কাদামাটির কারিগর

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প হলো কাদামাটির শিল্প। এর সুন্দর একটা নাম আছে। মৃৎশিল্প। মৃৎ মানে মাটি। মাটির এই শিল্পকে তাই মৃৎশিল্প বলে। আগুন আবিষ্কারের আগে মানুষ কাঁচা খাবার খেত। আগুনের ব্যবহার শেখার পর রান্নাটাও শিখল। রান্নার জন্য দরকার হলো পাত্রের। প্রথম দিকে বাঁশ-খড় দিয়ে তৈরি ঝুড়িতে মাটি লেপে তৈরি  হলো পাত্র । মানুষ খেয়াল করল, রান্নার পর পাত্রের মাটির প্রলেপ পুড়ে শক্তপোক্ত হয়ে যায়। এ ভাবনা থেকেই জন্ম হলো পোড়া মাটির পাত্রের। তবে তখন মাটির পাত্র এত নিপুণ ছিল না। কারণ তখনো চাকা আবিষ্কার হয়নি। হাতে তৈরি পাত্র অত নিপুণ হয় না। এরপর চাকা আবিষ্কার হলো। আদিম মানুষ দেখল, চাকার সাহাযে্য পাত্র তৈরি করলে সেগুলো বেশ সুন্দর হয়। এভাবেই জন্ম হলো মৃৎশিল্পের। বিশ্বের প্রাচীন সব সভ্যতার নিদর্শনেই পোড়ামাটির তৈজসপত্র পাওয়া গেছে। আমাদের উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতায়।

মৃৎশিল্পীদের বলা হয় কুমোর বা কুমার। এ দেশের সব কুমোরের নামের শেষে ‘পাল’ পদবি আছে। কেন এই পদবি ওরা নিজেরাই জানে না। এটা ওদের বংশগত পেশা। নতুন করে অন্য পেশার মানুষকে এ পেশায় নামতে দেখা যায় না।

গাড়ির চাকার মতো একটা চাকা বসানো থাকে কুমারের ঘরের মেঝেয়। গর্ত খুঁড়ে বিশেষ কায়দায় বসানো হয় চাকাটা। একটা লোহার ছোট্ট দণ্ড পোঁতা থাকে গর্তে। তার মাথায় গাড়ির চাকার বিয়ারিং লাগানো। সেই দণ্ডের ওপর ঘোরে কুমোরের চাকা। চাকার ওপর একটা গোল পাটাতন আছে। তার ওপর বসানো থাকে একতাল কাদা।

বাঁশের একটা লাঠি দিয়ে কুমোর একবার করে ঘুরিয়ে নেন চাকা। বাকিটা হাতের কাজ। কলসি, হাঁড়ি, পাতিল, শানকি, মালসা ইত্যাদি নানা রকম জিনিস তৈরি হয় একই কাদা দিয়ে। কুমোর ঠিক করে নেন কী বানাবেন। তারপর চাকার ওপর ঘুরন্ত কাদায় হাত রাখেন। একেকটা জিনিসের জন্য কাদার ওপর হাত রাখতে হয় একেকভাবে। একটু ভুলচুক হলেই সব মাটি। সময় যত যায় কাদার তাল একেক রকম চেহারা ধরে। তখনো বোঝার উপায় নেই জিনিসটা কিসে গিয়ে দাঁড়াবে।

একেবারে জাত শিল্পীর হাত কুমোরদের। নিপুণ হাতে কাদার ওপর ঢেউ খেলিয়ে পাতিলের চেহারা তৈরি করেন। কলসের কথায় ধরা যাক। প্রথম দিকে গোলমতো একটা ফাঁপা জিনিস তৈরি হয়। তারপর ধীরে ধীরে সেটা বড় হতে থাকে। জিনিসটা যত উঁচু হয়, ধীরে ধীরে বেঁকে ছোট হয়ে আসে সেটার মুখ। একসময় কুমোর একটু বেশি জোরে চেপে ধরেন কাদাটা। এবার তৈরি হয় কলসের গলা। তারপর হাত উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নেন তিনি। গলাটা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়। তৈরি হয় কলসের মুখ। এরপর কুমোর ব্যবহার করেন বাঁশের ধারালে চোঁছ। চোঁছটা ঘুরন্ত পাতিলের গায়ে ধরেন। অপ্রয়োজনীয় কাঁদা কেটে মসৃণ হয় কলস। সবশেষে কলসের নিচের দিকে বাঁশের চোঁছটা ধরেন ছুরির মতো করে। কাদার তাল থেকে কলসটা কেটে আলাদা হয়ে যায় । কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। কুমোর এবার হাত ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে চাকাটা থামিয়ে ফেলেন। তারপর দুহাত দিয়ে আলতো করে ধরেন কলসটাকে। কাটা কলস সাবলীলভাবে উঠে আসে তাঁর হাতে। কুমোর সেটা রেখে আসেন রোদে। শুকানোর জন্য।

বিশেষ এক দণ্ডের ওপর ঘুরছে কুমোরের চাকা
বিশেষ এক দণ্ডের ওপর ঘুরছে কুমোরের চাকা

তারপর অবশিষ্ট কাদা দিয়ে আবার নতুন পাতিল তৈরি করতে বসেন কুমোর। একবার চাকা ঘুরিয়ে একটা পাতিল তৈরি হয়। দুই-তিন মিনিট সময় লাগে। চাকাটাও ঘোরে খুব সাবলীলভাবে। চাকার ওপর পাতিল কিংবা কলসের অর্ধেকটা তৈরি হয়। এদের তলার দিকটা তৈরি হয় আরেক জায়গায়। একটা শুকনো মাটির ঢিবি থাকে আরেক ঘরে। সেই ঢিবির মাপ পাতিলের তলার সমান। ঢিবির ওপর কাদা বসিয়ে পিটনি দিয়ে পেটান কুমোরের বউ। তারপর সেটা গোল একটা প্লেটের মতো চেহারা পায়। সেই প্লেটটাই কায়দা করে লাগিয়ে দেওয়া হয় পাতিল কিংবা কলসের নিচে। তৈরি হয়ে যায় সম্পূর্ণ পাতিল।

কিছু জিনিস তৈরি করেন কুমোর মেয়েরা। যেমন: রুটির তাওয়া, মালসা, শানকির কান্দা ইত্যাদি। এসবের জন্য পাথরের ছোট একধরনের চাকা আছে। মেয়েরা চাকটাকে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে এসব জিনিস তৈরি করেন খুব ধীরে ধীরে।

পাতিল রোদে শুকানো হয় দু-তিন দিন। শুকিয়ে সেটা শক্ত-সাদা হয়ে যায়। এরপর পোড়ানো হয় আগুনে। পাতিল পোড়ানোর জন্য বিশাল এক চুলা থাকে কুমোরের বাড়ির উঠোনে। প্রায় ইটের ভাটার সমান। সেই চুলার ওপর থাকে মাটির মস্ত বড় এক তাওয়া। তাওয়ার মাঝখানে একটা গোল ঢিবি। ঢিবির চারপাশে সাজানো হয় শুকনো পাতিলগুলো। তারপর চুলোর ইয়াবড় মুখ দিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা জ্বাল দিলে লাল হয়ে আসে পাতিলগুলো। তখন সেগুলো বিক্রির উপযোগী হয়।

শুধু হাঁড়ি-পাতিল বানান না কুমোরেরা। নানা রকম খেলনাও তৈরি করেন। ছোট ছোট হাঁড়ি, কড়াই, কলস, পুতুল, ঘোড়া ইত্যাদি। নানা রঙে সজানো। ফুল ও নকশা আঁকা। পুজো কিংবা বৈশাখী মেলায় কুমোরদের তৈরি রংবেরঙের খেলনা পাওয়া যায়।

প্লাস্টিক ও স্টিলের তৈজসপত্র এখন অনেক সুলভ। অনেক বেশি টেকসই। অন্যদিকে মাটির পাত্র সামান্য আঘাতেই ভেঙে খান খান হয়ে যায়। তাই মানুষ এখন আর আগের মতো মাটির পাত্র ব্যবহার করে না। কুমোরদের বেচাবিক্রিও আগের মতো হয় না। তাই বাধ্য হয়ে অনেক কুমোর পেশা পরিবর্তন করছেন। দিন দিন ছোট হয়ে আসছে এ দেশের মৃৎশিল্প। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো হারিয়ে যাবে হাজার হাজার বছরের পুরোনো এ শিল্প।

ছবি: পল্লব মোহাইমেন