গানে গানে স্বাধীনতা

মানবজীবনে বড় ভাই-বোনের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও মাঝে মাঝে তারা বড় বিরক্ত করে। কোনো কাজ না থাকলেই তাদের মনে হয়, ছোট ভাই-বোনকে জ্ঞান দেওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। ধরো পড়া শেষ করে বারান্দায় একটু হাওয়া খেতে এসেছ। তোমাকে দেখেই বড় ভাই গম্ভীর ভঙ্গিতে লেকচার শুরু করল, ‘কিরে, খুব তো হাওয়া খাচ্ছিস, লেখাপড়া তো করতে দেখি না। কেমিস্ট্রির কী অবস্থা? তোর বয়সে কেমিস্ট্রি ফিজিকস সব আমার হাতের মুঠোয় থাকত...।’ এত জ্ঞান সব সময় ভালো লাগে না। তবে সব সময় ভালো লাগার মতো একটা জিনিসই বোধ হয় আছে পৃথিবীতে। তা হলো গান। সকাল বিকেল সন্ধ্যা রাত যেকোনো সময় গান শুনতে ইচ্ছে করে। কত যে গান আছে পৃথিবীতে!

বাবা-মা কিংবা স্কুলশিক্ষক প্রায়ই রুটিন করে লেখাপড়া করার কথা বলেন। রুটিন তো সবাই করে, কিন্তু সেটা কজন মানে সে হিসাব বোধহয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের কাছেও নেই।

কিন্তু গান তো আর রুটিন করে শোনা হয় না। হঠাৎ হঠাৎ কোনো একটা সুর মাথার ভেতরে থাকা মিউজিক প্লেয়ারে বেজে ওঠে। বসে বসে অঙ্ক করছি, এমন সময় গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি ‘বোকা বাক্সের কোপ পড়েছে, হারিয়ে গেছে গানের খাতা...’ কেন বেজে ওঠে তা বলা কঠিন। কিন্তু সে সময় গান না শুনলে ভালোই লাগে না।

নিউইয়র্কে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর সেই বিখ্যাত পোস্টার

আবার কখনো কখনো পরিস্থিতির সঙ্গে দারুণভাবে মিলে যায় গান। আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হলে মনের অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে উঠি, ‘বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙে, হাঁটছি আমি মেঠোপথে...’ তখনই যদি গানটা শুনে ফেলা যায়, তাহলে মনটাই ভালো হয়ে যায়। বাবা-মা লেখাপড়া নিয়ে বকা দিলেও তখন খুব একটা খারাপ লাগে না। একইভাবে স্বাধীনতার মাসে যদি স্বাধীনতার গান শুনি, মন ভালো না হয়ে উপায় আছে?

গান যে মন ভালো করে তা বহু গবেষণায় প্রমাণিত। শুধু মন ভালো করে তা নয়, মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, প্রতিবাদী হতে শেখায়, শেখায় ভালোবাসতে। মানুষ গান শুনে কতটা অনুপ্রাণিত হয় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানগুলোই সাধারণ মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছিল। জয় বাংলা বাংলার জয়, তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে কিংবা রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই গানগুলো শুনলে এখনো যেন রক্ত টগবগ করে ওঠে আমাদের। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে এ গানগুলোই সেই সংগ্রামী দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। কয়েক বছর ধরেই ৭ মার্চে জয় বাংলা কনসার্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে এ প্রজন্মের জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান কিংবা দেশের গানের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা সুরে সুরে কি কেউ বলেনি? বলেছে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ক্রিপটিক ফেইট একটা আস্ত গানই গেয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে স্মরণ করে। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামের এই গানটা শুনলে সে সময়ের পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারবে।

ক্রিপটিক ফেইট সব সময়ই চেষ্টা করে গানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম নিয়ে তাঁদের অ্যালবাম নয় মাস অনলাইনে মুক্তি পেয়েছে ২০১৫ সালে। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর বাঙালির জেগে ওঠা থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জন পর্যন্ত পুরো মুক্তিযুদ্ধের চিত্র গানে গানে তুলে ধরেছে এই হেভি মেটাল ব্যান্ডটি।

একাত্তরে যশোর রোডে শরণার্থীদের ঢল দেখে মার্কিন কবি অ্যালান গিন্সবার্গ লেখেন সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতাটি

মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের কথা আমাদের সবারই জানা। সেই কথাগুলোই গানে তুলে ধরেছে অবসকিউর। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদকে নিয়ে করা তাদের ‘আজাদ’ গানটি শুনলে টর্চার সেলের ভয়াবহতার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। ইউটিউবে গানটি শুনে অনেকেরই চোখে পানি এসেছে।

টর্চার সেল নিয়ে গান করেছে এ প্রজন্মের ব্যান্ড দৃকও। প্রথম অ্যালবাম দৃক-এ ‘টর্চার সেল’ নামের গানটিও নির্যাতনের ভয়াবহতা আর সৈনিকের দৃঢ়তার চিত্র উপস্থাপন করে। একই অ্যালবামে ‘একুশবিহীন’ আর ‘তারুণ্যের মিছিল’ গানগুলো দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারে মানুষকে।

পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে অসংখ্য মানুষ শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার করুণ গল্পটা কিছুটা হলেও অনুভব করা যায় মৌসুমী ভৌমিকের ‘যশোর রোড’ গানটি শুনলে। মার্কিন কবি অ্যালান গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার ওপর ভিত্তি করে গানটি গেয়েছেন মৌসুমী ভৌমিক।

যশোর রোড গানটির গায়িকা মৌসুমি ভৌমিক

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়ার পেছনে যাদের হাত, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়েও গান আছে। ‘রাজাকারের তালিকা চাই’ গানটি গেয়েছে নব্বই দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড নোভা।

আজম খানের বাংলাদেশ গানটি এখনও জনপ্রিয়

বাংলাদেশকে নিয়ে গানের কথা উঠলেই চলে আসে আজম খানের নাম। তাঁর ‘বাংলাদেশ’ গানটি এখনো সব বয়সী শ্রোতার কাছে দারুণ জনপ্রিয়। এ ছাড়া আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, শিরোনামহীন এবং মাকসুদ ও ঢাকাসহ অনেক ব্যান্ডই ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে গান করেছে। বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করছিল, তখন বিশ্বজনমত গঠন এবং শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রেখেছিল গান। রবিশংকর এবং বিটলসখ্যাত জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে আয়োজন করা হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। রবিশংকর এবং জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও এই কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, পণ্ডিত আলি আকবর খানের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গান গেয়েছিলেন। ‘দ্য সং অব বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচার এবং লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি।

বিখ্যাত এই শিল্পীরা গান গেয়ে বিশ্বকে জানান, বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা।

গানগুলো শুনে দেখো, আশা করি ভালো লাগবে।