
গ্রামীণ সমাজে উৎসবের তো আর শেষ নেই। যেকোনো উপলক্ষে এখানকার মানুষ ঘটা করে আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন। বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসে গ্রামে গ্রামে চলে নানা লোকজ খেলার আয়োজন। সে আয়োজনে দলেবলে শামিল হয় আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। বাবা-চাচার কাঁধে চড়ে কিংবা আঙুলে ধরে ছোটরাও এসব খেলা দেখতে ভিড় জমায়। কত কী যে খেলা। ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, গরুর দৌড়, মোরগের লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো, মইদৌড়, লাঠিখেলা, কুস্তি—আয়োজনের তো কোনো কমতি নেই!
আমাদের দেশে অঞ্চলভেদে সেই সুদীর্ঘকাল ধরেই নানা ঐতিহ্যবাহী খেলার প্রচলন রয়েছে। এসব আয়োজন কোথাও কোথাও অনেকটা লোকাচারে পরিণত হয়ে গিয়েছে। চৈত্র মাসের প্রথম থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটার আগ মুহূর্তে কিংবা বৈশাখে ধান কাটার ব্যস্ত সময়ের মধ্যে একচিলতে অবসরে আয়োজন করা হয় নানা লোকখেলার। এর মধ্যে ষাঁড়ের লড়াই ও মোরগের লড়াই-ই বেশি হয়ে থাকে। গ্রামের পাশের খলা (ধান শুকানোর স্থান) কিংবা খোলা মাঠে ঢাকঢোল পিটিয়ে বর্ণিল আয়োজনে চলে এসব আয়োজন।

খেলাধুলার আয়োজনে হাওরাঞ্চল তো বরাবরই এগিয়ে রয়েছে। তবে পিছিয়ে নেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলও। এই তো সেদিন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দাসউড়া উচ্চবিদ্যালয়ের পশ্চিম মাঠে গ্রামবাসী ও প্রবাসী শৌখিন মানুষের উদ্যোগে মোরগের লড়াই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। ১৫ বছর ধরে একই স্থানে এ আয়োজন হয়ে আসছে। মোরগ লড়াই উপলক্ষে সে কী আয়োজন! পোস্টার-ব্যানার ছাপিয়ে আর মাইকিং করে সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই চালানো হয় প্রচারণা। বিশাল প্যান্ডেল বেঁধে তৈরি করা হয় উৎসবস্থল।
সকাল ১০টায় খেলা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ভোর থেকেই উৎসবস্থলে মানুষের সমাগম হতে থাকে। নির্ধারিত সময়ের আগেই হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মাঠ ভরে যায়। মোরগের লড়াইয়ের আয়োজন হলেও মাঠজুড়ে বসে বারোয়ারি মেলা। এ সুযোগে ছোটরা নানা ধরনের খেলনা থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্রও কেনাকাটা করে ফেলে। আর শসা-ছানাচুর খাওয়া তো ছোট-বড় সবার মধ্যে হরদম চলতে থাকে।

বিয়ানীবাজার উপজেলা ছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে শৌখিন মানুষ প্রতিযোগিতাস্থলে মোরগ নিয়ে হাজির হন। প্রতিযোগিতায় প্রায় অর্ধশতাধিক মোরগ দিনভর জমজমাট লড়াইয়ে মেতে ওঠে। কত প্রজাতির মোরগ যে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। ইয়া বড় বড় নখ আর সে কি খকখক হুংকার! কোনো কোনো মোরগ-মালিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা অঞ্চল থেকে একধরনের বিশেষ লড়াকু জাতীয় মোরগ নিয়ে আসেন কেবল লড়াইয়ের জন্য। ‘যোদ্ধা-মোরগ’ হিসেবে এদের সুনাম সারা দেশে। এগুলো ‘সরালি মোরগ’ নামেও সুপরিচিত। উঁচু ও লম্বাটে এসব মোরগের কদরও কিন্তু কম নয়। ভাবা যায়—একেকটি মোরগের দাম ১৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা!

মোরগ-মালিকেরা প্রতিযোগিতায় জয়লাভের জন্য যোদ্ধা-মোরগগুলোর পায়ের নখ ব্লেড দিয়ে তীক্ষ্ণ করে নেন। যতক্ষণ পর্যন্ত মোরগ লড়াই করে রক্তাক্ত হয়ে পরাজিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত খেলা চলে। ৫০টি মোরগ নিজেদের মধ্যে লড়াই শেষে ফয়েজ আর কনকু সাহেবের মোরগ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। এ দুই শৌখিন মালিকের মোরগের মধ্যে সেদিন চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কোনো মোরগই বিনা যুদ্ধে পরাজয় মেনে দিতে নারাজ! দুই মোরগে সে কী লড়াই! ঘণ্টা খানেক ধরে লড়াই চললেও কেউ কাউকে হারাতেই পারেনি। ফলে বাধ্য হয়ে আয়োজকেরা দুই মোরগকেই যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে। মানুষজনও পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলে বাড়ি ফেরেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিবেশবাদীরা প্রাণী দিয়ে নির্মম লড়াই করানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান নিলেও বাংলাদেশে গ্রামীণ মানুষ যুগের পর যুগ ধরে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করে আসছে। সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, শেরপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লাসহ দেশের নানা জেলায় মোরগের লড়াই এক জনপ্রিয় লোকজ খেলা হিসেবে এখনো সমান-ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
ছবি: আনিস মাহমুদ