ত? টানটান উত্তেজনা সবার মধ্যে। শেষ চক্করে এসে হতবাক সবাই। আরে, সাদা ঘোড়ায় বসা সেই মেয়েটাই তো সবার আগে! বাচ্চা মেয়েটা জিতে যাবে নাকি? কী আশ্চর্য, হলোও তা-ই। বড় বড় ছেলেকে পেছনে ফেলে প্রথম হলো সাদা ঘোড়াটা...মাইকে ঘোষিত হলো ঘোড়সওয়ারের নাম। তাসমিনা আক্তার!

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার চকসুবল গ্রামের মেয়ে তাসমিনা আক্তার। সবে পঞ্চম শ্রেণি পেরিয়েছে শঙ্করপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। এ বয়সে সবাই সাইকেল চালায়। কিন্তু তাসমিনা চালায় ঘোড়া। নিজের তুলনায় বিশাল বড় ঘোড়াকে তিরবেগে ছুটিয়ে সবার আগে লক্ষ্যে পৌঁছায় সে। জিতে নেয় পুরস্কার। কখনো টিভি, মোবাইল সেট। কখনো আবার কম্পিউটার।

কিন্তু ঘোড়দৌড়ে প্রথম হলে কী হবে, তাসমিনার হাতে পুরস্কারটা থাকে শুধু ছবি তোলা পর্যন্ত। তারপর তা চলে যায় ঘোড়ার মালিকের হাতে। রেসে অংশ নেওয়ার মতো শক্তপোক্ত ঘোড়া নেই তাসমিনার। কিন্তু ঘোড়দৌড় তার নেশা। তাই অন্যের ঘোড়াকে জিতিয়ে দিয়েই সেই নেশা মেটায় তাসমিনা। পুরস্কার নয়, জয়ী হওয়াতেই তার আনন্দ।

জয়ী হওয়ার এই আনন্দ তাসমিনা পায় নিয়মিতই। রাজশাহীর কাঁকনহাটের প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া দিয়ে শুরু। তারপর থেকে প্রায় প্রতিটি খেলাতেই জয়ী হয়েছে এই অদম্য কিশোরী। তাসমিনা এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে তুখোড় ঘোড়সওয়ার হিসেবে পরিচিত। পুরুষ ঘোড়সওয়ার তো অনেক আছে, কিন্তু তাসমিনাই একমাত্র নারী ঘোড়সওয়ার। দৃঢ় কণ্ঠে সে বলে, ‘ছেলেরা যদি ঘোড়ায় চড়তে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না?’ সত্যিই তা-ই। পুরুষদের সঙ্গে লড়েই নিয়মিত বিজয়ী হচ্ছে তাসমিনা। তাই নওগাঁ ছাড়াও রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তাকে ডেকে পাঠান ঘোড়ার মালিকেরা। তাসমিনাও সেসব জায়গায় গিয়ে জিতিয়ে দেয় ঘোড়াকে। সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর নওগাঁর হানাদারমুক্ত দিবসে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতাতেও প্রথম হয় তাসমিনা।

ঘোড়ায় চড়ার এই শখ তাসমিনা পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। বাবা ওবায়দুর রহমানের ছোট একটা ঘোড়া আছে। ছোটবেলা থেকেই তাসমিনা ঘুরে বেড়াত বিজলী রানী নামের সেই ঘোড়াটার পিঠে চড়ে। বিজলীর সঙ্গে খুব ভাব তাসমিনার। সুখ-দুঃখের সাথি যেন। ওর কথা ঠিকঠাক মেনে চলে বিজলী। শুধু বিজলী কেন, সব ঘোড়াই নাকি তাসমিনার বশে। ঘোড়াকে একটুও ভয় পায় না সে। সরল হাসিতে এই ঘোড়সওয়ার বলে, ‘আমি ঘোড়ায় চড়লেই ঘোড়া কথা শোনে।’ তবে সাদা এই ঘোড়াটা কখনো কখনো দুষ্টুমিও করে খুব। তখন ছোট্ট কঠিন হাতে তা দমন করার ব্যবস্থা নেয় তাসমিনা। ‘ঘোড়া দুষ্টুমি করলে আমি ঘোড়াকে মারি। তখন ঠিক কথা শোনে।’ তবে প্রিয় ঘোড়াকে মারলে আবার মন খারাপও হয় তার। ‘মারার পর আবার আদর করে দিই।’ হেসে বলে তাসমিনা।

তাসমিনা মানেই ঘোড়াদৌড়ে প্রথম

তাসমিনার রুটিনটা অন্য কিশোরীদের থেকে একটু আলাদা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বিজলীকে খাবার দেয় সে। তারপর পিঠে চড়ে বেরিয়ে পড়ে। ফিরে এসে বিজলীকে রেখে স্কুলে যায় তাসমিনা। লেখাপড়ায় বেশ ভালো সে। বাংলা তার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। বিশেষ করে ছড়া-কবিতাগুলো পড়তে খুব ভালো লাগে তার। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে তাসমিনা আবারও বেরিয়ে পড়ে বিজলী রানীকে নিয়ে। কখনো মাঠে খেলাধুলা করে বন্ধুদের সঙ্গে। অন্যান্য খেলাতেও বেশ পারদর্শী তাসমিনা। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব ভালো লাগে তার। ছেলেদের সঙ্গে মিলে ফুটবল খেলে নিয়মিতই। সন্ধ্যায় বিজলীকে খাবার দিয়ে পড়তে বসে যায় তাসমিনা।

আর সব মা-বাবার মতো তাসমিনাকেও বকা দেন তার মা-বাবা। তবে তার চেয়েও বেশি দেন উত্সাহ। বাবার হাত ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানের ঘোড়দৌড়গুলোয় অংশ নেয় সে। তাসমিনার বাবা বলছিলেন, ঘোড়ায় চড়া শেষে নেমে গিয়ে তাসমিনা লাগামটা ধরিয়ে দেয় তাঁর হাতে। ঘোড়াকে গোসল করানোর কথা বললে গম্ভীর মুখে বলে, ‘পাইলটের কাজ বিমান চালানো। বিমান পরিষ্কার করা নয়। আমি ঘোড়ার পাইলট।’ ‘ঘোড়ার পাইলট’-এর লক্ষ্যটাও ঘোড়াকেন্দ্রিক। বড় হয়েও খেলাটা চালিয়ে যেতে চায় তাসমিনা। আরও একটা ইচ্ছা অবশ্য আছে, পুলিশ হওয়া। পুলিশ কেন? ‘পুলিশ দেখতে ভালো লাগে।’ সরল উত্তর তাসমিনার।

তাসমিনাকে নিয়ে এখন পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে দুটো প্রামাণ্য চিত্র। দেশ-বিদেশে ব্যাপক দর্শকনন্দিত হয়েছে দুটোই। রোকেয়া দিবসে তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে প্রথম আলো। সাহসী এই কিশোরীকে একটি ঘোড়া কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পত্রিকাটি। সবার চাওয়া, ঘোড়ার মতোই তীব্রগতিতে এগিয়ে যাক তাসমিনা।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)