একই বৃন্তে তিন ফুল

আজ থেকে প্রায় দুই শ বছর আগের কথা। ১৮২০ সাল। ডেনিস পদার্থবিদ হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটালেন। অবশ্য ঘটনাটা কাকতালীয়। তিনি বিদ্যুৎ–প্রবাহের ওপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। কাছে ছিল একটি বিদ্যুৎ বর্তনী। আর ছিল একটি শলাকা চুম্বক। ওয়েরস্টেড বিদ্যুৎ বর্তনী সম্পর্কে বোঝাচ্ছিলেন উপস্থিত দর্শকদের। তখন ওই বর্তনীর ভেতর বিদ্যুৎ–প্রবাহ চলছিল। কোনো এক কারণে বিদ্যুৎ বর্তনীটা কম্পাসের খুব কাছে চলে আসে। আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে তখন। বিদ্যুৎ বর্তনীর কাছাকাছি এসে ঘুরে যায় কম্পাসের কাঁটাটা। চমকে ওঠেন ওয়েরস্টেড!

কেন এমন ঘটল? তবে কি বিদ্যুৎ ও চুম্বকের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে?

ওয়েরস্টেড বিষয়টা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন, বদলে দিলেন বর্তনীতে বিদ্যুৎ–প্রবাহের দিক। অর্থাৎ আগে যেদিকে বিদ্যুৎ–প্রবাহ চলছিল, এবার বিদ্যুৎ–প্রবাহকে তার উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। দেখলেন, কম্পাসের কাঁটাও ঘুরে গেল। আগেরবার কম্পাসের কাঁটা যেদিকে ঘুরেছিল, এবার ঘুরল তার উল্টোদিকে। ওয়েরস্টেড নিশ্চিত হলেন, বিদ্যুৎ ও চুম্বকের মধ্যে সম্পর্ক আছে। কিন্তু সম্পর্কটা কী, কেমনভাবে এই সম্পর্ক কাজ করে, তার কারণ অনুসন্ধান করলেন না। তবে এই ঘটনা অন্য বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত করল।

১৮২০ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী ফ্রান্সোয়া অ্যারাগো আরেকটা ঘটনা লক্ষ করলেন। তিনি দেখলেন, একটা বিদ্যুৎবাহী তার চুম্বকের মতো আচরণ করে। বিদ্যুৎবাহী তারের আশপাশে লোহার গুঁড়া রাখলে তারটি সেগুলোকে আকর্ষণ করে। চুম্বক যেভাবে লোহার গুঁড়াকে আকর্ষণ করে, সেভাবে। বিদ্যুৎ–প্রবাহ বন্ধ করে দিলে আকর্ষণক্ষমতাও হারায় সেই বিদ্যুৎবাহী তার। এরপর থেকে বিজ্ঞানীরা বিদ্যুৎ ও চুম্বকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন।

সে বছরই বিদ্যুৎ চুম্বকের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ফরাসি বিজ্ঞানী আন্দ্রে মারি অ্যাম্পেয়ার। তিনি আবিষ্কার করলেন, দুটি বিদ্যুৎবাহী তারকে যদি সমান্তরালে পাশাপাশি রাখা হয়, তবে তার দুটি একে অন্যকে আকর্ষণ করে। তবে তার দুটিতে একই দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করতে হবে। আর দুই তারে বিদ্যুৎ–প্রবাহ যদি পরস্পরের উল্টো দিকে হয়, তাহলে তার দুটি একে অন্যকে বিকর্ষণ করবে।

(বাম থেকে) ম্যাক্সওয়েল, ফ্যারাডে, ওয়েরস্টেড

সমসাময়িক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। তিনি একটু উল্টোভাবে ভাবতে শুরু করলেন। বিদ্যুৎ যদি চুম্বক তৈরি করতে পারে, তাহলে চুম্বকও কি বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে না? শুধু ভাবলেনই না, কাজে লেগে পড়লেন। একটা দণ্ড চুম্বক নিলেন ফ্যারাডে। তারপর পরিবাহী তার দিয়ে তৈরি করলেন একটা কুণ্ডলী। দণ্ড চুম্বকটা ঢোকালেন কুণ্ডলীর ভেতর। তবে কুণ্ডলীর দুই প্রান্ত কিন্তু ব্যাটারি বা অন্য কোনো বিদ্যুৎ উৎসের সঙ্গে যুক্ত করলেন না। সুতরাং সেই কুণ্ডলীতে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ–প্রবাহের কোনো সম্ভাবনাই রইল না। এরপর ফ্যারাডে চুম্বকটিকে কুণ্ডলীর ভেতরে বারবার প্রবেশ করালেন এবং বের করলেন। ফলে বিদ্যুৎ–প্রবাহ তৈরি হলো পরিবাহী তারে। কিন্তু চুম্বক স্থিরভাবে কুণ্ডলীর ভেতর রেখে দিলে কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় না। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মতো। যখন চুম্বক কুণ্ডলীর ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে, তখন বিদ্যুৎ একদিকে প্রবাহিত হচ্ছে। যখন চুম্বক বের করা হচ্ছে, তখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে বিপরীত দিকে। এই ঘটনা মানবসভ্যতার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মোড় ঘুরে গিয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানেরও। যেমনি করে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন এরও দুই শ বছর আগে আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন। তিনি দেখিয়েছিলেন, যে বলের কারণে গাছের আপেল মাটিতে পড়ে, সেই একই বলের করণে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে।

ওয়েরস্টেডের কাকতালীয় ঘটনার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তিনটি প্রাকৃতিক বলের কথা জানতেন। মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ আর চুম্বক বল। ওয়েরস্টেড, অ্যাম্পিয়ার আর ফ্যারাডে মিলে দুটি বলকে এক করে ফেললেন। বিদ্যুৎ আর চৌম্বক বল মিলে হলো বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল।

এর কয়েক দশক পর স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েলের কোলে জন্ম নিল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রাথমিক পর্যায়। তিনি একগুচ্ছ সমীকরণের সাহায্যে বিদ্যুৎ আর চুম্বকীয় বলকে গাণিতিকভাবে গেঁথে ফেললেন একসূত্রে। শুধু তা–ই নয়, আগে যে কথা কারও মাথাতেই আসেনি, সেই আলোকেও তিনি বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের বন্ধনে আটকে ফেললেন। তিনি দেখালেন, বিদ্যুৎ, চুম্বক আর আলো খোলা চোখে আলাদা মনে হলেও এগুলো একই বলের আলাদা রূপ। জন্ম হলো তিনটি আলাদা শক্তি বা বলের সমন্বিত রূপ বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের। ম্যাক্সওয়েল তাঁর সমন্বিত বলকে ব্যাখ্যা করলেন চার–চারটি সমীকরণের সাহায্যে। যখন যে পরিস্থিতিতে যেটা দরকার হবে, তখন সেই সমীকরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে হবে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের প্রকৃতি।

অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা গেল ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে। যেমন যেখানে কোনো চার্জ নেই, বিদ্যুৎ–প্রবাহ নেই, চুম্বকও নেই; সেখানে আসলে কী ঘটে?

ম্যাক্সওয়েল নিজেই পরীক্ষা করলেন। এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলেন, শূন্যস্থানেও বিদ্যুৎ–চুম্বকের প্রভাব রয়েছে। আর সেই প্রভাব শূন্যস্থানে ছড়িয়ে আছে ঢেউয়ের মতো। অর্থাৎ একটা বলক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে শূন্যস্থানে। এই বলক্ষেত্রের কথা অবশ্য বলেছিলেন মাইকেল ফ্যারাডে ও ফরাসি বিজ্ঞানী চার্লস অগাস্তিন ডি কুলম্বও। কিন্তু এত বিস্তারিত খবর তাঁরা দিতে পারেননি।

আরও পড়ুন

কুলম্ব বলেছিলেন, ধরা যাক, কোনো স্থানে একটি চার্জ আছে। তার থেকে কিছু দূরে আছে আরও একটি চার্জ। সুতরাং প্রথম চার্জটির কাছ থেকে দ্বিতীয় চার্জটি আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল অনুভব করছে।

কথা হচ্ছে এই দ্বিতীয় চার্জটি কীভাবে বুঝল যে ওখানে আরেকটি চার্জ আছে? এ প্রশ্নের উত্তরে কুলম্ব বলেছিলেন, দূরক্রিয়ার প্রভাবের কথা। অর্থাৎ একটা চার্জ আরেকটি চার্জের কাছাকাছি রাখলে সঙ্গে সঙ্গে তারা টের পেয়ে যাবে একে অন্যের উপস্থিতির কথা। অর্থাৎ একটা থেকে আরেকটায় বৈদ্যুতিক চৌম্বক বলের খবর পৌঁছাতে সময়ই লাগবে না। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল মানতে পারেননি দূরক্রিয়ার ধারণা। তিনি বলেছিলেন, প্রথম চার্জটির উপস্থিতির জন্য শূন্যস্থানে সৃষ্টি হচ্ছে একটি বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ঢেউ বা তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রথম চার্জটির বৈদ্যুতিক বার্তা। সেই তরঙ্গের সঙ্গে অন্য কোনো চার্জের যখন দেখা হচ্ছে, তখন তরঙ্গের কাছ থেকে সেই চার্জটি পেয়ে যাচ্ছে প্রথম চার্জের কাছ থেকে পাঠানো বার্তা।

ওয়েরস্টেডের বিদ্যুত-চুম্বক বর্তনী

কথা হচ্ছে, বার্তা যখন পাঠানো হয়, সেই বার্তা প্রেরকের হাতে পৌঁছাতে নিশ্চয়ই সময় লাগে। এ ক্ষেত্রে প্রথম চার্জের পাঠানো বৈদ্যুতিক বার্তা আরেকটি চার্জের কাছে পৌঁছাতে কিছুটা হলেও সময় লাগবে। কত সময় লাগবে, সেটাও ম্যাক্সওয়েল বের করে ফেললেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আলোও একপ্রকার বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ। তাই যেকোনো বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ আর আলো একই বেগে চলে।

ম্যাক্সওয়েল যখন বিদুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করছেন, তত দিনে আলোর গতিবেগ মানুষের জানা হয়ে গেছে—সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। এ কথাও সবার জানা হয়ে গেছে, আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে এর বেগের কোনো সম্পর্ক নেই। আলোর বেগ ধ্রুব—তা পরে আইনস্টাইনই ব্যবহার করেছেন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতায়। তাই কোনো বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গেরই গতিবেগ বাড়া-কমার কোনো সুযোগ রইল না।

তিন বলের এক হওয়ার খবর কেন স্ট্রিং তত্ত্বের মাঝখানে চলে এল? আসলে পদার্থবিজ্ঞান সব সময় সরলীকরণ পছন্দ করে। পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে প্রকৃতির ধর্মকে। প্রকৃতির সূত্রগুলোকে যদি একটা গাছের মতো দেখি, তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে তুলনা করা যেতে পারে সেই গাছের ডালপালার সঙ্গে। বিদ্যুৎবিদ্যা, চুম্বকবিদ্যা, আলোকবিদ্যা, মহাকর্ষ বল ও গতির সূত্র—এগুলো সেই গাছের একেকটি শাখা। এই শাখাগুলো মিলিত হবে কাণ্ডে গিয়ে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান সেই গাছটির কাণ্ডতে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। পেয়েছে প্রধান দুটি ডালের দেখা—একটা হচ্ছে সাধারণ আপেক্ষিকতা আর অন্যটা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কিন্তু এই দুই তত্ত্বের একটি অভিন্ন কাণ্ড থাকা উচিত; পদার্থবিজ্ঞান সেই কাণ্ডেরই সন্ধান করছে। আর কাণ্ডের খোঁজ পেতে হলে এর শাখা-প্রশাখাগুলো কীভাবে একত্র হয়ে প্রধান শাখায় এসে মিলেছে সে গল্প জানা জরুরী। আর সেই গল্পই আমরা জানলাম এই লেখায়। কিন্তু একীভূত বিজ্ঞানের গল্প এখানেই শেষ নয়। তবে সে গল্প তোলা থাক আগামী পর্বের জন্য।