কোকিল-সমাচার

করুন পাপিয়া

কাক কালো বর্ণের পাখি এবং কা...কা...সুরে ডাকে! ডাকটা সুমধুর নয় বলে কাক মানুষের কাছে কিছুটা অপছন্দের। কিন্তু বসন্ত এলেই যে কোকিল ‘কুউও...কুউও’ সুরে সুমধুর কণ্ঠে অবিরাম ডাকে সে-ও কিন্তু কালো। তবে তার কদর অনেক বেশি। কাকের ডাককে অমঙ্গল মনে করেন অনেকে, কিন্তু কোকিলের ডাকে শিল্প খুঁজে পান কবি-সাহিত্যিকেরা। বনে যেমন পলাশ, শিমুল ফুল ফুটে বসন্তের আগমনী বার্তা দেয় আমাদের চোখে। আর কোকিল ডেকে বার্তা দেয় আমাদের কান ও হূদয়ে। বসন্ত আর কোকিল তাই সমার্থক।

আলাস্কা, সাইবেরিয়াসহ বরফে আচ্ছাদিত এলাকা বাদে কোকিলের বসবাস পৃথিবীজুড়েই। কোকিল মূলত কুকুলিডি (Cuculidae) পরিবারের বৃক্ষবাসী পাখি। এই পরিবারে ১৩৬ প্রজাতি আবিষ্কার হয়েছে সারা পৃথিবীতে। পক্ষীবিজ্ঞানীদের মতে, এক প্রজাতির কোকিল পৃথিবী থেকে সম্ভবত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোকিল কীটপতঙ্গ, ক্যাটারপিলার ও রসাল ফল (বট, ডুমুর, পাকুড় ইত্যাদি) খায়। বাংলাদেশে কোকিল পরিবারে ১৮ প্রজাতির পাখি আছে, যার মধ্যে ৯ প্রজাতি পরিযায়ী কোকিল। বাকিরা আবাসিক কোকিল।

কাকের বাসায় ডিম পাড়তে এসেছে মেয়ে এশীয় কোকিল

কোকিল পরিবারে যেসব পাখি বাংলাদেশে দেখা যায়, তার মধ্যে কেবল এশীয় কোকিল, পাতি চোখগ্যালো, বউকথাকও পাপিয়া, করুন পাপিয়া এবং এশীয় কোকিলের ডাক গ্রামবাংলা ও শহরে শোনা যায়। ঢাকা শহরে বসন্তে যে কোকিল প্রজাতির ডাক শুনি আমরা, সেটি হলো এশীয় কোকিল। ছেলে পাখি দেখতে চকচকে কালো এবং কালো রঙের মধ্যে নীল ও সবুজের আমেজ থাকে। মেয়ে পাখির রং বাদামির ওপর সাদা ও পীতাভচিতি। এই কোকিলের প্রজনন সময় বসন্তের প্রারম্ভেই শুরু হয়।

এ সময় পুরুষ কোকিল গলায় সুর বাঁধে সঙ্গিনীকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে গিয়ে ডেকে চলে ‘কুউ... কুউ...সুরে। মেয়ে কোকিল কখনোই উচ্চ স্বরে ডাকে না। সাধারণত প্রজনন মৌসুম ছাড়া কোকিল ডাকে না। থাকেও একাকী।

কাকের বাসার গাছে পাহারায় ছেলে এশীয় কোকিল

কোকিল কিন্তু বাসা বানাতে জানে না। ডিম পাড়ে অন্য পাখির বাসায়। কথাটা ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি অথবা বড়দের কাছ থেকে শুনেছি আমরা। তবে সব কোকিল যে বাসা তৈরি করে না, সেটি ঠিক নয়। পৃথিবীর প্রায় ৫৩ প্রজাতির কোকিল নিজে বাসা তৈরি করে না। ইংরেজিতে এদের বলা হয় Brood Parasitism। অর্থাৎ প্রজননের সময় এরা অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। ছানাদের খাওয়া ও লালনপালনও হয় অন্য পাখিদের মাধ্যমে।

কোকিলের কিছু বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল জানা আছে। তাদের ডিমের সঙ্গে রং মিলবে এমন পাখির বাসাতেই ডিম পাড়ে কোকিল। যাতে অন্য পাখি ভাবে এটা তারই ডিম। কোকিল অন্য পাখির বাসায় সাধারণত একটি ডিম পাড়ে। সে বাসায় যদি তিনটি ডিম থাকে তাহলে একটি ডিম সে বাসা থেকে ফেলে দেয়, কিংবা খেয়ে ফেলে। পোষক পাখি তখন তার ডিম গুনে দেখে যে তিনটি ডিমই আছে। কী বুদ্ধি, ভেবে দেখেছ? আমাদের দেশের কোকিলরা সাধারণত কাক, শালিক, ফুটকি, ছাতারে, ফিঙের বাসায় ডিম পাড়ে।

ছেলে এশীয় কোকিলছানাকে খাবার খাওয়াচ্ছে ভাতশালিক

অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ার জন্য একেক ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে কোকিল। এ জন্য তারা পোষক পাখির প্রতিরোধের দিকগুলোর দুর্বলতা রপ্ত করে নেয়। মেয়ে কোকিল একটু নিশ্চুপ ও ঠান্ডা প্রকৃতির হয়। ডিম পাড়ার সময় হলেই সতর্ক থাকে সে। পোষক পাখি কোনো কারণে বাসা ছেড়ে খাবার খেতে গেলে দ্রুত চুপি চুপি গিয়ে ডিম পেড়ে আসে মেয়ে কোকিল। আবার কখনো পুরুষ কোকিল প্রথমে পোষক পাখিকে বিরক্ত করতে থাকে। তখন মা পাখি বাসা ছেড়ে তাকে তাড়াতে যায়। আর সেই ফাঁকে মেয়ে কোকিল ডিম পেড়ে পগারপার হয়। কোকিল ডিম পাড়তে সময় নেয় খুব কম।

পাখিদের মধ্যে কোকিলের ডিম যেকোনো পাখির ডিমের চেয়ে আগে ফোটে। ছানাও বাড়ে দ্রুত। তাই কোকিলের ছানা একটু বড় হলেই বাসা থেকে ফেলে দেয় বা পা দিয়ে ভেঙে ফেলে পোষক পাখির ডিম। পোষক পাখির ডিম থেকে ছানা ফুটলেও সে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের কোকিল ছানার সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠে না। কোকিলের ছানা তাকে বাসা থেকে ফেলে দেয়।

বউকথাকও পাপিয়া

কোকিল সাধারণত ছোট পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। তাই কোকিলের ছানা কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো বাসার জায়গা দখলে নেয়। কোকিল ছানারা খাবার পাওয়ার জন্য বেশ ডাকাডাকি করে এবং পোষক মা ও বাবা পাখিকে দিনভর খাবার খাওয়াতে বাধ্য করে। অন্য পাখি যখন বুঝতে পারে এটি তার ছানা নয়, তত দিনে নিজের খাদ্য নিজে চিনে ফেলে কোকিল-ছানা।

পাতি চোখগ্যালো পাপিয়া

তবে পৃথিবীতে তিন প্রজাতির কোকিল আছে, যেগুলো সমন্বয় করে বাসা বানায়, ডিমে তা দেয়, ডিম ফোটায় এবং ছানাদের লালনপালন করে। এ ক্ষেত্রে এক জোড়ার সঙ্গে আরও ৪টি মেয়ে কোকিল একই বাসায় ডিম পেড়ে তাতে তা দেয়। ছানা ফুটিয়ে লালনপালন করে। কিন্তু কোকিল কেন বাসা বানায় না তা তাদের ফসিল, ডিএনএ গবেষণা করেও জানা যায়নি। তবে এটা বলা যায়, বাসা বানানো, ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালনপালন করার ব্যাপারটির জ্ঞান তাদের কোনো কোনো পূর্বপুরুষদের ছিল না অথবা তারা এ কাজটিকে ঝামেলা মনে করে এড়িয়ে গেছে অন্য পাখিদের ওপর চাপিয়ে।