কীভাবে লিখব শর্টফিল্মের স্ক্রিপ্ট

ফিল্ম বানানো কিন্তু এখন অনেক সহজ হয়ে এসেছে। এই যা! সবাই নিশ্চয় এখন হইহই করে ছুটে আসবে! কিসের সহজ, কই সহজ, কীভাবে সহজ ইত্যাদি প্রশ্নের ঝড় তুলবে!

একটা বিষয় একটু খেয়াল করলেই কিন্তু দেখতে পাই যে আমাদের সবার হাতেই তো অন্তত একটা স্মার্টফোন আছে আর তাতে বেশ ভালো মানেরই একটা ক্যামেরা আছে। তার মানে ধরে নেওয়া যায় ক্যামেরা এখন খুব বড় সমস্যা না। অন্যদিকে একটু খোঁজখবর করলে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই কিন্তু অভিনয় করতে চাওয়া মানুষের সংখ্যাও নেহাত যে কম না তা–ও বোঝা যায়। আমার এক বন্ধু বলে, প্রত্যেক মানুষই নাকি জীবনে অন্তত একবার হলেও অভিনয়শিল্পী হতে চায়...তা শেষ পর্যন্ত হতে পারুক আর না-ই পারুক! তো পেশাদার অভিনেতা ছাড়াও হাতের নাগালেই এই উঠতি অভিনয়শিল্পীর অভাব কিন্তু নেই। ক্যামেরা ও অভিনয়শিল্পীর পাট যদি চুকে যায়, তাহলে আর কী ঠেকাচ্ছে আমাদের ফিল্ম বানানো থেকে।

গল্প

অবশ্য শুধু গল্প পেলেই তো হচ্ছে না, সেটাকে কীভাবে দেখানো হবে, অর্থাৎ সেটার স্ক্রিপ্ট কেমন হবে, সেটাও তো বিষয়। তাহলে আসলে আমাদের আটকে দিচ্ছে একটা স্ক্রিপ্ট। তো স্ক্রিপ্টের ভেতরের কারিকুরি আর জারিজুরিটাও দেখে নেওয়া যাক না এই ফাঁকে! কোথা থেকে শুরু করব আমরা আর কোথায় বা গিয়ে থামব...এবার নাহয় তার ওপর একটু (কিশোর) আলো ফেলা যাক!

সব জার্ম জার্ম নয়

শুরুটা কিন্তু একেবারেই একটা প্রথাগত বিষয়—মানে ঠিক করা, কী নিয়ে ফিল্ম বানাব। আইডিয়াটা কী? কিংবা গল্পটা কী? নাকি কোনো একটা বিশেষ চরিত্রকে বলব আমরা? কেউ কেউ এই চিন্তাকে চিন্তার ‌‘জার্ম’ বলে থাকেন। জার্ম—জীবাণু; এখানে গল্পাণু। প্রথম ভাবনা। হয়তোবা ভাবা গেল আমরা এক কৃষকের গল্প বলব। এটা প্রথম চিন্তা...জার্ম...আইডিয়া...গল্পাণু যা–ই বলি না কেন! এবার কিন্তু ভাবতে হবে আমরা এই গল্পটা কেন বলব? অর্থাৎ এই যে একটা চরিত্র ধরে নিচ্ছি আমরা—যে কৃষিকাজ করে, তার এমন কোনো গল্প আছে কি, যেটা আমি বলতে চাই? ভেবে দেখা যাক। না, নেই। আমি অন্ততপক্ষে জানি না। তাহলে কী দেখাব আমরা ফিল্মে? একজন কৃষক প্রতি ভোরে কৃষিকাজ করতে যান মাঠে, তারপর সন্ধ্যায় ফিরে আসেন। পুরো ফিল্মে নিশ্চয়ই আমরা তা দেখাতে চাই না! তাহলে? তাহলে এই কৃষকের একটা গল্প লাগবে। গল্পটা কীভাবে হবে? ভাবতে হবে। এমন কোনো একটা গল্প যেটা আমাদের আলোড়িত করবে। আমাদের সবার প্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, টেলিভিশন সিনেমাটির গল্প যখন তাঁর মাথায়, তখন তিনি ঘুমাতে পারতেন না। গল্পটায় তিনি এতই আবিষ্ট হয়ে থাকতেন যে অন্য কিছু ভাবতেও পারতেন না। আমরাও যখন কোনো ফিল্মের জন্য গল্প ভাবব, তখন যেন এমনই আবিষ্ট থাকতে পারি আমাদের গল্প নিয়ে। এমন কিছু যেন ভেবে উঠি যেন উত্তেজনায় আমরাও ঘুমাতে না পারি। গল্পের খুদে জার্মকে যেন আমরা দারুণ একটা দৈত্য-গল্পে পরিণত করতে পারি।

গল্পের গরু কই ওঠে

প্রবাদে আছে, গল্পের গরু নাকি গাছেও ওঠে। আমি এই প্রবাদের সঙ্গে সব সময় যুক্ত করি যে গল্পের গরু গাছে উঠতে পারে ঠিকই, তবে কীভাবে গাছে উঠল, আমাকে সেটা অবশ্যই বলে দিতে হবে। আর বলতে হবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। বিশ্বাসযোগ্য বিষয়টা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু উপস্থাপনভঙ্গির কারণেই রূপকথার মতো অবিশ্বাস্য গল্প আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। কোনো দিন না দেখেও একচোখা দৈত্যদের আমরা কল্পনা করে আনন্দ পাই; কিংবা সুপারহিরোর উড়ে যাওয়া দেখে আমাদের একবারও মনে হয় না আরে, এমনটা আবার সম্ভব নাকি! সবই কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনের কারসাজি!

মডেল: লাবণী | ছবি: সুমন ইউসুফ

তাই গল্প ভাবার সময় আমাদের সব সময় খেয়াল রাখতে হবে গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কি না। ধরা যাক, যে কৃষকের গল্প আমরা করতে চাচ্ছি, তার ক্ষেত্রে গল্প ফাঁদলাম যে ওই কৃষক এক ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমেরিকা গেলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দেখা করে ফিরে এলেন পরের দিন। এটা কি আমাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে? আমরা নিশ্চয় ভাবছি বাংলাদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ের কৃষক কীভাবে আমেরিকা যেতে পারেন আর কীভাবেই বা হোয়াইট হাউসে যেতে পারেন? গল্পের গরু তার মানে গাছে উঠতে পারে না আসলে...! পারে না ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বিশ্বাসযোগ্যতার মই না দিচ্ছি গাছ আর গরুর ভেতর। এখন একটু ভাবি। গল্পটা যদি এমন হয় সেই কৃষকের ঘুম ভাঙল একটা ফোনে। কম দামি ফোনের স্ক্রিনে এমন অদ্ভুত নম্বর কৃষক কোনো দিন দেখেননি। তিনি ভয়ে ভয়ে ফোন ধরলেন। অপর প্রান্ত থেকে আধভাঙা বাংলায় একজন বললেন, আপনি কি রহিমুদ্দিন বলিতেছেন? কৃষক কোনোমতে বললেন, জি হ্যাঁ। ও প্রান্ত বলল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মিস্টার ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিটি দেশ থেকে একজন কৃষকের সঙ্গে দেখা করিতে চাহিয়াছেন! আপনি মনোনীত হইয়াছেন জনাব রহিমুদ্দিন! আমাদের লোক আপনাকে হোয়াইট হাউসে নিয়া আসিবে! রহিমুদ্দিন চিঁচিঁ করে বললেন, কিন্তু আমারে ক্যান? কণ্ঠটি বলল, আপনার ফোন নম্বরখানা প্রেসিডেন্টের লটারিতে উঠিয়াছে! রহিমুদ্দিন পরের দিনই ঢাউস এক বিমানে চড়ে হোয়াইট হাউস পৌঁছালেন।

এখন কিন্তু মনে হচ্ছে এভাবে এক অজপাড়াগাঁয়ের কৃষকের হোয়াইট হাউসে পৌঁছানো সম্ভব। তাহলে আমরা যখন আমাদের ফিল্মের গল্প ভাবব, তখন তার গরুটিকে যেকোনো জায়গাতেই ওঠাতে পারি, শুধু খেয়াল রাখব বিশ্বাসযোগ্যতার মই আমরা দিতে পেরেছি কি না। এ ছাড়া আমরা তো জানিই, প্রতিটি গল্পেরই আসলে একটা শুরু, একটা মধ্য আর একটা শেষ থাকে। গল্প ভাবার সময় (আমি ভাবতে ভাবতে লিখে ফেলি, না হলে হারিয়ে যায়) এটা যেন মাথায় রাখি...আমাদের গল্পটির যেন একটা দারুণ শুরু থাকে, আর যেন আমরা পরিষ্কার থাকি গল্পের মধ্যে কী হচ্ছে, আর যেন চিন্তা করে বের করি ঠিক কোন জায়গায় আমার গল্পটি শেষ করা উচিত!

গল্পটি লিখে ফেলার পর কিছুদিনের জন্য সেটা লুকিয়ে ফেলাই ভালো। কয়েক সপ্তাহ পর আবার সেটা বের করে নিজে নিজে পড়ে দেখতে হবে ঠিক লাগছে কি না। যদি কোনো কিছু যোগ করতে হয় বা বাদ দিতে হয়, সেগুলো করে অবশ্যই কিন্তু বন্ধুবান্ধবকে পড়ে শোনাতে হবে। তারা হয়তো হাসাহাসি করবে, তাতে কী যায়–আসে? তাদের নিয়ে তো আমরাও কত বিষয়ে কতভাবে হাসাহাসি করি। কিন্তু হাসাহাসির পরেও দেখবে গল্পটা নিয়ে ওরা নানা রকম মন্তব্য করছে। এই মন্তব্যগুলো মন দিয়ে শুনতে হবে। ওরা হয়তো কোনো ঘটনা নিয়ে কিংবা কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করবে...প্রশ্নগুলো জানাও খুব জরুরি। প্রশ্নগুলোর উত্তর গল্পে কিন্তু আমাদের রাখতে হবে। না হলে, ওই যে বললাম বিশ্বাসযোগ্যতা, সেটার ঘাটতি দেখা দেবে গল্পে। বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিত মানুষদের শোনানোর পর, তাদের মতামত নিয়ে আমরা দ্বিতীয়বার গল্পটার ওপর কাজ করতে পারি। এর সঙ্গে আরেকটা কাজও করতে পারি—আর তা হলো, গল্পটার একটা ‘এক লাইন’ তৈরি করা। ফিল্মের গল্পের জন্য এটা খুব কাজে দেয়। কেউ কেউ তো এমনও বলেন, যে গল্প এক লাইনে ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে না, সেই গল্পটা কোনোভাবেই ইন্টারেস্টিং হতে পারে না!

আমাদের এই গল্পের এক লাইন কী হতে পারে—কৃষক রহিমুদ্দিন হোয়াইট হাউসে ধান চাষ করে পেলেন বিশ্বসেরা কৃষকের পুরস্কার! এই এক লাইনটা কিন্তু আমার কাছে মোটামুটি ইন্টারেস্টিং লাগছে। মনে হচ্ছে কীভাবে এটা হলো, সেটা জানা দরকার! মানে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। গল্পে আসলে আমরা আগ্রহই তৈরি করতে চাই।

গল্প থেকে দৃশ্য

আমার এক বন্ধু ছিলেন, তিনি স্ক্রিপ্ট লিখতেন। দেখতাম রাত জেগে জেগে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তিনি তাকিয়ে থাকতেন, মাঝে মাঝে নানান উদ্ভট অঙ্গভঙ্গি করতেন। সকালে যখন তিনি ঘুমিয়ে থাকতেন, আমি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখতাম তাঁর গল্পটা স্ক্রিপ্টে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। দৃশ্য-১, দৃশ্য-২—এভাবে একের পর এক দৃশ্য সাজানো। আমার কাছে মনে হতো কী কঠিন কাজ রে বাবা! গল্পকে আবার দৃশ্যে ভাঙি কী করে? আমরা যখন আমাদের কৃষকের গল্পটার স্ক্রিপ্ট লিখতে যাব, তখনো তো এমন বিপদে পড়তে পারি। কীভাবে লিখব স্ক্রিপ্ট?

প্রথমে কাঠামো নিয়ে একটু বলে নিই। দৃশ্যের নম্বর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই দৃশ্যে শিরোনামে যে দৃশ্যটা রাত না দিনের, দৃশ্যটার লোকেশন কী, কে কে থাকছে চরিত্র, এগুলো তো উল্লেখ করবই, সঙ্গে কিন্তু এ–ও ধারণা থাকতে হবে দৃশ্যটার ব্যাপ্তি আসলে কত। সেটা ১০ সেকেন্ড যেমন হতে পারে, তেমনি কিন্তু ১০ মিনিটেরও হয়ে যেতে পারে। লিখে কিংবা মনে মনে ব্যাপ্তির এই ধারণা তৈরি করার অভ্যাসটা যদি আমরা রপ্ত করতে পারি, তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের স্ক্রিপ্টের সময়জ্ঞান তৈরি হবে। তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদের স্ক্রিপ্টের ব্যাপ্তি সম্পর্কে পরিষ্কার থাকতে পারব। কারণ ব্যাপ্তি জানা থাকলে বাজেট সম্পর্কেও একটা ধারণা তৈরি করে নেওয়া সম্ভব হয় খুব দ্রুত। এরপর একটি দৃশ্য থেকে আরেকটি দৃশ্যে যাওয়ার জন্য কী ব্যবহার করব, সেটা ‘কাট’ নাকি ‘ডিজল্‌ভ’, নাকি ‘ফেড ইন ফেড আউট’ ইত্যাদি যদি স্ক্রিপ্টে উল্লেখ রাখা যায় তাহলে ভালো। এসব কাঠামোগত বিষয় শিখতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিছু ভালো স্ক্রিপ্ট দেখলে বা কিছু টিউটোরিয়াল দেখলেই এসব বিষয়ে জানা যায়। মুশকিলটা হয় কাঠামোর ভেতরের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে। আর সত্যি বলতে কী, একটা দৃশ্যের ভেতরে কী ঘটবে, তা লেখা আসলে কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। তবে কয়েকটা ব্যাপারে আমরা খেয়াল রাখতে পারি। প্রথমত, প্রতিটি ভালো গল্পের যেমন শুরু–মধ্য–শেষ থাকে। তেমনি প্রতিটি ভালো দৃশ্যেরও শুরু-মধ্য-শেষ থাকে। আর এই শুরু-মধ্য-শেষটা আমরা এগিয়ে নিয়ে যাই বর্ণনার মাধ্যমে। দৃশ্য লেখার সময় যেন খেয়াল রাখি আমরা চোখ বন্ধ করে যা দেখতে পাই দৃশ্যে তার সবই বর্ণনা করতে পারছি কি না...লিখতে পারছি কি না। বর্ণনা লেখার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরই কোনো পছন্দের সিনেমার কোনো একটি দৃশ্য দেখতে দেখতে দৃশ্যটি লিখে ফেলা—আর সেটা বারবার লেখা। এটি আমার ক্ষেত্রে খুব কাজে দিয়েছে। আমি সম্পূর্ণ টাইটানিক সিনেমার দৃশ্য দেখে দেখে লিখতাম। লিখতাম রোজ আর জ্যাক কীভাবে গিয়ে দাঁড়াল জাহাজের মাথায়, কীভাবে তারা থুতু ছুড়ে দিল সমুদ্রে, কীভাবে দুই হাত তুলল। এভাবে লিখতে গেলে বোঝা যায় কতটা ডিটেইলে স্ক্রিপ্টের দৃশ্য লেখা যায়। আর কত দিকে খেয়াল রাখতে হয় দৃশ্য লেখার সময়। আরেকটা বিষয়, দৃশ্য লেখার সময় খেয়াল রাখতে হবে দৃশ্যটি আমাদের গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়...যদি দৃশ্য সেটা না করতে পারে, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি দৃশ্যটি ভালো হয়নি। এবার থেকে আমরা যখন কোনো ফিল্ম দেখব, তখন কিন্তু খেয়াল রাখতে পারি দৃশ্যটি আসলে কীভাবে শুরু হলো, তারপর এগিয়ে গেল আর কীভাবেই বা নতুন আরেকটা দৃশ্যের চাহিদা তৈরি করে শেষ হলো।

সংলাপ

বর্ণনা আর সংলাপ মিলিয়েই দৃশ্য। বর্ণনা নিয়ে ওপরে একটু কথা হলেও সংলাপ নিয়ে তো কোনো কথাই হলো না। অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর লেখায় বলছেন, পথের পাঁচালীর স্ক্রিপ্টে তিনি সংলাপ দিতে সংশয়ে ছিলেন। তাঁর বারবার মনে হচ্ছিল সংলাপ এলেই দৃশ্যের মাধুর্য লুণ্ঠিত হবে। 

এ কথা সত্যি, সংলাপ কখনো কখনো দৃশ্যকে নষ্ট করে দিতে পারে বা সংলাপ কখনো কখনো দৃশ্যকে দুর্বল করে ফেলতে পারে। তাহলে কি আমরা সংলাপহীন ফিল্ম লিখব? তা তো আর সম্ভব না! যে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীতে সংলাপ লিখতে কুণ্ঠাবোধ করছেন, সেই সত্যজিৎই কিন্তু হীরক রাজার দেশে নির্মাণ করেছেন সংলাপনির্ভর। আর সংলাপের যে শক্তি, তাকেও তো আমরা এড়াতে পারি না। হীরক রাজার দেশের কত সংলাপ এখনো আমাদের মুখে মুখে ফেরে—যায় যদি যাক প্রাণ/ হীরকের রাজা ভগবান! কিংবা বেশি খেলে বাড়ে মেদ/ অনাহারে নাহি খেদ! এই সংলাপগুলো তো এখনো সমানভাবে আমাদের সময়ে প্রযোজ্য! হুমায়ূন আহমেদের নাটকের কোনো দৃশ্য যদি আমরা ভুলেও যাই কিন্তু তার চরিত্রের সংলাপগুলো কি এখনো ভুলতে পেরেছি? তা কোথাও েকউ নেই নাটকের মাইরের মধ্যে ভিটামিন আছে যেমন, তেমনি বহুব্রীহি নাটকের টিয়াপাখির বলা—তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!

সংলাপ দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। আর এটি শক্তিশালী বলেই ব্যবহারের সময় লক্ষ রাখতে হয় আলাদাভাবে। সংলাপ ব্যবহারে যে বিষয়টি একেবারে প্রাথমিক তা হলো, সংলাপ যেন কখনোই চরিত্রবিরোধী না হয়। অর্থাৎ আমাদের গল্পের যে কৃষক তাঁর সংলাপ যেন একজন কৃষকের মতোই হয়। কৃষক যদি কোনো রূপকও ব্যবহার করেন তাঁর কথায়, তবে তা যেন তাঁরই জীবনঘনিষ্ঠ হয়। এ ছাড়া সংলাপে যেন পুনরাবৃত্তি না থাকে; অর্থাৎ একই কথা কোনো একটি চরিত্র বা অনেকগুলো চরিত্র যেন বারবার বলতে না থাকে। তাহলে সেটা খুব বাজে শোনায়, আর স্ক্রিপ্টকে দুর্বল করে দেয়। অন্যদিকে সংলাপ যেন সব বলেও না দেয়, সব যেন প্রকাশ করে না ফেলে। সংলাপে সব প্রকাশিত হয়ে পড়লে দর্শকের কাছে সেটি আগ্রহ হারায় এবং স্ক্রিপ্টটি আর কৌতূহল তৈরি করে না। অন্যদিকে দুটি চরিত্রের সংলাপ যদি পরপর একই ধাঁচের হতে থাকে, তাহলেও সেটি অনেক বেশি বোরিং হয়ে ওঠে। ধরে নেওয়া যাক, প্রথমজন বলল, চা খাবে? দ্বিতীয়জন বলল, হুঁ খাব। ১ম: চিনি দেব? ২য়: দাও। ১ম: ২ চামচ দেব? ২য়: হ্যাঁ দাও...এখন এভাবে সারা দিন কথা চলতে পারে। কিন্তু সেটি না আমাদের শুনতে ভালো লাগছে, না দর্শকের ভালো লাগবে!

শুরুতেই শুরু

সব মিলিয়ে বলা যায় একটা স্ক্রিপ্ট লেখা মানে ভাবনার প্রথম থেকে দৃশ্যের বর্ণনা ও সংলাপের মাধ্যমে একটা গল্প বলা। আর গল্পটা এমনভাবে বলতে হবে যেন তা দর্শককে আটকে রাখে, ভাবতে শেখায় কিংবা নতুন কিছু বুঝতে সাহায্য করে। শুধু শর্টফিল্ম না, যেকোনো স্ক্রিপ্ট লিখতেই আমাদের আসলে এই ধাপগুলো পার হতে হয়। কিন্তু যদি আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি আর ভাবি কী কঠিন কাজ...তাহলে আমরা কোনো দিনই লিখতে পারব না। নিজের ফিল্মটা তৈরিও করতে পারব না। ভুল হোক, ঠিক হোক আমরা একটা ছোট স্ক্রিপ্ট লেখার কাজে আজই হাত দিতে পারি। যদি সেটা খুব একটা ভালো না–ও হয়, তবু মাথার একটা আইডিয়াকে গল্পে রূপান্তর করে বর্ণনা আর সংলাপ দিয়ে সেটাকে স্ক্রিপ্টে বদলে ফেলার যে আনন্দ তার কোনো তুলনা হয় না। আর হ্যাঁ, স্ক্রিপ্টটা তৈরির পর গল্পের মতোই কিন্তু সবাইকে পড়ে শোনাতে হবে। সবার মতামত নিয়ে আরেকবার ভাবতে হবে স্ক্রিপ্টটা নিয়ে। দরকার হলে ঠিক করে নিতে হবে। আর যদি প্রথমবারেই আমরা একটা ভালো স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলতে পারি, তাহলে তো আর কথাই নেই...একটা শর্টফিল্ম তৈরির জন্য তাহলে আমরা অনেক বড় একটা কাজ আসলে করে ফেলেছি। এবার দিন–তারিখ ঠিক করে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি শুটিংয়ে!