ঘুরছে তারা আপন পথে

ধরো, তুমি পুরান ঢাকায় গেলে হাজির বিরিয়ানি খেতে। বেগমবাজার গিয়ে দেখলে কোলাহলে পূর্ণ রাস্তায় বোঝার কোনো উপায় নেই, কোনদিকে যেতে হবে। কী করবে? স্মার্টফোন বের করে জিপিএস চালু করবে। এরপর ম্যাপে খুঁজে নেবে নান্না মিয়ার বিরিয়ানির দোকান। ম্যাপ তোমাকে জিপিএস দিয়ে বের করে দেবে এই মুহূর্তে তুমি কোথায় আছো, তোমাকে কোনদিকে যেতে হবে। তোমার একদম নির্দিষ্ট অবস্থান কীভাবে বের করল যন্ত্রটা? উপগ্রহ। বিশ-ত্রিশ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে অনেক অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ। সেগুলোর বেশির ভাগেরই কাজ আমাদের তথ্যকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে সাহায্য করা।

তুমি যখন তোমার মেক্সিকোতে থাকা বন্ধুকে ই-মেইল করো, সেটা গোল পৃথিবীর অন্য পাশে যায় কেমন করে, ভেবে দেখেছ? আমরা তথ্য পাঠাই তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ হিসেবে। মাটি ফুঁড়ে পৃথিবীর অন্য পাশে নিশ্চয়ই তরঙ্গ যেতে পারে না। আলো একরকম তরঙ্গ। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, আলো সোজা পথে চলে। তাই তরঙ্গও চলে সোজা পথে। কেমন করে তাহলে এই তরঙ্গ বেঁকে পৃথিবীর অন্য পাশে যাবে? এই সমস্যার প্রথম সমাধান নিয়ে আসে কৃত্রিম উপগ্রহ। আমরা যখন কোনো তথ্য পৃথিবীর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাই, তখন সেটি প্রথমে আমাদের অ্যানটেনা থেকে যায় আকাশে ঘুরতে থাকা উপগ্রহে। আর সেখান থেকে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। যখন তথ্য ভূপৃষ্ঠের অ্যানটেনা থেকে আকাশে যায়, সেটাকে বলে আপলিংক। আর যখন সেই তথ্য উপগ্রহ গ্রহণ করে সেটাকে অ্যামপ্লিফাই (শক্তিশালী) করে পৃথিবীতে গন্তব্যে পাঠিয়ে দেয়, সেটাকে বলে ডাউনলিংক। আমাদের মোবাইল কিন্তু উপগ্রহে সরাসরি তথ্য পাঠায় না। এই তথ্য প্রথমে যায় নিকটস্থ মোবাইল টাওয়ারে। সেখান থেকে চলে যায় উপগ্রহে। টিভিতে যে সিগন্যাল আসে, সেটিও প্রথমে ধরা পড়ে ডিশের দোকানের অ্যানটেনায়। এরপর চলে যায় তারের মাধ্যমে সবার বাসায়।

উপগ্রহ ছাড়াও কি আমরা যোগাযোগ করি? হ্যাঁ। গ্রামে দেখেছ, বিটিভির অ্যানটেনা থাকে চালের ওপর। বিটিভি ট্রান্সমিট করা হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে সরাসরি। তাই এটি পাওয়া যায় না পৃথিবীর অন্য জায়গাগুলোতে। আর উপগ্রহ চ্যানেলগুলো প্রথমে তথ্য পাঠায় উপগ্রহে। সেখান থেকে ট্রান্সমিট করা হয় পুরো পৃথিবীতে। তাই দূরদেশ থেকে এইচবিও ট্রান্সমিট করা হলেও সেটি উপগ্রহ থেকে রিলে করার কারণে তোমার এলাকার ডিশ অ্যানটেনায়ও ধরা যায়।

এখন কথা হলো, এই যে আকাশে এত শত উপগ্রহ উড়ছে, কীভাবে সেগুলো ভেসে থাকছে? এগুলো কি জ্বালানি খরচ করে বছরের পর বছর প্লেনের মতো করে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে? একদম না! এই উপগ্রহগুলো শূন্যে ভেসে থেকে পৃথিবীকে চক্কর দিতে কোনো জ্বালানিই খরচ করে না। এগুলো প্রতিটিই একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায়, একটা নির্দিষ্ট বেগে ঘুরছে একদম কোনো রকম জ্বালানি ছাড়াই। কীভাবে? এর পেছনে আছে খুব ইন্টারেস্টিং, কিন্তু সরল ফিজিকস।

মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা তো সবাই শুনেছ। গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এতেও জ্বালানি লাগে না এই মহাকর্ষ বলের কারণে। গ্রহগুলো যেমন ঘোরে, তেমনই কিন্তু ঘোরে উপগ্রহগুলোও। আর আর্টিফিশিয়াল উপগ্রহ, যেটা শুধু উপগ্রহ বা কৃত্রিম উপগ্রহ নামে পরিচিত, সেটিও ঘুরতে থাকে একই মেকানিজমে। চিন্তা করে দেখো, কী অদ্ভুত কাণ্ড। মাধ্যাকর্ষণ বলের কাজ তো আকর্ষণ করা। অথচ সে উপগ্রহকে টেনে মাটিতে না নামিয়ে ঘোরাচ্ছে আকাশে। কীভাবে?

নিউটনের একটা মজার থট এক্সপেরিমেন্ট আছে। ধরা যাক তুমি একটি বিশেষ ধরনের কামান দিয়ে গুলি করছ। এটি কামানের গোলাকে অনেক বেশি দূরে নিতে পারে। প্রথমে ধরো এক কিলোমিটার দূরে ফেললে। এরপর শক্তি বাড়িয়ে আর জোরে মারলে, যেন এক শ কিলোমিটার যায়। পৃথিবী কিন্তু গোল। এক শ কিলোমিটারের মধ্যে ভূপৃষ্ঠ অনেকটা বেঁকে যাবে। তবে গোলার গতিপথ? সেটাও অবশ্যই বেঁকে যাবে। এবার বিশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে যাওয়ার মতো শক্তি দিলে। ধরে নাও তুমি এক্সপেরিমেন্টটা করছ এক কিলোমিটার উঁচু পাহাড়ের ওপরে বসে। তাহলে তোমার গোলাটি কিন্তু ভূপৃষ্ঠের এক কিলোমিটার উঁচু দিয়ে চলতে চলতে পৃথিবী অর্ধেকটা ঘুরে অন্য পাশে গিয়ে পড়বে। এখন শক্তি আরও অনেক বাড়িয়ে দিলে? এটা পুরো পৃথিবীকে চক্কর দিয়ে পেছন থেকে এসে তোমাকেই আঘাত করবে নিশ্চয়ই! আর তুমি যদি কামানটা নিয়ে ওই জায়গা থেকে সরে যাও তবে? গোলাটা আবার সামনে চলে যাবে। তারপর? আবার ঘুরে আসবে একই পথে। এভাবে ঘুরতেই থাকবে! এটাই কৃত্রিম উপগ্রহের মূলনীতি।

কৃত্রিম উপগ্রহগুলো রকেটের মাধ্যমে একটা উচ্চতায় উঠিয়ে এমন একটা বেগে ছুড়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই থট এক্সপেরিমেন্টের মতো ঘুরতে থাকে। তবে ঘুরতে জ্বালানি খরচ হয় না, সেটা সত্যি। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের বায়ুর কারণে উপগ্রহগুলো একটু বাধাগ্রস্ত হয়। এতে এটি ক্রমে একটু নিচে নেমে আসে। তখন এর মধ্যে থাকা ছোট ইঞ্জিনের সাহায্যে এটি আবার ফিরে যায় এর প্রয়োজনীয়, নির্দিষ্ট উচ্চতায়।

তুমি যদি একটা রশির মাথায় একটা ভারী কিছুর টুকরা বেঁধে নিয়ে মাথার চারপাশে ঘোরাতে থাকো, তাহলে কী দেখতে পাও? টুকরাটা তোমার হাতকে ঘিরে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে চক্কর দিচ্ছে। এটাকে হাত দুলিয়ে দুলিয়ে ঘোরার শক্তিটা দেওয়া হচ্ছে। আর এটা ছুটে যেতে পারছে না, কারণ রশি দিয়ে একে টেনে রাখা হয়েছে। হঠাৎ ছেড়ে দিলে কী হবে? বৃত্তাকার যে পথে ঘুরছিল, তার স্পর্শক বরাবর সোজা ছিটকে পড়বে। কৃত্রিম উপগ্রহকেও রশির মতো টেনে রাখে পৃথিবীর সঙ্গে এর মহাকর্ষ বল, আর ঘুরতে থাকতে বাধ্য করে এর উড্ডয়নকালের গতিজড়তা। মহাকর্ষের কারণে তৈরি কেন্দ্রমুখী বল, আর উড্ডয়নের কেন্দ্রবিমুখী বল পরস্পর সমান হওয়ায় এটা সব সময় একটা নির্দিষ্ট দূরত্বেই থাকে। বলা যায়, সব সময় বৃত্তাকার পথে পৃথিবীর চারপাশে যেন অনবরত পতন হচ্ছে এর। পতনের পথ বৃত্তাকার হওয়ায় সেটা কখনো ফিরে আসছে না ভূপৃষ্ঠে।

তথ্য যোগাযোগের একটা রিলে স্টেশন থাকবে আকাশে, এই পরিকল্পনা প্রথম কে করেছিল জানো? সর্বকালের অন্যতম সেরা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখক আর্থার সি ক্লার্ক। তিনি কিন্তু এটি কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে বলেননি। একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লিখেছিলেন ১৯৪৫ সালে। হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন ৩৬ হাজার কিলোমিটার ওপরে এমন উপগ্রহ রাখা সম্ভব, যেটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরবে, আর তথ্যের রিলে স্টেশন হিসেবে কাজ করবে। বেশির ভাগ উপগ্রহই ওই উচ্চতায় এখন আছে।

ওই উচ্চতাকে বলে হাই-আর্থ অরবিট (এইচইও), জিওস্টেশনারি অরবিটও বলা হয় অনেক সময়। কারণ, উচ্চতাটা ঠিক করা হয়েছে মজার একটি হিসাব করে। প্রতিটি উপগ্রহ কত বেগে ঘুরলে ঠিক ঠিক পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকবে তা ঠিক হয় এর উচ্চতা দিয়ে। যত উঁচুতে উপগ্রহ থাকবে, এর বেগ তত কম থাকবে। জিওস্টেশনারি অরবিটে থাকলে বেগ এমন হয় যেন এটা পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরতে সময় নেবে ঠিক ঠিক একদিন। পৃথিবী একবার নিজ অক্ষে ঘুরতেও সময় নেয় একদিন। তাই এটিকে দেখলে মনে হবে পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট জায়গার ওপর থেমে আছে! এবং এ রকম কয়েকটি জায়গার ওপর থেমে থাকা উপগ্রহ দিয়েই চালিয়ে নেওয়া যায় পৃথিবীর সব জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ।

মাঝারি উচ্চতায় (প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার) থাকে জিপিএসের উপগ্রহসহ অনেক উপগ্রহ। এগুলো ঘুরতে সময় নেয় ১২ ঘণ্টা। এগুলোর বেগও মাঝামাঝি। এগুলোকে বলে মিডিয়াম-আর্থ অরবিটস (এমইও)। আর নিম্ন উচ্চতার উপগ্রহগুলো ঘোরে প্রচণ্ড দ্রুত। এগুলোকে বলে লো-আর্থ অরবিট (এলইও)। নানান বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজে লাগে এসব উপগ্রহ। এর কোনো কোনোটি পুরো পৃথিবীকে দেড় ঘণ্টায়ও ঘুরে আসতে পারে। এই উপগ্রহগুলোর আকারও হতে পারে খুব ছোট। কখনো একটা কোকের ক্যানের সাইজ।

একটা উপগ্রহের দ্রুতি কিন্তু নির্ভর করে শুধু এর উচ্চতার ওপর। এটি কত বড়, তার ওপর মোটেই নয়। তাই একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় যতগুলো উপগ্রহ আছে, তারা কখনো সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না। একই উচ্চতার সবগুলো উপগ্রহ একই দ্রুতিতে পৃথিবীর চারপাশে ছুটছে। সোজা হিসাব, তোমার পেছনে তোমার বন্ধু যদি ঠিক তোমার বেগে তাড়া করে, সে কি কখনো তোমাকে ধরতে পারবে?

উপগ্রহের ধারণা আর্থার সি ক্লার্ক দেন ১৯৪৫-এ। প্রথম উপগ্রহ রকেটে চড়িয়ে উেক্ষপণ করা হয় এর ঠিক এক যুগ পরে, ১৯৫৭ সালে। আর যোগাযোগের জন্য প্রথম ব্যবহূত উপগ্রহ টেলস্টার, যেটির উেক্ষপণ হয় ১৯৬২ সালের ১০ জুলাই। এই পাঁচ-ছয় দশকে পৃথিবীর অর্থনীতি, শিক্ষা, বিনোদন সবকিছুই নীরবভাবে পুরোপুরি নির্ভর হয়ে পড়েছে উপগ্রহের ওপর। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে যদি উপগ্রহগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আকাশে ছুটে বেড়ানো রিলে স্টেশনগুলো আমাদের আবহাওয়ার খবর দিচ্ছে, পৃথিবীর ছবি তুলে দিচ্ছে, যোগাযোগে সাহায্য করছে, আরও কত-কী!

শেষে একটা মজার তথ্য। তুমি কিন্তু রাতের আকাশে খালি চোখে উপগ্রহ দেখতে পারো। গ্রামে যখন অনেক তারা দেখা যায়, তখন মাঝে মাঝে দেখবে, তারার মতো ছোট্ট একটা আলো আস্তে আস্তে এক পাশ থেকে আরেক পাশে যাচ্ছে। এর চলন দেখেই বুঝে নিতে হবে এটি তারা নয়, উপগ্রহ!