এই মায়াভরা চোখ

প্রাণিকুলে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে কুকুরকে। মানুষের আদর পাওয়ার দৌড়ে বিড়ালেরা নিঃসন্দেহে অনেক পিছিয়ে আছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভালোবাসা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। কুকুরেরা সেটা অর্জন করে নিয়েছে। আর তা শুধু প্রভুভক্তি দিয়ে নয়। অন্য একটা জিনিসের বিরাট ভূমিকা আছে এতে—একটা বিশেষ মাংসপেশির। সেটার অবস্থান কুকুরের চোখের চারপাশে। নাম লেভাটোর অ্যাংগুলাই অকুলাই ম্যাডিয়ালিস। কঠিন নাম। কাজটা সরল।

কী কাজ এই মাংসপেশীর? এটির গুণে কুকুরেরা তাদের দুই চোখ এমন বড়বড় করে ফেলতে পারে যে, তাদের বড় করুণ আর মায়াকাড়া দেখায়। বিশেষ করে মানুষের মুখের দিকে তাকানোর সময় কুকুরেরা এমন চেহারা করে। মানুষের মন তাতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। বিড়ালের মিউমিউ ধ্বনির চেয়ে এই সজল মায়াভরা চোখ অনেক বেশি কাজের।

কোথা থেকে এল এই মাংসপেশি?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৩৩ হাজার বছর আগে মানুষ জংলি কুকুরকে ধরে এনে পোষ মানিয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে বিবর্তনের পথে কুকুরের মুখমণ্ডলে ওই মাংসপেশি তৈরি হয়েছে।

এসব কোনো অনুমানের কথা নয়। অল্প কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।

গবেষণা করেছেন যৌথভাবে একদল ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিজ্ঞানী। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কুকুর ও নেকড়ের মুখমণ্ডল ব্যবচ্ছেদ করে তাদের মাংসপেশির তুলনা করেছেন। না, এ জন্য তাদের কোনো কুকুর বা নেকড়ে হত্যা করতে হয়নি। তারা সেটা করেছেন প্রাণিগুলোর ট্যাক্সিডার্মি বা পুতুল করে রাখা প্রতিরূপ থেকে।

কিন্তু কুকুরের দেহে একটা বিশেষ মাংসপেশী কোথা থেকে এল, তা জানতে নেকড়ের মাংসপেশি ঘাঁটতে হচ্ছে কেন? কারণ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কুকুরেরা এসেছে নেকড়ে থেকে বিবর্তিত হয়ে। কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে, কুকুর আর নেকড়ে আসলে জ্ঞাতি ভাই। তাদের পূর্বপুরুষ অভিন্ন। ফলে যদি দেখা যায়, কোনো নেকড়ের মুখমণ্ডলেই এই পেশি নেই, আছে শুধু গৃহপালিত নেকড়ে, অর্থাৎ কুকুরের মুখমণ্ডলে—তাহলে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিশ্চিত বলে দেওয়া যাবে, এই মাংসপেশি কুকুরের মধ্যে তৈরি হয়েছে মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে, ৩৩ হাজার বছরে।

অন্য কোনো প্রাণী মানুষের চেহারা দেখে তার মনের অবস্থা এতটা বুঝতে পারে না। মানুষের ব্যাপারে কুকুরের এই জ্ঞান তাকে শিখিয়েছে, কী করে মানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে আদর বা সুবিধা আদায় করতে হয়।

গবেষণায় কোনো নেকড়ের মুখমণ্ডলেই এই পেশি পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে শুধু কুকুরের মধ্যে।

একই রকম আরেকটি গবেষণা করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

চোখের চারপাশের পেশি কুকুরেরা কীভাবে ব্যবহার করে, বুঝতে সেখানে যা করা হয়েছে, সেটা খুব সরল।

মানুষের পরিবারে লালিত-পালিত হয় এ রকম ২৪ ধরনের কুকুরকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। আলাদা আলাদা করে একটা ফাঁকা কক্ষে নেওয়া হয় সেগুলোকে। সেখানে প্রতিটি কুকুর একটি করে অপরিচিত মানুষের মুখোমুখি হয়। চার রকমের পরিস্থিতি হাজির করা হয় তাদের সামনে। একটি ক্ষেত্রে অপরিচিত মানুষটি হাতে খাবার ধরে কুকুরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আরেক ক্ষেত্রে লোকটি কুকুরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে হাতে কোনো খাবার নেই। আরেক ক্ষেত্রে মানুষটি হাতে খাবার নিয়ে কুকুরের দিকে উল্টো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। চতুর্থ পরিস্থিতিতে লোকটি উল্টো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, তবে তার হাতে কোনো খাবার নেই।

একটা শক্তিশালী ক্যামেরা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা চার পরিস্থিতিতে কুকুরের চেহারা বা অভিব্যক্তি কী দাঁড়ায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিশেষ করে মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি।

দেখা গেছে, মানুষটি যখন হাতে খাবার নিয়ে কুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে, শুধু তখনই কুকুরের চোখে সেই শিশুসুলভ করুণ চাহনি তৈরি হচ্ছে। মানুষটি উল্টো দিকে ঘুরে থাকলে হচ্ছে না। অর্থাৎ ওই রকম বিষণ্ন মুখ করে কুকুরটি মানুষের মধ্যে করুণা উদ্রেক করতে চায়। সন্দেহ নেই, মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই চেহারা করা।

আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, কুকুরেরা মানুষের মুখের অভিব্যক্তি অন্য যেকোনো প্রাণির চেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারে। অর্থাৎ তারা মুখ দেখেই বুঝে যায়, কেউ রেগে আছে, বিষণ্ন হয়ে আছে, নাকি আনন্দে আছে।

এই গবেষণায় বিভিন্ন মানুষের ছবি দেখানো হয় কুকুরগুলোকে। কোনোটায় লোকটা রেগে আছে। কোনোটায় লোকটার হাসি হাসি মুখ। কোনোটায় লোকটার চেহারায় কোনো অভিব্যক্তিই নেই। বিজ্ঞানীরা দেখার চেষ্টা করেছেন, কোন ধরনের মুখের দিকে কুকুরেরা কীভাবে তাকাচ্ছে। দেখা গেছে, যেসব ক্ষেত্রে মানুষের মুখে অভিব্যক্তি আছে, সেসব মুখের দিকে কুকুরেরা মনোযোগ দিয়ে তাকাচ্ছে। তার মানে তারা অভিব্যক্তি বুঝতে পারছে।

অন্য কোনো প্রাণী মানুষের চেহারা দেখে তার মনের অবস্থা এতটা বুঝতে পারে না। মানুষের ব্যাপারে কুকুরের এই জ্ঞান তাকে শিখিয়েছে, কী করে মানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে আদর বা সুবিধা আদায় করতে হয়।

বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন, মানুষের অভিব্যক্তি আসলে মানুষের নিজস্ব একটা ভাষা। এটা দিয়ে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে। একে অন্যকে বোঝাতে চায় তার মনের অবস্থা। অন্য কোনো প্রাণী মুখমণ্ডলে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারে না। তারা সেটা করে আচরণ দিয়ে, আওয়াজ করে।

এত দিন মনে করা হতো, মুখমণ্ডলে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটা মানুষের একার কৃতিত্ব। এখন দেখা যাচ্ছে, মানুষের সবচেয়ে কাছের প্রাণী কুকুরেরাও এই গুণ শিখে নিয়েছে। আর সেটা তারা শিখেছে মানুষের কাছ থেকে। করুণ চোখের চাহনি মানুষের বিশেষ একটি অভিব্যক্তি। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কাছ থেকে করুণা আদায় করে এই চাহনি দিয়ে।

একটা ব্যাপার ভেবে দেখার মতো। কুকুর যদি মানুষের করুণা আদায় করার জন্যেই এই অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার কায়দা রপ্ত করে থাকে, তার মানে কুকুরেরা জানে, মানুষ অন্যের চেহারার দিকে মনোযোগ দেয়। মানুষ চেহারার ভাষা পড়ে থাকে।

মজার ব্যাপার হলো, মানুষের চোখের চারপাশে ওই একই পেশি কিন্তু নেই। মানুষ এই কাজ করে ভিন্ন একটি পেশি ব্যবহার করে।      

এই সব গবেষণার সারকথা একটিই। এতোদিন যতোটা মনে করা হতো, মানুষ আর কুকুরের মধ্যে সম্পর্ক তার চেয়েও অনেক নিবিড়। মানুষ তার পোষা প্রাণির সঙ্গে আবেগগত অভিব্যক্তি বিনিময় করতে পারে। তারা একে অপরের চেহারার ভাষা বোঝে।