আলো চলে আলোর বেগে

বাতি বন্ধ করে দিয়ে কেবল ঘুমের আয়োজন করেছি, এমন সময় লাইট জ্বেলে দিয়ে পল্টুর প্রশ্ন, আলোকবর্ষ মানে কী? আলোকবর্ষ হলো আলো এক বছরে যে পথ যায়। ৯ লাখ ৪০ হাজার কোটি কিলোমিটারের চেয়ে কিছু বেশি। পল্টু উত্তরে খুশি হয় না। আলোর যেতে আবার সময় লাগে নাকি? আলো তো মুহূর্তের মধ্যেই এ-মাথা থেকে ও-মাথা চলে যায়। প্রমাণ হিসেবে একবার লাইট বন্ধ করে আবার জ্বালিয়ে দেখায়। আলো আসলে এত দ্রুত চলে যে দেখে মনে হয় পথ চলতে আলোর কোনো সময়ই লাগে না। ঘুম বাদ দিয়ে আমি বসি পল্টুকে বোঝাতে।

অ্যারিস্টটলের দুই হাজার বছর

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক এম্পিডকিলস বলেছিলেন আলোর গতি আছে, আলো মুহূর্তের মধ্যে চলে না। কিছু সময় লাগে। কিন্তু অ্যারিস্টটল এসে বললেন, না, আলোর চলতে কোনো সময় লাগে না। মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো দূরত্বে পৌঁছে যায় আলো। পল্টু আর অ্যারিস্টটলের মতটা তাই একই। তোমার কী মত?

এই মত কিন্তু গ্যালিলিওর পছন্দ হলো না। দুই হাজার বছর ধরে চলে আসা ধারণা আসলেই সত্যি কি না, তিনি পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন। ১৬৩৮ সালে এক পরীক্ষার পরিকল্পনা করলেন তিনি। বুদ্ধিটা ছিল, দুজন দুটি বাতি নিয়ে অন্ধকার রাতে দুটি টিলার ওপরে দাঁড়াবে। দুই টিলার দূরত্ব যত বেশি করা যায় তত ভালো। ধরা যাক দুজনের একজনের নাম আবুল, আরেকজন কাবুল। বাতি দুটি ঢাকা থাকবে কালো কাপড় দিয়ে। এখন আবুল ঢাকনা খুলে দিলে কাবুল ওই আলো দেখতে পারবে। কাবুল তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাতির ঢাকনা খুলে দেবে। আবুল দেখতে পারবে কাবুলের বাতি।

আবুলের কাজ হলো তার ঢাকনা সরানোর পর খেয়াল করা যে কাবুলের বাতির আলো আসতে কোনো সময় লাগছে কি না। যদি সময় লাগে তাহলে বোঝা যাবে আলোর পথ চলতে সময় লাগে। বুঝতেই পারছ, এই পরীক্ষা করে গ্যলিলিও সফল হননি। এত দ্রুত আলো চলে এল, বোঝাই গেল না কোনো সময় লেগেছে কি না। তবে এটা বোঝা গেল, আলোর গতি শব্দের গতির চেয়ে অন্তত দশ গুণ বেশি। কত বেশি, এমনকি বেশির কোনো সীমা আছে কি না, তাও বোঝা গেল না।

আলোর গতির আলোকবর্তিকা

প্রথম সত্যিকার প্রমাণটা হাজির করলেন ফরাসি বিজ্ঞানী ওলে রোমা। ১৬৭৬ সালে। এ কাজেও লাগল গ্যালিলিওকে। গ্যালিলিও এর আগে ১৬১০ সালে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেন বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ। এর মধ্যে একটা ছিল ‘আইয়ো’। প্রায় ৬০ বছরের পর্যবেক্ষণে আইয়োর গতিপথ জানা ছিল নিখুঁতভাবে। রোমা আরও নিখুঁত হিসাব করতে গিয়ে কিছুটা ঝামেলায় পড়লেন।

একটু ভাবো | চাঁদ থেকে আলো আসতে মোটামুটি এক সেকেন্ড লাগে। সূর্য থেকে আলো আসতে লাগে ৮ মিনিটের একটু বেশি। সবচেয়ে কাছের তারা আলফা সেন্টরাই থেকে আলো আসতে লাগে চার বছরের কিছু বেশি। অনেক তারা আছে, যেগুলো থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে হাজার লাখ কোটি বছর চলে যায়। কোনো কিছু আমরা তখনই দেখতে পাই, যখন সেখান থেকে কোনো আলো আমাদের চোখে এসে পড়ে। অর্থাৎ আমরা ১ সেকেন্ড অতীতের চাঁদ দেখি সব সময়। সূর্য দেখি আট মিনিট আগের। অনেক তারা আছে যেগুলো লাখ বছর আগের। কী অদ্ভুত! চিন্তা করে দেখো। কে বলেছে টাইম ট্রাভেল করা যায় না? আমরা তো প্রতি মুহূর্তেই কত কোটি বছর আগের অতীত দেখছি!

হিসাব করে দেখা গেল আইয়ো বৃহস্পতিকে একবার ঘুরতে সময় নেয় সাড়ে বিয়াল্লিশ ঘণ্টা। এর কিছু সময় আইয়োকে পৃথিবী থেকে দেখা যায়। কিন্তু আইয়ো ঘুরতে ঘুরতে যখন বৃহস্পতির পেছনে চলে যায় তখন আর তাকে দেখা যায় না। চন্দ্রগ্রহণের মতো একে বলা যেতে পারে আইয়ো-গ্রহণ। হিসাবমতো প্রতি আইয়ো-গ্রহণের জন্য সমান সময় লাগা উচিত। কারণ, বৃহস্পতির পেছনে আইয়ো তো সমান সময় থাকে। রোমা হতবুদ্ধি হয়ে দেখলেন একেক আইয়ো-গ্রহণে একেক পরিমাণ সময় লাগছে। কী অদ্ভুত কাণ্ড!

রোমা কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি বুঝে ফেললেন এমনটা হচ্ছে আলোর গতির জন্য। আইয়ো থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে নিশ্চয় কিছু সময় লাগে। এখন পৃথিবী আর বৃহস্পতি দুটিই ঘোরে সূর্যকে কেন্দ্র করে। কখনো কখনো এই দুটো গ্রহ থাকে সূর্যের একই পাশে। কখনো থাকে সূর্যের দুই বিপরীত পাশে। যখন সূর্যের একই পাশে থাকে তখন এদের দূরত্ব থাকে কম। আর বিপরীত পাশে থাকলে দূরত্ব থাকে বেশি। যখন দূরত্ব বেশি তখন আলো আসতে বেশি সময় লাগে। যখন দূরত্ব কম, আলো আসতে সময় কম লাগে।

বুঝতেই পারছ, পৃথিবী যখন উল্টো দিকে থাকে, তখন গ্রহণ শেষে আইয়ো থেকে আলো আসতে কিছু বেশি সময় লেগে যায়। এ জন্যই আইয়ো-এর গ্রহণ মনে হয় বেশি সময় ধরে হচ্ছে। কঠিন সমস্যার কী সহজ সমাধান! প্রমাণ হয়ে গেল আলো আসলে মুহূর্তের মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায় না। বরং কিছু সময় লাগে।

সমাধান কিন্তু আরও যুগান্তকারী ছিল। তিনি হিসাব করে দেখালেন পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস পাড়ি দিতে আলোর লাগে ২২ মিনিট। ২২ মিনিটে যদি ওই পথ পাড়ি দেয়, তাহলে এক সেকেন্ডে কতটা পথ পাড়ি দেবে, এই হিসাবটা করলেন ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস। তাঁর হিসাবে আলোর বেগ এল ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার। আলোর বেগ আসলে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার। ৮০ হাজার কিলোমিটার গরমিল থাকলেও পদ্ধতিতে কিন্তু কোনো ভুল ছিল না। ভুল ছিল তখনকার জানা পৃথিবী আর বৃহস্পতির গতিপথ, ঘড়ির নিখুঁত সময়দানে।

নিউটনের আলোর গতি | নিউটন যে সাদা আলোকে প্রিজম দিয়ে ভেঙে নানা রঙে ভাগ করে দেখিয়েছিলেন তা তো জানোই। তাই তিনি রোমা পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে খোঁজ নিলেন, গ্রহণ শেষ হওয়ার মুহূর্তে আইয়ো থেকে আসা আলোর রং কী ছিল। দেখা গেল সে রং ছিল সাদা। বুদ্ধিমান নিউটন বলে দিলেন, তার মানে সব রঙের আলো একই গতিতে চলে। যদি আলাদা গতিতে চলত, তবে সবচেয়ে বেশি গতির আলোর রং সবার আগে দেখা যেত।

সরাসরি আলোর গতি

গ্যালিলিওর আবুল-কাবুলের বুদ্ধি তো কাজে লাগল না। কিন্তু ১৮৪৯ সালে ফ্রান্সের লুই ফিজো প্রায় একই রকম আরেক বুদ্ধি নিয়ে এলেন। কিছু কাচ আছে, যেটা আধাআধি আয়নার কাজ করে। মানে এর ওপর আলো পড়লে অর্ধেক আলো প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে দেয়। বাকি অর্ধেক আয়না ভেদ করে চলে যায়। তুমি যদি এমন কাচের সামনে দাঁড়াও, তাহলে তোমার চেহারা দেখতে পারবে এর ভেতর। আবার অপর পাশে কী আছে, দেখতে পারবে তাও। ফিজো এমন একটা আয়না ৪৫ ডিগ্রি কোনাকুনি করে তার সামনে একটা মোমবাতি রাখলেন। আয়নায় বাড়ি খেয়ে অর্ধেক আলো চলে যাবে সোজা, বাকি অর্ধেক ছবির মতো বাঁ দিকে চলে যাবে। এরপর সামনে দিলেন একটা চাকতি। চাকতিটার চারপাশে ছোট ছোট ছিদ্র করে দিলেন। অনেকটা দাঁতযুক্ত গিয়ারের মতো হলো দেখতে চাকতিটা। ব্যবস্থাটা এমন যে চাকতিটা সেকেন্ডে কয়েক শতবার ঘোরানো যায়। এখন মোমবাতি থেকে আলো চাকতির দাঁত ভেদ করে চলে যাবে। এবার প্রায় ৮-৯ কিলোমিটার দূরে আরেকটা আয়না বসালেন ফিজো। এই আয়নাটা খুবই ভালো, চমৎকার আলো প্রতিফলন করে। সেই আয়নায় আলো বাড়ি খেয়ে ফিরে এল আগের পথে। চাকতির দাঁতের ফাঁক দিয়ে আধাআধি আয়নায় ফিরে এল। আলোর কিছু অংশ ভেদ করে, ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফিজো তা পর্যবেক্ষণ করলেন।

বুঝতেই পারছ, পৃথিবী যখন উল্টো দিকে থাকে, তখন গ্রহণ শেষে আইয়ো থেকে আলো আসতে কিছু বেশি সময় লেগে যায়। এ জন্যই আইয়ো-এর গ্রহণ মনে হয় বেশি সময় ধরে হচ্ছে। কঠিন সমস্যার কী সহজ সমাধান! প্রমাণ হয়ে গেল আলো আসলে মুহূর্তের মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায় না। বরং কিছু সময় লাগে।

সমাধান কিন্তু আরও যুগান্তকারী ছিল। তিনি হিসাব করে দেখালেন পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস পাড়ি দিতে আলোর লাগে ২২ মিনিট। ২২ মিনিটে যদি ওই পথ পাড়ি দেয়, তাহলে এক সেকেন্ডে কতটা পথ পাড়ি দেবে, এই হিসাবটা করলেন ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস। তাঁর হিসাবে আলোর বেগ এল ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার। আলোর বেগ আসলে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার। ৮০ হাজার কিলোমিটার গরমিল থাকলেও পদ্ধতিতে কিন্তু কোনো ভুল ছিল না। ভুল ছিল তখনকার জানা পৃথিবী আর বৃহস্পতির গতিপথ, ঘড়ির নিখুঁত সময়দানে।

সরাসরি আলোর গতি

গ্যালিলিওর আবুল-কাবুলের বুদ্ধি তো কাজে লাগল না। কিন্তু ১৮৪৯ সালে ফ্রান্সের লুই ফিজো প্রায় একই রকম আরেক বুদ্ধি নিয়ে এলেন। কিছু কাচ আছে, যেটা আধাআধি আয়নার কাজ করে। মানে এর ওপর আলো পড়লে অর্ধেক আলো প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে দেয়। বাকি অর্ধেক আয়না ভেদ করে চলে যায়। তুমি যদি এমন কাচের সামনে দাঁড়াও, তাহলে তোমার চেহারা দেখতে পারবে এর ভেতর। আবার অপর পাশে কী আছে, দেখতে পারবে তাও। ফিজো এমন একটা আয়না ৪৫ ডিগ্রি কোনাকুনি করে তার সামনে একটা মোমবাতি রাখলেন। আয়নায় বাড়ি খেয়ে অর্ধেক আলো চলে যাবে সোজা, বাকি অর্ধেক ছবির মতো বাঁ দিকে চলে যাবে। এরপর সামনে দিলেন একটা চাকতি। চাকতিটার চারপাশে ছোট ছোট ছিদ্র করে দিলেন। অনেকটা দাঁতযুক্ত গিয়ারের মতো হলো দেখতে চাকতিটা। ব্যবস্থাটা এমন যে চাকতিটা সেকেন্ডে কয়েক শতবার ঘোরানো যায়। এখন মোমবাতি থেকে আলো চাকতির দাঁত ভেদ করে চলে যাবে। এবার প্রায় ৮-৯ কিলোমিটার দূরে আরেকটা আয়না বসালেন ফিজো। এই আয়নাটা খুবই ভালো, চমৎকার আলো প্রতিফলন করে। সেই আয়নায় আলো বাড়ি খেয়ে ফিরে এল আগের পথে। চাকতির দাঁতের ফাঁক দিয়ে আধাআধি আয়নায় ফিরে এল। আলোর কিছু অংশ ভেদ করে, ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফিজো তা পর্যবেক্ষণ করলেন।

এবার ফিজো চাকতিটা ঘোরাতে শুরু করলেন। চাকতিটা যদি খুব আস্তে ঘোরানো হয়, তাহলে দেখা যাবে আলো খুব দ্রুত দূরের আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে চলে আসবে। যে ছিদ্র দিয়ে গিয়েছিল সে ছিদ্র দিয়েই ফিরবে। কিন্তু যদি অনেক দ্রুত ঘোরানো হয়? তবে দেখা যাবে সে ছিদ্র দিয়ে আর আসতে পারছে না। ছিদ্রের পর যে দাঁত আছে, সে দাঁতে বাধা পাবে। যদি আরও জোরে ঘোরানো হয়? তাহলে কিন্তু পরের ছিদ্র দিয়ে আলো বের হয়ে আসবে।

তারপর তিনি চাকতিটা প্রতি সেকেন্ডে কতবার ঘুরছে তা বের করলেন। তাহলে একবার ঘুরতে কত সময় লাগছে তা তো বের করাই যায়। সেখান থেকে বের করা যায় এক দাঁত থেকে আরেক দাঁতে যেতে কত সময় লাগে। তার মানে এই সময় লাগে আলোর ওই পথ পাড়ি দিতে। তাহলে এক সেকেন্ডে মোট কতটা পথ পাড়ি দেবে ঐকিক নিয়ম দিয়েই তা বের করে ফেলা যায়।

হিসাব করে ফিজো বের করে ফেললেন আলোর বেগ। আলোর বেগ এল প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৩০০ কিলোমিটার। আসল বেগের চেয়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার বেশি। ফিজোর বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ১৯৬২ সালে লিও ফুকো আরও সূক্ষ্মভাবে আলোর বেগ মাপলেন। তাঁর বেগ এল প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯৭৯৬ কিলোমিটার। আসল বেগের চেয়ে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার বেশি।

বর্তমানে আলোর বেগ

এরপর আরও নানাভাবে আলোর বেগ মাপা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি, তত্ত্ব ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে নিখুঁত হিসাব হলো প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯৭৯২.৪৫৮ কিলোমিটার। এই সংখ্যাটা মাথার মধ্যে গেঁথে ফেলা যেতে পারে। মহাবিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত চলে আলো। আর আলোর এই বেগের চেয়ে বেশি বেগে কোনো কিছু চলতে পারে না।

স্বভাব অনুযায়ী পল্টুর প্রশ্ন, কেন চলতে পারে না? সে আরেক বড় গল্প। শুরু করে রাতের ঘুমটা নষ্ট করতে চাইলাম না। আলোর বেগে বাতি নিভিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করলাম।

সূত্র: দ্য ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিকস, টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফিজিকস ও এপিএস ফিজিকস