গল্পকথার শব্দগুলো

এবারের অভিধানের গল্প একটি বাগ্‌ধারা রা ও চারটি শব্দ নিয়ে। বাগ্‌ধারাটি ইংরেজি। শব্দগুলোও ইংরেজি। এগুলোর কোনোটায় রয়েছে গল্প, কোনোটায় ইতিহাস ও কিংবদন্তি, কোনোটায় আবার অন্য কিছু। গল্পকথাগুলো অবশ্য বাগ্‌ধারা ও শব্দগুলোর আপন ভাষার। এসব গল্পকথা না জানলেও চলে। তবে জানলে ক্ষতি নেই, বরং তাতে খানিক আনন্দ পাওয়া যাবে।

কুম্ভীরাশ্রু

কুম্ভীরাশ্রু বাংলা ভাষার একটি বহুল ব্যবহৃত বাগ্‌ধারা। তবে তা নিজস্ব নয়। ইংরেজি থেকে পাওয়া। ইংরেজি crocodile tears বাংলায় হয়েছে কুম্ভীরাশ্রু। বাগ্‌ধারা সাধারণভাবে একাধিক শব্দ নিয়ে গঠিত হলেও কখনো কখনো তা সমাসবদ্ধ হয়ে একটি শব্দেও পরিণত হতে পারে। কুম্ভীরাশ্রুর বেলাতে সেটাই হয়েছে।

লোক-দেখানো কান্না অথবা কারও প্রতি কপট সমবেদনা জানানোর ব্যাপারটি কুম্ভীরাশ্রু বাগ্‌ধারা দিয়ে চমৎকারভাবে বোঝানো হয়। বাগ্‌ধারাটি বাংলা সংবাদপত্রের অনবদ্য অবদান।

কুম্ভীরাশ্রু কথাটা বেশ ভারী। ওজন কমালে, অর্থাৎ সহজ বাংলায় বললে এর অর্থ দাঁড়ায় কুমিরের চোখের জল। বাংলা ভাষায় কুমিরের চোখের জলের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু কুম্ভীরাশ্রুর রয়েছে। কুম্ভীরাশ্রুর বদলে কুমিরের চোখের জল বললে তার মধ্যে কোনো বিশেষ অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কুম্ভীরাশ্রুতে পাওয়া যায়।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

কুমিরের চোখ থেকে আদৌ কখনো জল ঝরে কি না, তা জানাটা প্রাণিবিজ্ঞানের বিষয়, ভাষার বিষয় নয়। তবে কুম্ভীরাশ্রুর মধ্যে একটি গল্প রয়েছে এবং সেই গল্পে কুমিরের চোখ থেকে জল ঝরে। গল্পটা বেশ প্রাচীন। গল্পটার উৎপত্তি কোথায়, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে, এটি প্রাচীন ইউরোপের গল্প এবং তা প্রাচীন মিসরের লোককথা থেকে পাওয়া।

গল্পে বলা হয়েছে, কুমির নাকি খিদে পেলে কান্নার মতো শব্দ করতে থাকে। সে শব্দ শুনে কেউ যদি কুমিরের অবস্থা দেখতে পানিতে নামে। অমনি কুমির তার পা কামড়ে ধরে।

শিকার ঠিকমতো বাগে আসার পর কুমির তাকে গিলতে শুরু করে। পুরো দেহ গিলে ফেলার পর শিকারের মাথার কাছে এসে কুমির কান্না জুড়ে দেয়।

কুম্ভীরাশ্রু কথাটির রহস্য এখানেই। কুমিরের এ কান্না তার শিকারের ভয়ার্ত ও যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে নয়, তার কান্না শিকারের মাথায় কোনো মাংস নেই বলে। কুমিরের মুখের মধ্যে শিকারের মাথা এবং চোখে জল—এই ব্যাপারটাই কুম্ভীরাশ্রু।

ম্যানেজার

বাংলাদেশের বহু প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার পদটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ম্যানেজারেই শেষ নয়। ম্যানেজারের ওপরে আছেন ডেপুটি জেনারেল ইত্যাদি শব্দধারী ম্যানেজারগণ। তবে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা এঁদের সংক্ষেপে ডিজিএম, জিএম বলে অভিহিত করে থাকেন।

ম্যানেজার ইংরেজি শব্দ। এর যে বাংলা প্রতিশব্দ নেই, তা নয়। ম্যানেজারের বাংলা হলো ব্যবস্থাপক। একেবারে ওপরের পদ মহাব্যবস্থাপক। তবে এগুলো শুধু কাগজে-কলমে। বাঙালির মুখের কথায় আর ব্যবস্থাপক-মহাব্যবস্থাপক আসে না, ম্যানেজার, জিএমই আসে।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

ইংরেজি ভাষা তার ম্যানেজার শব্দটি পেয়েছে ল্যাটিন maneggiare শব্দটি একটু এদিক-ওদিক করে নিয়ে। এটা ইংরেজি ভাষার স্বভাব। শব্দের চেহারা বদলালেও ইংরেজিতে শব্দটির ল্যাটিন অর্থই বজায় থাকে। অনেক পরে, ফরাসি প্রভাবে ইংরেজিতে শব্দটার মূল অর্থের বদল ঘটে। ম্যানেজার শব্দের অর্থ দাঁড়ায় বিষয়াদির নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি। আরও পরে, ইংরেজি ভাষা বিশেষ্য পদ ম্যানেজার থেকে ক্রিয়াপদের সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায় ম্যানেজার শব্দের আগমন ইংরেজ আমলেই।

ল্যাটিন maneggiare এবং ল্যাটিন থেকে ইংরেজি হওয়া ম্যানেজার শব্দের মূল অর্থ হলো অশ্ব প্রশিক্ষক, অর্থাৎ ঘোড়াকে বিভিন্ন কসরত শেখানোর প্রশিক্ষক।

কলেজ

ল্যাটিন Collega থেকে ইংরেজি কলেজ শব্দের উৎপত্তি। একই অফিসে যাঁরা চাকরি করেন কিংবা একই কলেজে যাঁরা শিক্ষকতা করেন, তাঁরা পরস্পরের পরিচয় দেন কলিগ বা সহকর্মী বলে। কলিগ শব্দটাও Collega থেকে আসা।

ল্যাটিন Collega শব্দের অর্থ যাঁরা একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। শব্দটা ইংরেজিতে ঢোকে ১৫ শতকের দিকে, ল্যাটিন অর্থ নিয়েই। তবে চেহারা পাল্টে তা হয়ে যায় College। কিছুকাল পর ইংরেজিতে কলেজ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় যাঁরা একই ধরনের ব্যবসা করেন, এমন বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

উনিশ শতকে এসে শব্দটার অর্থ আবার বদলায়। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম দেয় কলেজ। এখন অবধি কলেজ শব্দটা ওই অর্থই বহন করছে।

সেই উনিশ শতকে ইংরেজ শাসনামলে ভারতে কলেজের আগমন। বাংলায় শব্দটা প্রথমে ছিল কালেজ, পরে কলেজ। কলেজের বাংলা প্রতিশব্দ মহাবিদ্যালয়। তাই বলে কলেজ শব্দটা এখনো ব্রাত্য হয়নি, বরং কলেজ শব্দটাই বেশি চালু।

বিস্কুট

প্রাচীন ফরাসি শব্দ biscut ১৪ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজিতে biscuit হয়ে প্রবেশ করে। শব্দ ও বস্তুটা বাংলাদেশে আসে ১৪ শতকে। অনেক বাঙালি ইংরেজি কায়দায় এই শব্দটাকে বলেন বিস্কিট। তবে অধিকাংশ বাঙালির মুখে শব্দটা বিস্কুট। বিস্কুট এখন আর ইংরেজি শব্দ নয়, বাংলা।

উচ্চারণ যা-ই হোক, বিস্কিট আর বিস্কুটের স্বাদ একই রকম। বিস্কুট মুখরোচক খাদ্যবস্তু। ময়দায় তৈরি। তবে বিস্কুট শব্দের অর্থ কী, তা বুঝিয়ে বলা বেশ মুশকিল। অভিধানে বলা হয়েছে, বিস্কুট হলো ক্ষুদ্রাকার শুষ্ক রুটি। কিন্তু রুটি আর বিস্কুট কি এক হলো? বিস্কুট শব্দটার অর্থ বোঝার জন্য তা দেখে ও চেখে নেওয়া হলো সবচেয়ে ভালো উপায়।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

মূল ফরাসি ও পরে ইংরেজি ভাষায় আসা বিস্কিট বা বিস্কুট শব্দের মূল যে অর্থ, তা হলো দুবার সেঁকা ছোট রুটি। প্রথমবার সেঁকার পর দ্বিতীয়বার সেঁকা হতো রুটিটা শুকনো ও মচমচে করার জন্য।

বিস্কুট প্রথমে তৈরি হতো সেকালের পাল তোলা জাহাজের জাহাজিদের জন্য। তখন তো রেফ্রিজারেটর ছিল না। তাই জাহাজে রুটির পরিবর্তে বিস্কুট নেওয়া হতো অনেক দিন ধরে যেন খাওয়া যায় সে জন্য। বলা বাহুল্য, এ কাজটা আমরা এখনো করি। তাওয়ায় সেঁকা রুটি এক বেলা, পাঁউরুটি দু-চার দিন। কিন্তু বিস্কুট খাওয়া হয় কয়েক দিন ধরে।

একাডেমি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামের একাডেমি রয়েছে। একাডেমি হলো দর্শন, সাহিত্য, শিল্প বিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চা উন্নয়ন কেন্দ্র। বাংলাদেশেও বিভিন্ন বিষয়ের একাডেমি বিদ্যমান। একাডেমি শব্দটা বাংলা নয়, ইংরেজিও নয়—তবে ইংরেজি থেকেই পাওয়া। একাডেমি আন্তর্জাতিক একটি শব্দ।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এথেন্সের এক জলপাইবাগানের পাশে দর্শনচর্চার জন্য তাঁর বিখ্যাত স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্কুলের নামকরণ করা হয়েছিল এথেন্সের কিংবদন্তির বিখ্যাত বীর আকাডেমসের স্মৃতিস্তম্ভের নামানুসারে। এটি অবস্থিত ছিল ওই জলপাইবাগানে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল বিখ্যাত হয় Akademeia বা Akademia নামে। এই শব্দটা থেকেই ইংরেজি Academy শব্দের জন্ম। ইংরেজি এই শব্দটাই বাংলাদেশে হয়েছে একাডেমি। যেমন: বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমি ইত্যাদি। শব্দটা ভারতে হিন্দিতে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় হয়েছে অকাদেমি, আকাদেমি।

বলে রাখা ভাল, প্লেটোর মৃত্যুর পর তাঁর স্কুলের কাছেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল।