কমলা ফুলি, কমলা ফুলি...

সিলেটের জৈন্তাপুরে কমলা পাকার আগে পরিচর্যায় ব্যস্ত একজন চাষি
সিলেটের জৈন্তাপুরে কমলা পাকার আগে পরিচর্যায় ব্যস্ত একজন চাষি

সারি সারি গাছ। সব কটা যেন ফলের ভারে নোয়া। সবুজ পাতার ফাঁক গলে থোকা থোকা ফল, কমলা ধরেছে। সবুজ রং মিইয়ে একটু লাল-হলুদ হলেই পাকবে কমলা। সিলেটের কমলাবাগানের এই দৃশ্য দেখেই বুঝিবা ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একদা লিখেছিলেন:

কমলা ফুলি, কমলা ফুলি

কমলা লেবুর ফুল,

কমলা ফুলির বিয়ে হবে

কানে মোতির দুল।

কমলা ফুলির বিয়ে দেখতে যাবে,

ফলার খাবে চন্দনা আর টিয়ে।

কোথায় থাক কমলা ফুলি

সিলেট আমার ঘর,

টিয়ে বলে দেখতে যাব

পাখায় দিয়ে ভর।

ছড়াটি পাঠ্যসূচিতে এখন নেই। তবে সিলেট অঞ্চলে এখনো বহুল পঠিত। কারণ, কমলার ফলন। ছড়ায় কমলা ফুলির ঘর সিলেট। আর মৌসুমের এই সময়ের ফল কমলার ফলনও হয় সিলেটে। কমলা খেয়ে রসে সিক্ত হয়েছে, কিন্তু দেখা হয়নি কখনো কমলার গাছ—এমন অনেকেই আছে।

সুস্বাদু লেবুজাতীয় ফল কমলা। গাছও ঠিক লেবুর মতোই দেখতে। বেঁটে আর লিকলিকে ডালপালা। লেবুগাছ চেনা থাকলে কাঁচা কমলার গাছ প্রথম দেখাতে নির্ঘাত লেবুগাছ বলে ভুল করতে হবে। শীত ঝেঁকে বসার আগে গাছের সবুজ কমলা স্বরূপে ফেরে। রসে টসটস তখনই, ঝড়ে পড়ে গাছ থেকে পাকা কমলা। কেনাবেচায় ঝাঁপি ঝাঁপি কমলা তখন দেখা মেলে সিলেট আর এর আশপাশের হাটে-বাজারে। পুরো শীতকাল কমলার মৌসুম। তবে আগাম ফলন হলে শীতের মাস খানেক আগে থেকে পাওয়া যায় কমলা।

অনেক আগে কেবল বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলেই কমলার চাষ হতো। তবে এখন দেশের দিনাজপুর, পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভাবে কমলার চাষ শুরু হয়েছে। এদিকে চাষের কমলা সিলেটে ঘরের কমলা হিসেবে সমাদৃত। সিলেট জেলার সদরসহ বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার ও হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার টিলা-পাহাড় এলাকায় একসময় প্রচুর কমলার চাষ হতো। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কমলা চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও রপ্তানি হতো। তখন কমলাই ছিল এ অঞ্চলের চাষিদের প্রধান অর্থকরী ফসল।

তবে এখন আর সেই চাষবাস নেই। কেন নেই—এ নিয়ে গবেষণারও অন্ত নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ষাটের দশকে সিলেট অঞ্চলের কমলাবাগানে বড় আকারের মড়ক দেখা দেয়। মড়কে অধিকাংশ কমলাবাগান নষ্ট হয়ে যায়। এই ক্ষতি পোষাতে না পেরে অনেক চাষি কমলা চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কমলা উৎপাদনের যে পরিবেশ আর প্রকৃতি দরকার, তার সবই এখনো আছে। এ জন্য আগের মতো না হলেও কমলা চাষ আছে, আছে কমলার বাগানও।

সিলেটে কমলা উৎপাদন বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বছর দশেক আগে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ‘বৃহত্তর সিলেট সমন্বিত কমলা চাষ উন্নয়ন’ নামে আট বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে আট হাজারের বেশি কমলার নতুন বাগান করার পরিকল্পনা হয়। ২০০১ সালের জুলাই থেকে ২০০৬ সালের জুন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ চলে। চার জেলায় ২৫০টি বাগান তৈরির স্থান নির্ধারণ করা হয়। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় পাঁচ হাজার কমলা চাষিকে। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুফল হচ্ছে এখনকার কমলা চাষ। সব মিলিয়ে সিলেট অঞ্চলে ২৮২ হেক্টর জমিতে হয় কমলা চাষ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে সিলেটে কমলার গড় উৎপাদন ১ হাজার ৪৭০ মেট্রিক টন।

এ তো গেল কমলা চাষবাসে কৃষি তথ্যকথা। এবার কমলা মৌসুমে একটু বাগানের দিকে ঢুঁ মারা যাক। কমলার গাছ সারিবদ্ধভাবে হয়। সমতল থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু অথবা টিলা শ্রেণির ভূমিতে বেড়ে ওঠে কমলার গাছ। এ জন্য কমলার সব বাগান সমতল থেকে উঁচুতে পাহাড়-টিলায় দেখা যায়। একেকটি গাছের উচ্চতা তিন-চার ফুট থেকে ১০ ফুটও হয়। পরিপক্ব হওয়ার পরও কমলাগাছ বেঁচে থাকে ২০-২৫ বছরও। গাছে ফুল ফোটার তিন মাস পরই ফল কমলা দেখা যায়। তখন কমলাগাছ যেন ফলের ভারে নুইয়ে পড়ে। সব কমলা তো দেখতে গোলগাল আর রসে টইটম্বুর। এর মধ্যে কিন্তু স্বাদ আর জাতভেদে রকমফেরও আছে। উৎপাদন এলাকার সঙ্গে কমলার নানা নামকরণও নজর কাড়ে। এর মধ্যে সিলেটের বিয়ানীবাজারে উৎপাদিত ‘জলঢুপী’ কমলার পরিচিতি ব্যাপক। বড় সুস্বাদু আর সুঘ্রাণ জলঢুপী কমলার।

জলঢুপী বিয়ানীবাজারের একটি এলাকার নাম। জলঢুপী কমলা ছাড়াও ওই এলাকায় উৎপাদিত আনারসও একই নামে আলাদা কদর। আর আছে ছাতকের কমলা। বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি ও বালাটের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত জাতের কমলার চাষ হয় ছাতকের টিলা এলাকায়। ছাতকের কমলারও আলাদা নাম। ‘চেলার কমলা’ নামে চেনে সবাই।   

সিলেটের কদমতলী বাজারে কমলা বিকিকিনি করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা
সিলেটের কদমতলী বাজারে কমলা বিকিকিনি করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা

সিলেটের মাটি ও প্রকৃতি কমলা চাষ উপযোগী। তবে গাছ রোপণ করলেই আপনাআপনি কমলা হয়, এমন কিন্তু নয়। বছরজুড়ে কমলাচাষিদের চলে নানা খাটাখাটুনি। লাভ-লোকসানের হিসাব কষে দেখা যায় উৎপাদিত কমলা আর আমদানি করা কমলার বাজারমূল্যে তারতম্য। এ হচ্ছে বাণিজ্যিক দিক, এসব বিবেচনায় এখন আর আগের মতো নেই রমরমা সেই কমলার ফলন। তাই সারা দেশের মতো কমলার ঘর সিলেটও আমদানিনির্ভর। তবু কমলা মৌসুমের শুরু হয় ঘরের ফলন দিয়ে। আমদানি করা কমলার ভিড়েও ‘সিলেটি’ অথবা ‘ঘরের’ কমলা নামে রয়েছে আলাদা কদর। হাট-বাজারগুলোতে উঠতে শুরু করেছে সুবাসিত কমলা। দেদার চলছে কমলার কেনাবেচা।

মৌসুমের এই সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়ার চরিত্র কমলা ফুলির বিয়ে দেখতে নয়, কমলা খেতে ‘পাখায় দিয়ে ভর’ করে সিলেট যাওয়া যায়! ছড়ার সেই টিয়ে পাখির মতোন!

ছবি: আনিস মাহমুদ