কী বেশি টেকসই, কাগজ না রুপা?

যে গল্পটা বলতে যাচ্ছি আজ, সেটা ছেলেবেলায় পড়েছিলাম একটা বইয়ে, নামটা ভারি মজার: পৃথিবী কি গোল?

বইটা হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগে। কিন্তু ওই বইয়ের একটা গল্প সেই ছোটবেলা থেকে মাথায় ঘুরছে। একটা প্রশ্ন দিয়েই গল্পটা শুরু করি: কোনটা বেশি টেকসই, রুপার পাত নাকি কাগজ?

উত্তর তো সোজা। রুপা। এটা তো প্রায় অক্ষয় একটা ধাতু। তার সঙ্গে আবার কাগজের তুলনা! কিন্তু একটা অন্তত ঘটনা আছে, যেখানে কাগজ বেশি দিন টিকে গেল রুপোর চেয়ে। সেই গল্পটাই বলি।

২.

ভূমধ্যসাগরের সিসিলি দ্বীপটা ৮৮৭ সালের দিকে উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা আরবেরা ধীরে ধীরে দখলে নিতে থাকে, তার আগে এটা ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যভুক্ত। এর রাজধানী ছিল কনসটানটিনোপল। ১৪৫৩ সালে তুর্কিরা শহরটা দখল নেওয়ার আগ পর্যন্ত বাইজানটাইন ছিল বিশাল একটা সাম্রাজ্য। এখন সে দেশটা তুরস্ক আর কনসটানটিনোপল হলো ইস্তাম্বুল।

ওদিকে রজার প্রথম নামের এক নরম্যান যোদ্ধা আরবদের হটিয়ে সিসিলির দখল নিতে শুরু করেছিলেন ১০৬১ সালে। তাঁর ছেলে রজার দ্বিতীয়কে ১১৩০ সালে পোপ স্বীকৃতি দিলেন সিসিলির নরম্যান প্রথম রাজা হিসেবে।

নরম্যান কারা? সেও বিস্তর ইতিহাস আর ভূগোলের বিষয়। এরা এসেছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল থেকে। এখনকার নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ক—এই দেশগুলো নিয়ে হলো স্ক্যান্ডিনেভিয়া। নরম্যান কথাটার মধ্যে আছে নর্থ আর ম্যান এই দুটো শব্দ। মানে উত্তর থেকে আসা মানুষ। ৭৯০ সাল নাগাদ নরম্যানরা সমুদ্রপথে ইউরোপে নতুন ত্রাস হিসেবে দেখা দেয়। এরা ‘ভাইকিং’ নামে ইতিহাসে খ্যাত। ভাইকিং কথাটার মানে হয়ে পড়ল স্রেফ জলদস্যু বা লুটেরা। এদের আক্রমণে ইউরোপের উপকূলভাগ তখন তছনছ হয়ে পড়ে। একাদশ শতক পর্যন্ত তাদের এই তাণ্ডব অব্যাহতই থাকে। এরপর তারা কিছুটা থিতু হলো, ইউরোপের নানান স্থানে তারা বসতিও করল। আধুনিক ফ্রান্সের নরমান্ডি নামের জায়গাটি এসেছে তাদের নাম থেকে, এখানে তাদের একটা বড় জনপদ গড়ে উঠল। যোদ্ধা হিসেবে নরম্যানদের সুনাম ছিল খুব। নরমান্ডি থেকে উইলিয়াম দ্য কনকরার দখল করলেন ইংল্যান্ড, সেখান থেকেই স্যাকসন রাজবংশকে হটিয়ে শুরু হলো ইংল্যান্ডে নরম্যান রাজত্ব।

৩.

সিসিলির প্রথম নরম্যান রাজা রজার দ্বিতীয় মধ্যযুগের অন্য সামন্ত রাজাদের মতো ধর্মান্ধ গোঁড়া ছিলেন না। রাজত্বের সীমাটাকেও যতদূর সম্ভব বাড়িয়ে নিতে চাইছিলেন তিনি, তাই আগ্রহী ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে। তাঁর দরবারে জ্ঞানীদের ভিড় জমেছিল। আরবেরা মধ্যযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে রাজত্ব করত এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকাজুড়ে। গণিত, রসায়ন, চিকিত্সাবিদ্যা, দর্শন আর ধর্মতত্ত্বে এই সময়টাতে তাঁরা ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁদেরই একজন হলেন আল ইদ্রিসি। তাঁর পুরো নামটা বিশাল: আবু আবদুল্লা মুহাম্মদ আল ইদ্রিসি আল কুরতুবি আল হাসান আল সাবতি। তিনি কিন্তু ছিলেন প্রধানত ভূগোলবিদ ও মানচিত্র প্রস্তুতকারক।

ইদ্রিসির জন্মবৃত্তান্ত জানতে হলে আরও অনেক ইতিহাস-ভূগোলের খপ্পরে পড়তে হবে। তাঁর পূর্বপুরুষ মরক্কোর ইদ্রিসি রাজারা, যাঁরা আবার জন্মসূত্রে জড়িত মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে। তাঁর জন্ম এখনকার সিউটা নামের একটি নগরে, যা বর্তমানে মরক্কোর সীমানায় স্পেনের অধীন একটি স্বশাসিত এলাকা। অল্প বয়সেই আল ইদ্রিসি উত্তর আফ্রিকা, আরব শাসনে থাকা আন্দালুসিয়া, পিরেনিজ, হাঙ্গেরি, আনতালিয়া ভ্রমণ করেছেন, দেখেছেন ফরাসি আটলান্টিক উপকূল। পড়াশোনা করেছেন তখনকার দিনের বিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র কর্ডোভায়। আন্দালুসিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকায় আরও অনেকের মতো তিনিও যোগ দেন রজারের দরবারে।

তো, রাজা রজার তাঁকে এবং নরম্যানদের একটি প্রস্তাব দিলেন। উত্তরের ভূ-প্রকৃতি সবচেয়ে ভালো জানে নরম্যানরা, সেদিক দিয়েই এসেছে তারা। আর ইদ্রিসির জানা দক্ষিণের বিশাল অংশের প্রকৃতি। দুয়ের জ্ঞান মিলে দুনিয়ার একটা নিখুঁত মানচিত্রের একটা বই তৈরি হোক না! আর সেটা যাতে অক্ষয়কীর্তি হয়ে থাকে, সেই মানচিত্রটাকে খোদাই করা হোক ঢালাই করা রুপোর পাতে।

এ কাজে ইদ্রিসির চেয়ে যোগ্য আর কেউ ছিল না। তিনি এটা তৈরি করতে অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীদের সাক্ষাৎকার নিলেন। শুনলেন তাদের অভিজ্ঞতা। রজার নিজেও খাটলেন অনেক, কথা বললেন দরবারে আসা দেশ-বিদেশের পর্যটকদের সঙ্গে। এভাবে ইদ্রিসি তৈরি করলেন তখনকার দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানচিত্র।

এই সেই বিখ্যাত নুজহাত আল মুশতাক ফিখতিরাজ আল আফাক মানচিত্র

কাগজে আঁকা খসড়াটিকে ৪৫০ পাউন্ড ওজন আর ৬ ফুট ব্যাসার্ধের বিশাল একটি রুপার পাতের ওপর খোদাই করা হলো। যার একদিকে ছিল পৃথিবীর মানচিত্র, আরেক দিকে ছিল নক্ষত্রখচিত আকাশপট। মানচিত্রে দেওয়া বর্ণনাটা ছিল আরবি ভাষায়, লাতিনেও অনুবাদ ছিল। অভিজ্ঞ কারিগরেরা খুব সাবধানে ধীরে ধীরে খোদাই করে পুরো কাজটা সম্পাদন করলেন। তত্ত্বাবধান করলেন আল ইদ্রিসি স্বয়ং। এভাবে ১৮ বছরের পরিশ্রমে ১১৫৪ সালে কাজটা শেষ হলো।

পরবর্তী তিন শ বছর ধরে এই মানচিত্রটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে বতুতা, ইবনে খালদুন, আহমেদ মহিউদ্দীন পিরির মতো পুবের পর্যটক, জ্ঞানী ও নৌ অধ্যক্ষ এটা ব্যবহার করেছেন; কলম্বাস আর ভাস্কো-দা-গামাও প্রেরণা পেয়েছেন এই মানচিত্র থেকে। পৃষ্ঠপোষকের নামেই এর জনপ্রিয় লাতিন নাম ট্যাবুলা রোজারিয়ানা। তবে এর আসল নাম ছিল নুজহাত আল মুশতাক ফিখতিরাজ আল আফাক, বাংলায় বলা যেতে পারে: দূর দেশগুলোতে আরামদায়ক ভ্রমণের বিবরণ। ভূগোল আর মানচিত্র বিষয়ে ইদ্রিসি লিখলেন আরও কটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

তারপর? তারপরের কাহিনি খুব সংক্ষিপ্ত। রজার মারা গেলেন ১১৫৪ সালে। নানান হাঙ্গামা আর যুদ্ধবিগ্রহে তাঁর উত্তরাধিকারীরা রুপার মানচিত্রটা খণ্ড খণ্ড করে নানান কাজে ব্যবহার করলেন। লুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর প্রথম নিখুঁত মানচিত্র আঁকা রুপার পাতটি।

তাহলে এত যে বড় বড় পর্যটক আর অভিযাত্রীর প্রেরণার উৎস ছিল সেই মানচিত্র?

আসলে রুপার পাতে খোদাই করার আগে ইদ্রিসি সেটার খসড়া এঁকেছিলেন। সেটা ছিল সাধারণ কাগজেই। সেই খসড়াটাই গেছে টিকে। ইদ্রিসির আর সব বইয়েরও বেশির ভাগ টিকে গেছে। সেগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে এই মানচিত্রটা। আর তাই রুপার পাতটা হারিয়ে গেলেও ওই কাগজে আঁকা মানচিত্রটা দেখেই আমরা জানতে পারি তখনকার মানুষের চোখে কেমন ছিল দুনিয়ার ভূগোল।

তাই বলি, মাঝে মাঝে কিন্তু কাগজও বেশি টেকসই হতে পারে ধাতব পাতের চেয়ে।

তথ্যসূত্র : হিস্টোরি ডটকম