ইছামতীর তীর থেকে বুনিপের দেশে

অলংকরণ: তুলি

পথের পাঁচালীর পটভূমি

বিহারের ভাগলপুরের বাঙালি পাড়ায় এক বাঙালি পরিবার বাস করে। মস্ত বাড়ি। সাহিত্যের তীর্থভূমি, বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামার বাড়ি। শরতের ছেলেবেলার একটা বড় সময় সেখানেই কেটেছে। সেই বাড়িতে বাস করেন পেশায় আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি। শরৎচন্দ্রের মামা। উপেন্দ্রনাথকে শুধু উকিল বললে কম বলা হয়। তিনি তখন সাহিত্যের সাধক। কলকাতার বিখ্যাত সব পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোচ্ছে। এহেন সাহিত্যমনা মানুষটি বিহারে গিয়েও সাহিত্য থেকে দূরে থাকতে পারেনি। তাঁর বাড়িতেই তৈরি হয় সাহিত্যবলয়। নিয়মিত বসান সাহিত্যের আসর। বাঙালিপাড়ার যেসব লোক বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী, তাঁরা রোজই সন্ধ্যায় জড়ো হন উপেন্দ্রনাথের বাড়িতে। এসব লোকের জন্য চেয়ার সাজানোই থাকে বৈঠকখানায়। বাংলা সাহিত্যের অতীত-বর্তমান নিয়ে আলোচনা চলে, সাহিত্য পত্রিকাগুলোতে কী বেরোচ্ছে, সেসব নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আসরের সবাই একেকজন পণ্ডিত। তাঁদের মধ্যেই একজন অচেনা যুবক এসে গুটিসুটি মেরে বসে থাকেন, আসরের একেবারে পেছনের সারিতে। হাঁটুসমান উঁচু ধুতি, কোঁচকানো-তালিমারা পাঞ্জাবি পরে লাঠি হাতে কোথা থেকে আসেন যুবকটি, সে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। যুবকটিও মুখে রা কাড়েন না। এভাবেই মাস ছয়েক কেটে গেল।

কালবৈশাখের এক সন্ধ্যা। প্রবল বিক্রমে ঝড় আসে, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। উপেন্দ্রনাথ ভাবলেন, এই ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে আজ আর কি কেউ আসবে? কিন্তু জানালা দিয়ে দূরের ওই পথ ধরে একটা আলো এগিয়ে আসছে। সঙ্গে ছাতা মাথায় এক ছায়ামূর্তি। উপেন্দ্রনাথ অবাক। পথের দিকে অপলকে চেয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে হারিকেনের আলো আর ছায়ামূর্তিটা এগিয়ে আসে। তারপর একসময় পৌঁছে যায় সভাকক্ষে।

‘আসুন, আসুন’ বলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। যুবকটি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে পেছনের সারিতে গিয়ে বসেন। উপেন্দ্রনাথ বলেন, ‘পেছনে কেন, সামনে এসে বসুন।’

‘আজ্ঞে, এখানে সব মশাইরা বসবেন। আমি কী করে বসি, বলুন?’

‘উনারা কি আজ আর আসবেন? আপনি সামনে বসুন। আপনাকে রোজই দেখি সভায় এসে পেছনে চুপটি করে বসে থাকেন। কিন্তু কোনো কথা-টথা বলেন না। তা, মশাইয়ের নামটা কী? থাকেন কোথায়?’

‘আজ্ঞে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেরেত ঘোষালের জমিদারি দেখাশোনা করি।’

‘বলেন কী মশাই! সেরেত ঘোষালের জমিদারি, সে তো পাঁচ-ছয় মাইল দূরের পথ। তার ওপর পথে বাঘ, সাপখোপের ভয় আছে!’

‘এটা আছে না!’ হাতের লাঠিখানা দেখিয়ে বলেন বিভূতিভূষণ। উপেন্দ্রনাথের চোখে বিস্ময়!

‘এত আগ্রহ নিয়ে রোজই যখন সভায় আসেন, তখন নিশ্চয়ই লেখালেখির বাতিক আছে?’

বিভূতিভূষণ ভীরু কণ্ঠে জবাব দেন, ‘একটা উপন্যাস লিখছি।’

উপেন্দ্রনাথ একটু বিদ্রূপের সুরে বললেন, ‘কোনো কবিতা নয়, একেবারে উপন্যাস! তা অঙ্ক–টঙ্ক মিলিয়ে লিখেছেন তো।’

বিভূতিভূষণ তো অবাক। উপন্যাসের আবার অঙ্ক-নিয়ম এসব আছে নাকি? উপেন্দ্রনাথ উপন্যাসের অঙ্ক-নিয়ম এসব বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন পরদিন সেটা যেন নিয়ে আসেন।

পরদিন বিভূতিভূষণ পাণ্ডুলিপিখানা নিয়ে হাজির। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা তুলে দেন উপেন্দ্রনাথের হাতে। উপেন্দ্রনাথ দেখলেন আসলেই এই উপন্যাসে অঙ্ক-নিয়মের কোনো বালাই নেই। তবু সেটা রেখে দিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, উপন্যাসখানা কোনো পত্রিকায় ছাপানোর ইচ্ছে আছে কি না। বিভূতিভূষণ জানালেন, সেটা প্রবাসী পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। মনোনীত হয়নি, তাই ফেরত পাঠিয়েছেন। উপেন্দ্রনাথ শুনে চুপ মেরে গেলেন। তবু নিলেন। নিলেন তো নিলেনই। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, সেটা নিয়ে টুঁ শব্দটি করেন না। বিভূতিভূষণও ভয়ে কিছু বলেন না। তাঁর ভয় হচ্ছিল, ভেবেছিলেন আসলেই বোধ হয় খুব খারাপ উপন্যাস লিখেছেন।

পাক্কা দুই মাস পরে একদিন সাহিত্য সভা শেষে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিকে বলেন, ‘আপনি যাবেন না। বসুন, কথা আছে।’

বিভূতিভূষণ ভয়ে ভয়ে বসলেন, ভাবলেন, হতাশার কথা শোনাবেন উপেন্দ্রনাথ। তাঁকে অবাক করে দিয়ে উপেন্দ্রনাথ বলে ওঠেন, ‘আপনার হবে। হবে কী? হয়েছে।’

কিন্তু ছাপবে কে? উপেন্দ্রনাথ জানালেন, তিনি শিগগিরই কলকাতায় ফিরে যাবেন এবং একটা পত্রিকা বের করবেন। সত্যিই কিছুদিনের মধ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিচিত্রা নামের একটা পত্রিকা বের করলেন। এবং কয়েক মাস পর থেকেই বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হলো অঙ্ক-নিয়ম মেনে না লেখা কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালী। বাঙালি পেল অপু-দুর্গার মতো অসান্য দুটি কল্পচরিত্র। ‘নিশ্চিন্দপুর’ নামের একটি কল্পিত নাম হয়ে উঠল রূপকথার রাজ্য আর সাত সমুদ্র তেরো নদীর ভূমিকায় ইছামতী নদী। আর সেই উপন্যাসটিই এখন বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি পড়া উপন্যাসের একটি।

সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিেত্রর একটি দৃশ্য নিয়ে তৈরি পথের পাঁচালী উপন্যাসের এই প্রচ্ছদ

পথের পাঁচালী উপন্যাস তখনো বিচিত্রায় ধারাবাহিক ছাপা হচ্ছে। উপেন্দ্রনাথকে ধরে শনিবারের চিঠি নামের আরেক বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস খুঁজে বের করলেন বিভূতিভূষণকে। তাঁর হাতে ৯০টি টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, এই উপন্যাস তিনি বই আকারে বের করতে চান।

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা তৈরির হাতেখড়ি হয়েছিল এই উপন্যাসটিকেই চলচ্চিত্রে রূপ দিয়ে।

সেই চাঁদের পাহাড়

এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে, চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব...সেই চাঁদের পাহাড়...মাথায় যাহার রামধনু রাঙা হয় দেখতে পাব...। আরতি আর প্রতিমা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া হিরে-মানিক সিনেমার গান এটি। সিনেমায় গােন ঠোঁট মেলানো দুই শিশুর মতো চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটা যারাই পড়েছে, তারাই শঙ্কর হয়ে আফ্রিকার ভয়ংকর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে, সাভান্না ঘাসের বনে সিংহের গর্জন আর ব্ল্যাক মাম্বার মৃত্যুফণা উপেক্ষা করে রিখটারসভেল্ড পর্বতমালায় যেতে চেয়েছে। ডিয়াগো আলভারেজের সঙ্গী হয়ে রহস্য দানব বুনিপের মুখোমুখি হওয়ার সাধ কার না জাগে! কিংবা ডেথ সার্কেলের মৃত্যুফাঁদ জয় করে, হীরার খোঁজে মৃত্যুগুহায় পথ হারিয়ে আত্তেলিও গাত্তির ৩০ বছরের পুরোনো কঙ্কাল আর চিঠি আবিষ্কার করা সেও কি কম রোমাঞ্চের ব্যাপার! তারপর ধরো হিরা-টিরা নিয়ে কালাহারির মতো ভয়ংকর মরুভূমিতে শকুনের মাংস খেয়ে ক্ষুধার্থ হায়েনার কুটিল হাসি উপেক্ষা করে সলসবেরিতে ফিরে আসার রোমাঞ্চ, রোমকূপে শিহরণ তোলা যে আনন্দ, তা বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কিশোর উপন্যাসে পাবে!

অথচ আফ্রিকার জঙ্গলে, মরুভূমিতে, রিখটারসভেল্ড পর্বতে শঙ্কর অভিযান চালিয়েছে, এই কাহিনি পড়তে গিয়ে আফ্রিকার স্বপ্নালু দেশের যে জীবন্ত ছবি উপন্যাসে পাঠক দেখতে পায়, সেসব দেশ দূরে থাক, বাংলা তথা ভারতবর্ষের বাইরে কখোনো পা দেননি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। উপন্যাসের ভূমিকা অংশ না পড়লে যে কারও মনে হতে পারে এটা কোনো বিদেশি গল্পের অনুবাদ বা বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লেখা বাংলা উপন্যাস। তাই বিভূতিভূষণ নিজেই বইটির ভূমিকায় এ বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আফ্রিকায় যদি না-ই যাবেন, তাহলে কীভাবে লিখলেন এমন উপন্যাস?

পথের পাঁচালীর মতো চাঁদের পাহাড়–এর আছেন এক উপেন্দ্রনাথ। তবে ইনি গাঙ্গুলি নন, চট্টোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণের জ্ঞাতি বোন ছিলেন, ননিদি বলে ডাকতেন তাঁকে, তাঁরই স্বামী উপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। উপেন্দ্রনাথ যৌবনে দেশ ছেড়ে উত্তর আফ্রিকায় ছিলেন অনেক বছর। সেখানে কয়লাখনিতে কাজ করেছেন আবার রেলেও চাকরি করেছেন। উপেন্দ্রনাথের কাছে আফ্রিকার বিচিত্র জীবনের কাহিনি শুনে বিভূতিভূষণও মজেন জঙ্গল, তৃণভূমি আর মরুর দেশের প্রেমে। পরে আফ্রিকাবিষয়ক অনেক ভ্রমণকাহিনি আর ফিচারধর্মী বই পড়েন। এর মধ্যে এইচ এইচ জনস্টন ও রোসিটা ফরবসের ভ্রমণকাহিনিগুলো তাঁকে ভয়ংকর সুন্দর আফ্রিকার দৃশ্যপট তৈরি করতে সাহায্যে করে। বুনিপ নামের যে হিংস্র দানব ডিয়াগো আলভারেজকে মেরে ফেলেছিল, সেই কাল্পনিক দানবের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন আফ্রিকার উপকাহিনিগুলোতে।

আর দুঃসাহসিক শঙ্কর, যে চাঁদের পাহাড়ের নায়ক, সেই চরিত্র আসলে বিভূতিভূষণের নিজেরই এক কল্পিত রূপ। বিভূতিভূষণের মতো শঙ্কর সে কালের যশোর জেলার এক হতদরিদ্র পরিবারের স্বপ্নবাজ ছেলে। অন্যদিকে ডিয়াগো আলভারেজ চরিত্রটাও একেবারে কল্পিত নয়, সেটা বিভূতিভূষণ গবেষকদের লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে পাওয়া যায়।

বিভূতিভূষণের অভিযাত্রিক নামের একটা স্মৃতিকথার বই আছে। এই বইয়ের বড় অংশজুড়ে রয়েছে তাঁর পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের কথা। চট্টগ্রামের পাহাড়-জঙ্গল দেখে বিভূতিভূষণ গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। সেখানে তিনি সেকালের ত্রিপুরা রাজার অতিথিশালায় আশ্রয় নেন। সেখানেই পরিচয় হয় ভবঘুরে কিন্তু অসাধরণ পণ্ডিত এক লোকের সঙ্গে। কথায় কথায় লোকটা জার্মান কবি গ্যেটের কবিতার লাইন আউড়াতেন। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য—সব বিষয়ে তাঁর টনটনে জ্ঞান। লোকটা স্বপ্নবাজ, কিন্তু লোভী নন। ভূতত্ত্ববিদ ও খনিবিশারদ। তিনি ত্রিপুরার পাহাড়-জঙ্গলে তেল-গ্যাস খনির সন্ধান করছিলেন, অথচ পকেটে ফুটো পয়সাটিও ছিল না। লোকটা বিভূতিকে তাঁর সঙ্গে খনির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তাঁর নাম অভিযাত্রিক-এ লেখেন না বিভূতিভূষণ। লোকটাকে বড্ড পছন্দ করে ফেলেছিলেন। শুধু বলেছিলেন তাঁর বেশ কিছু উপন্যাসের চরিত্র তৈরিতে লোকটার একটা ভূমিকা ছিল। অন্যদিকে দিকে ডিয়াগো আলভারেজও ভবঘুরে টাইপের, ভূতত্ত্বে গভীর জ্ঞান, তিনিও শঙ্করকে নিয়ে হীরার খনির খোঁজে যেতে চেয়েছিলেন। বুনিপের হাতে নিহত হওয়ার পর শঙ্কর তাঁর কাগজপত্র ঘেঁটে জানতে পারেন আলভারেজের খনিবিদ্যায় ডিপ্লোমা ছিল। সুতরাং গবেষকদের দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে অসুবিধা হয়নি।

বিশ্বমানের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বলতে যা বোঝায়, চাঁদের পাহাড় সেই গোত্রেরই। বিশ্ব অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির অন্যতম দিকপাল হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন, রবার্ট লুই স্টিভেনের ট্রেজার আইল্যান্ড–এর চেয়েও রোমাঞ্চকর উপন্যাস লিখবেন। সেই বাজি জিতেছিলেন কিং সলোমান মাইন নামের এক অবিশ্বাস্য কাহিনি লিখে। চাঁদের পাহাড় কি এ জাতেরই উপন্যাস? মার্ক টোয়েনের হাকল বেরি ফিন, টম সয়ার, ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রশো, এডগার অ্যালান পোর দ্য ন্যারেটিভ অব আর্থার গর্ডন পিম কিংবা জুল ভার্নের দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনিগুলোর থেকে বোধ হয় পিছিয়ে নয় আমাদের চাঁদের পাহাড়।

চাঁদের পাহাড় নিয়ে একটা সিনেমাও তৈরি হয়েছে কয়েক বছর আগে। কিন্তু সত্যজিৎ পথের পাঁচালী নির্মাণে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন, তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি চাঁদের পাহাড় সিনেমা, সেটা আসলে সম্ভবও নয়। সত্যজিতের মতো নির্মাতা কি আছেন এখন? তাই খবরদার, চাঁদের পাহাড় পড়ার আগে কেউ সিনেমাটা দেখতে যেয়ো না, তাতে উপন্যাসটি সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে।

ইছামতীর বাঁকে

বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোনটি? কেউ বলেন পথের পাঁচালী, কেউ বলেন অপরাজিত, কেউ কেউ রায় দেন আরণ্যক-এর পক্ষে। কিন্তু সারা জীবনে বিভূতিভূষণ একটি মাত্র পুরস্কারই পেয়েছিলেন—রবীন্দ্র পুরস্কার—তাও মরণোত্তর। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন ইছামতী উপন্যাসের জন্য। অনেক বোদ্ধাই মনে করেন, এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় প্রেম, সঙ্গে নীলকর আর জমিদারের শোষণের এক আশ্চর্য চিত্র উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে ইছামতী নদীটিকেও অমর করে গেলেন। আসলে ইছামতী, এর চারপাশের প্রকৃতি, ঝোপ-জঙ্গল, বনফুল-ফল বিভূতিভূষণের শিল্পীসত্তার জন্মদাতা। তাই ঘুরেফিরে তাঁর উপন্যাস, গল্প, স্মৃতিকথায় বারবার উঠে এসেছে এ নদীটি। কিন্তু কোথায় এই নদী, কোথায় সেই অপু–দুর্গার নিশ্চিন্দপুর গ্রাম?

বিভূতিভূষণ নিজেই এ প্রশ্নের জবাব বাতলে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ইছামতী একটি ছোট নদী। অন্তত যশোর জেলার মধ্য দিয়ে এর যে অংশ প্রবাহিত, সেটুকু। দক্ষিণে ইছামতী কুমির-কামট-হাঙরসংকুল বিরাট নোনা গাঙে পরিণত হয়ে সুন্দরী–গরানগাছের জঙ্গলের আড়ালে বঙ্গোপসাগরে মিশে গিয়েছে, সে খবর যশোর জেলার গ্রাম্য অঞ্চলের কোনো লোকই জানে না।

সত্যজিৎ রায়ের আঁকা চাঁদের পাহাড় উপন্যােসর প্রচ্ছদ

ইছামতীর যে অংশ নদীয়া ও যশোর জেলার মধ্যে অবস্থিত, সে অংশের রূপ সত্যিই চমৎকার...’

কিন্তু যশোর জেলায় তুমি ইছামতীর দেখা পাবে না। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া আর বাংলাদেশের যশোর জেলার মধ্যে এখন কোনো সীমান্ত নেই। তাহলে?

বিভূতিভূষণের বাড়ি ছিল যশোর জেলার বনগাঁও মহকুমার বারাকপুর গ্রামে। এই গ্রামটিকেই বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালীতে নিশ্চিন্দপুর হিসেবে দেখিয়েছেন। দেশভাগের পর বনগাঁও মহকুমা যশোর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই বারাকপুর ছিল ইছামতীর পারে। অন্য পারে নদীয়া জেলা। তবে এখনো বাংলােদশ অংশে কিছুটা আছে। সােবক যশোর আর বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার সঙ্গে ভারতের নদীয়া জেলাকে আলাদা করেছে ইছামতী। এখান থেকে খুব কাছে বারাকপুর গ্রাম।

বিভূতিভূষণের জন্ম ১৮৯৪ সালে চব্বিশ পরগনার ঘোষপাড়া মুরাতিপুরে। পৈতৃক নিবাস বারাকপুরেই বেড়ে ওঠেন তিনি। অত্যন্ত কষ্টে। বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুটা ভবঘুরে, কিছুটা দার্শনিক টাইপের ছিলেন। সুতরাং পয়সাকড়ি রোজগারের ব্যাপারেও ছিল তাঁর উদাসীনতা। তাই বিভূতিভূষণের ছেলেবেলাটাও কেটেছে বড্ড কষ্টে। তবু গাঁয়ের স্কুলে, পরে বনগাঁও স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯১৬ সালে আইএ ও ১৯১৮ সােল বিএ পাস করেন কলকাতার রিপন কলেজ থেকে।

মাধ্যমিক পাসের পরপরই বাবা মারা যান। অনেক কষ্টে অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে, খেয়ে না–খেয়ে লেখাপড়া শিখেছেন। এমন একটা চরিত্রই তো দেখতে পাওয়া যায় পথের পাঁচালীর অপুর মধ্যে। মা মৃণালিনী দেবীকেই বিভূতিভূষণ সর্বজয়া চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ওই উপন্যাসে। আর দুর্গা চরিত্রটা কাল্পনিক। তবে নিজের একটা ছোট বোন ছিল বিভূতিভূষণের, সে খুব ছোটবেলায় মারা যায়। কিন্তু তার জীবন আর দুর্গার জীবন এক নয়। অন্যদিকে ইন্দির ঠাকরুন নামের অপুর যে পিসিমার চরিত্রটা পাঠকের মনে দাগ কাটে, তেমন একজন দুঃসম্পর্কের পিসি মহানন্দের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন।

ছাত্র অবস্থাতেই বিভূতিভূষণ বিয়ে করেন বসিরহাটের গৌরী দেবীকে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই গৌরী মারা যান। এমন কাহিনিই তো পাঠক খুঁজে পায় অপরাজিত উপন্যাসে। সেখানে অপুর স্ত্রী অপর্ণাও এক বছরের মধ্যে মারা যায়।

সত্যজিতের আঁকা চাঁদের পাহাড় উপন্যােসর একটি দৃশ্য

বিএ পাস করার পর বিভূতিভূষণ লেখাপড়া ছেড়ে দেন। তারপর জড়িয়েছেন নানা রকম পেশায়। বড়লোক ব্যবসায়ী কেশোরাম পোদ্দারের গোরক্ষণী সভায় চাকরি নেন। সেই চাকরির অংশ হিসেবে ছুটে বেড়ান গোটা পূর্ব বাংলায়—কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, বরিশাল, ভোলা, সোনাদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, চন্দ্রনাথ পাহাড়, কুমিল্লা, ফেনী ও নরসিংদী। এসব এলাকা ভ্রমণের বিচিত্র কাহিনি উঠে এসেছে তাঁর অভিযাত্রিক নামের বইটিতে।

এরপর কিছুদিন হুগলির একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু বেশি দিন ভালো লাগে না সে চাকরি। তারপর সেরেত ঘোষের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে বিহারের ভাগলপুরের জমিদারি দেখাশোনা করেন। কিন্তু সেও খুব সামান্য বেতনের চাকরি। সেখানে বসেই লেখেন পথের পাঁচালী। বিহারের হতদরিদ্র দুঃখী মানুষের করুণ কাহিনি, সেই সঙ্গে জঙ্গল–পাহাড়ের এক অসামান্য ছবি বিভূতিভূষণ ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর আরণ্যক উপন্যাসে।

সাহিত্যিক হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি ভাগলপুরের চাকরি ছেড়ে দেন। ফিরে আসেন কলকাতায়। কিন্তু শহর তাঁর ভালো লাগে না। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ফরিদপুরের মেয়ে রমা দেবীকে। স্থায়ীভাবে আবার বারাকপুরে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তাঁর একমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। বিহারের ঘাটশিলার প্রকৃতির প্রেমে পড়ে সেখানে একটা বাড়ি কিনেছিলেন। বছরের কয়েক মাস সেখানে বাস করতেন। বাকিটা সময় বারাকপুরে। ১৯৫০ সালে ঘাটশিলাতেই আকস্মিক মৃত্যু হয় তাঁর। ১২ সেপ্টেম্বর তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। সাহিত্যের রং–তুলিতে প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা এই মহান শিল্পীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।