ক্ষিপ্ত হাতির কবলে

মার্কিন আলোকচিত্রী পিটার বিয়ার্ডের জীবন ছিল সাফল্য ও সুখে ভরা। তাঁর তোলা ছবি পৃথিবীর সেরা ফ্যাশন পত্রিকাগুলোর পাতা আলোকিত করত। তবে ফ্যাশন জগতের চেয়ে পিটার বেশি ভালোবাসতেন অরণ্য ও বন্য প্রাণী, বিশেষ করে হাতি। তাঁর একটি বই, দ্য এন্ড অব দ্য গেম—এ তিনি কেনিয়ার এক অভয়ারণ্যে হাতিদের খাদ্যাভাবের করুণ চিত্র তুলে ধরে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তাই ১৯৯৬ সালে যখন এক বন্ধু তাঁকে কেনিয়া-তানজানিয়া সীমান্তে সাফারি বন ভ্রমণে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল, ৫৯ বছর বয়সী পিটার সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। তিনি ঠিক করলেন, এই যাত্রায় আরও হাতির ছবি তুলবেন।

একদিন তাঁরা অরণ্যের গভীরে পিকনিক করতে গেলেন। দলে ছিলেন সাতজন। গাড়ি থেকে নেমে পিটার ও তাঁর বন্ধু ক্যালভিন কোটার প্রায় ১৫০ গজ দূরে চরতে থাকা গোটা-পনেরো হাতির একটি যূথের দিকে গুটি গুটি এগিয়ে গেলেন। দলের নেত্রী, এক বিশাল মাদি হাতি, তাঁদের দিকে তেড়ে আসার ভঙ্গি করল। কিন্তু হাতিরা আগন্তুকদের সাবধান করতে এ রকম করেই থাকে। তাই পিটার আর তাঁর সঙ্গী বিশেষ বিচলিত হলেন না। তাঁরা প্রায় ৫০ ফুট পিছিয়ে গেলেন, যাতে তাঁদের আর হাতিদের মধ্যে যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্ব থাকে।

নেত্রী হাতি তাঁদের কিছুদূর ধাওয়া করে আবার দলে ফিরে গেল। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। কিন্তু হঠাৎ মাদি হাতিটা ঘুরে দাঁড়াল এবং আবার তাঁদের দিকে তেড়ে এল। পিটার ও ক্যালভিন দৌড়াতে লাগলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় তাঁরা পেছন ফিরে তাকালেন—হাতিটা তখনো তাঁদের পেছনে পেছনে ছুটে আসছে।

আশপাশে কোনো সুবিধাজনক আশ্রয়স্থল দেখতে না পেয়ে পিটার একটি তিন ফুট উঁচু উইয়ের ঢিবির দিকে ছুটে গেলেন এবং ঢিবিটির পেছনে ঘাপটি মেরে বসে পড়লেন। হাতিটা দৌড়াতে দৌড়াতে ঢিবিটার পাশ কাটিয়ে চলে এল। উপায়ান্তর না দেখে পিটার হাতির সামনের বাঁ পা-টা দুহাতে আঁকড়ে ধরলেন। হাতিটা বার কয়েক চক্কর দিয়ে তাঁকে ঝটকে ফেলে দিতে চেষ্টা করল। অসফল হয়ে সে একসময় পিটারকে ঢিবিটার গায়ে ঠেসে ধরল। তার ধারালো দাঁত পিটারের বাঁ ঊরুকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ঢুকে গেল। তারপর হাতিটা তার প্রকাণ্ড ভারী মাথা দিয়ে পিটারের শরীরে ঢুঁ মারতে লাগল।

হাতি নিয়ে বিয়ার্ডের বইয়ের প্রচ্ছদ

ঢুঁয়ের পর ঢুঁ। একবার, দুবার, তিনবার, চারবার...। সেই আক্রমণ চলতেই থাকল। পিটার অনুভব করলেন, কড় কড় শব্দে তাঁর পাঁজরের হাড় একটার পর একটা ভেঙে যাচ্ছে। অথচ তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে আছেন। একসময় তাঁর কোমরের হাড় মট করে ভেঙে গেল। ‘মনে হচ্ছিল যেন একটা মালগাড়ি কিংবা একটি লিফট আমার গায়ের ওপরে এসে পড়েছে,’ পিটার পরে বলেন। উঃ, সে কী দুঃসহ চাপ, তা বলে বোঝানো যায় না।’

তারপর হঠাৎ তাঁর দুই চোখের দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে গেল।

ততক্ষণে যূথের বাকি হাতিগুলো এদিকে এসে পড়েছে। পিটার মাটিতে একদলা মাংসের মতো পড়ে রইলেন। মাদি হাতিটা তাঁকে পা দিয়ে কয়েকবার টিপল। পিটার অনুভব করলেন, তাঁর শরীরের আরও কয়েকটি হাড় ভেঙে গেল। আশপাশের অন্য হাতিদের চলাফেরার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পিটার মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। অন্য হাতিগুলোও যদি তাঁর শরীর মাড়িয়ে যায়, তবে তাঁর আর কিছুমাত্র বাকি থাকবে না। কিন্তু কোনো কারণে হাতিরা তা করল না। তারা আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল।

হাতির যূথ চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরে একটি গাড়ি এসে তাঁর কাছে দাঁড়াল। ক্যালভিন দৌড়ে এসে চিৎকার করে তাঁকে বলল, ‘শিগগির তোমার প্যান্টটা খোলো।’ পিটার ভাবলেন ক্যালভিন তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। কারণ, তিনি দাঁতের এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়াটা টের পাননি, টের পেয়েছিলেন শুধু পিষ্ট হওয়ার নিদারুণ চাপ। প্যান্ট খুলবেন? তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, ‘এত লোকের সামনে? আমি তা পারব না।’ তখন বেলা ভরদুপুর, কিন্তু তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর চোখের সামনে নিরেট অন্ধকার। এই অবস্থায় প্রায় পাঁচ মিনিট কাটার পর আস্তে আস্তে তাঁর ডান চোখের দৃষ্টি ফিরে এল। তারপর বাঁ চোখের। দৃষ্টিশক্তি ফিরতেই তিনি তাঁর ঊরুর বিরাট ক্ষতটি দেখতে পেলেন। দেখেই তিনি আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন। ভাগ্য ভালো, হাতির দাঁত তাঁর পায়ের শিরা ছিন্ন করে দেয়নি।

পিটারকে ধরে ধরে গাড়িতে নিয়ে তোলা হলো। তারপর তিন ঘণ্টা ধরে এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে ফিরতি যাত্রা—সে এক অসম্ভব কষ্টকর অভিজ্ঞতা। প্রায় ২০ মাইল পথ যাওয়ার পর তাঁরা কিকোরক নামের একটি ছোট্ট এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন। এয়ারপোর্টে কর্মরত এক রেডিও অপারেটর সৌভাগ্যবশত রাজধানী নাইরোবি শহরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলেন। একটি বিমান অ্যাম্বুলেন্স কিছুক্ষণ পরে সেখানে উড়ে এল। অসহ্য ব্যথার জন্য পিটারকে মরফিনের ইনজেকশন দেওয়া হলো।

নাইরোবিতে পৌঁছে পিটারকে সোজা হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। তাঁর শরীরে এত বেশি রক্তক্ষয় হয়েছিল যে প্রথমেই তাঁকে আট-দশ ব্যাগ রক্ত দিতে হলো। পরীক্ষায় ধরা পড়ল, পিটারের শরীরের আটখানা হাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। এক সার্জন তাঁর শরীরে অনেকগুলো ইস্পাতের পিন ঢোকালেন ভাঙা হাড়গুলো ধরে রাখার জন্য। তারপর তাঁর শরীর এক লোহার বর্ম দিয়ে ঢেকে দিলেন, যাতে তিনি নড়াচড়া করতে না পারেন। সেই অবস্থাতেই তাঁকে বিমানে করে প্রথমে লন্ডন ও পরে নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে নিউইয়র্কের সেন্ট ভিনসেন্টস হাসপাতালে তাঁর ওপরে আরেক দফা অপারেশন হলো। নয় ঘণ্টা ধরে চলল সেই অপারেশন। তাঁর শরীর থেকে লোহার খাঁচাটি খুলে ভাঙা হাড়গুলোতে স্ক্রু দিয়ে টাইটেনিয়াম ধাতুর পাত লাগিয়ে দেওয়া হলো। কয়েক সপ্তাহ লাগাতার ফিজিক্যাল থেরাপির পর ২০ অক্টোবরে তিনি অবশেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন।

আফ্রিকায় পিটার বিয়ার্ড

এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও পিটার নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করেন। হাতিটা যে তাঁর আরও বেশি ক্ষতি করেনি, তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। তাঁর মতে, হাতিরা অনেকটা মানুষের মতো। তারা বুদ্ধিমান এবং তারা সহজে কিছু ভোলে না। পিটারের ধারণা, যে হাতিটা তাঁর ওপরে আক্রমণ করেছিল, সে নিশ্চয়ই কোনো সময়ে কোনো মানুষের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছিল। সেই ঘটনার আক্রোশ তোলে সে পিটারের ওপর।

পিটার বলেন, এখন বনজঙ্গলে গেলে তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি সাবধানে চলাফেরা করেন। মানুষ বন্য প্রাণীর ওপরে এত রকম অত্যাচার করে যে কখন কোন প্রাণী খেপে গিয়ে তার বদলা নেবে, তা কে বলতে পারে?