ইমার্জিং লিডারের তালিকায় বাংলাদেশি এহসান হক

এহসান হক। ছবি : ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার
এহসান হক। ছবি : ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার

কী পড়তে চাও তুমি? সায়েন্স, আর্টস নাকি কমার্স?
কী ভালো লাগে তোমার? গণিত, জীববিজ্ঞান নাকি ইতিহাস?
কী হতে চাও জীবনে? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নাকি রাজনীতিবিদ?

তোমার এসব চাওয়ার সব প্রশ্নকে ছাপিয়ে আসে সবার জন্য ভালো কিছু করার প্রশ্ন। তুমি কি তোমার দেশের জন্য, সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে চাও? তোমার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলতে চাও? তাহলে তোমার জন্য সব পছন্দেই আছে এসবের সুযোগ। তারই প্রমাণ রাখলেন ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এহসান হক।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব মেডিসিন প্রকাশ করেছে ১০ জন ইমার্জিং লিডারের তালিকা। সেই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন এহসান হক। অধ্যাপনার পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের হিউম্যান-কম্পিউটার ইনটারেকশন ল্যাবের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

ন্যাশনাল একাডেমি অব মেডিসিনের (ন্যাম) যাত্রা শুরু হয় ১৯৭০ সালে। মানুষের স্বাস্থ্য, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন—এসব নিয়ে কাজ করে এই সংস্থা। স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার, জরুরি ওষুধ গবেষণা, স্বাস্থ্য বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে এমন ১০ জনকে ‘'ইমার্জিং লিডার’ হিসেবে ঘোষণা করে ন্যাম। আগামী তিন বছর ন্যাম আয়োজিত নানা রকম সেমিনার, কর্মশালা ও গবেষণা খাতে কাজ করার সুযোগ পাবেন তাঁরা। ন্যামের সভাপতি ভিক্টর জি ড্যাজু বলেন, ‘বর্তমানে চলমান মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে কাজ করবেন এই ইমার্জিং লিডাররা। বিজ্ঞানের নানা শাখাসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দক্ষ এই মানুষগুলোই আগামীর পৃথিবীকে আমাদের জন্য নিরাপদ করে তুলতে পারবে।’

এই তালিকায় একমাত্র বাংলাদেশি ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ড. এহসান হক। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা ও পেশাজীবন গড়ে তোলার পরও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। জর্জ ইনস্টিটিউট অব ডেটা সায়েন্সে কাজ করার সময় তিনি গড়ে তোলেন মরিস কে ইউডাল সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন পারকিনসন’স রিসার্চ সেন্টার। যেখানে এমআইটি, জনস হপকিনসসহ সারা বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিরা এক হয়ে পারকিনসন’স রোগের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন। পারকিনসন’স রোগ মূলত মানুষের নার্ভাস সিস্টেমকে অকেজো করে দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাত-পা নাড়াতে, কথা বলতে এমনকি স্বাভাবিক চলনবলনেও সমস্যা হয়। পারকিনসনসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কীভাবে ডিজিটাল ডিভাইস-কম্পিউটার, মোবাইল ব্যবহার করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে, সেটা নিয়েই কাজ করেছেন এহসান হক ও তাঁর গবেষক দল। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির ভিডিও দেখেই যেন কম্পিউটার সিস্টেম তার সমস্যাগুলো বুঝতে পারে, তেমন পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছেন তিনি।

ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্যও কাজ করেছেন এহসান হক। ক্যানসারে আক্রান্তদের দুই–তৃতীয়াংশ তাদের চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক সময়ে নির্দেশনা পায় না। ফলে শেষ সময়ে কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাদের। যে কারণে অনেকেই জীবন ফিরে পায় না কিংবা ভোগ করতে হয় অপরিসীম কষ্ট। কিন্তু এ ধরনের রোগীদের জন্য চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি করেন এহসান হক। তিনি রোগীদের মানসিক অবস্থা, তারা ডাক্তারের কথা শুনছে কি না—এগুলো বোঝার জন্য বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি করেন।

২০১৯ সালে মাইক্রোসফটের পাওয়ার পয়েন্টে যুক্ত হয় এহসানের গবেষণার কাজ ‘প্রেজেন্টার কোচ’। কোনো প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় বক্তা অপ্রাসঙ্গিক আওয়াজ করছেন কি না, সেটা বুঝতে সাহায্য করে প্রেজেন্টার কোচ।

এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েও গবেষণা করেছেন এহসান হক। বক্তৃতা দেওয়ার সময় বক্তা যেন আরও ভালোভাবে কথা বলতে পারেন, সেই প্রশিক্ষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আরও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিনি তৈরি করছেন ‘আরওসি স্পিক’। তাঁর তৈরি করা লাইভ ইনটারেকটিভ সোশ্যাল স্কিল অ্যাসিস্ট্যান্ট (লিসা) অটিজমে আক্রান্ত রোগীদের মুখের পেশির নড়াচড়া বুঝতে পারে। যার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত কেউ চাইলে স্বাভাবিক মানুষের মতোই কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। যারা গান গায় তাদের সুবিধার জন্য তিনি তৈরি করেছেন ‘ভাওয়েল শেপস’ নামের বিশেষ সফটওয়্যার। গান গাওয়ার সময় কোথায় কোথায় ভাওয়েল উচ্চারণ করা প্রয়োজন, শিল্পী সেগুলো ঠিকমতো করছেন কি না—এগুলো শনাক্ত করতে পারে এই সফটওয়্যার।

মেধাবী এহসান হকের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের মাটিতে। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ২০০৫ সালে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক এবং ২০০৭ সালে মেমফিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এরপর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মিডিয়া ল্যাবে নিজের পিএইচডি শুরু করেন। সেখানেই তিনি মানুষের মুখের পরিবর্তন দেখে কথা বুঝতে পারে এমন দুটি সফটওয়্যার ‘ম্যাক’ ও ‘লিসা’ উদ্ভাবন করেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ’-এ ৩৫ বছরের কম বয়সী সেরা গবেষকদের তালিকায় নাম উঠে আসে তাঁর। এ ছাড়া ওয়ার্ল্ড টেকনোলজি অ্যাওয়ার্ড, আর্লি ক্যারিয়ার অ্যাওয়ার্ড ফর সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স (ইসিএএসই) আছে তাঁর অর্জনের ঝুলিতে।

ছোটবেলায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিজ্ঞান, পছন্দের বিষয় কিংবা পেশা। তবে সব পছন্দকে ছাপিয়ে তিনিও সারা বিশ্বের জন্য ভালো কিছু করতে চেয়েছেন। এহসান বলেন, ‘বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নকশা, কলাতত্ত্ব, চিকিৎসা–স্বাস্থ্য এখন আর আলাদা কিছু নয়। বরং প্রতিটি বিষয় এখন ওতপ্রোতভাবে একে অন্যটির সঙ্গে জড়িত। তাই নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে নিজের স্বপ্নকে বেঁধে ফেলা চলবে না।’

ভবিষ্যতে নিজের সেরাটা দিয়েই পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করে যেতে চান তিনি। তাঁর জন্য শুভকামনায় আমরা সবাই।


কিশোর আলোর ফেব্রুয়ারি ২০১৮–এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এহসান হকের বিশেষ সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি পড়তে পারো এখানে