চাঁদে ছয় অভিযান

মাঝেমধ্যেই একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চাঁদে কি সত্যিই গিয়েছিলেন আর্মস্ট্রংরা? যতবার গুজব ওঠে, ততবার ভাইরাল হয় গুজবগুলো। এসব হুজুগবাজের পক্ষে দাঁড়ানোর লোকেরও অভাব হয় না। অভিযোগগুলো শুধু প্রথম চন্দ্র বিজয়ের ক্ষেত্রেই ওঠে, অন্যগুলোয় নয়। কারণটা পরিষ্কার, এসব লোকের বেশির ভাগই জানে না যে চাঁদে মানুষ একবার যায়নি, গেছে ছয়-ছয়বার! ছয় অভিযানে ১২ জন নভোচারী চাঁদের মাটিতে পা রাখেন। দেখে নেওয়া যাক চাঁদে ছয়টি অভিযানের ছবি।

অ্যাপোলো-১১

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই ইগল নামের খেয়াতরিটি নামে চাঁদের বুকে। ইগল অ্যাপোলো-১১-এর একটি লুনার মডিউল। ইগল থেকে চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখেন কমান্ডার নিল আর্মস্ট্রং। ধুলো আর পাথরের উপগ্রহে অঙ্কিত হয় মানুষের পদচিহ্ন। এরপরই চাঁদে পা রাখেন বাজ অলড্রিন। অ্যাপোলো-১১তে অংশ নেন তিনজন মহাকাশচারী। তৃতীয়জন মাইকেল কলিন্স চাঁদের বুকে নামেননি। কারণ, মূল মহাকাশযান অ্যাপোলো-১১-এর নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁরই হাতে। সেটিতে বসেই তিনি পুরোটা সময় প্রদক্ষিণ করেন চাঁদের কক্ষপথ। এই অভিযানে চাঁদের বুকে প্রায় ২১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট অবস্থান করেন নভোচারীরা। চাঁদের পৃষ্ঠে ছবি তোলা, বালু ও পাথরের নমুনা সংগ্রহ এবং চাঁদের মাটি ও পরিবেশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় এই অভিযানে। ২৪ জুলাই অ্যাপোলো-১১ ফিরে আসে পৃথিবীতে। মহাকাশযানটি অবতরণ করে প্রশান্ত মহাসাগরে।

অ্যাপোলো-১২

১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর চাঁদে দ্বিতীয় অভিযানটি চালায় অ্যাপোলো-১২। চাঁদের মাটিতে পা রাখেন কমান্ডার চার্লস কনরাড ও পাইলট অ্যালান বিন। কক্ষপথে মূল মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণ করছিলেন রিচার্ড গর্ডন। এই অভিযানের আগে চাঁদে পাঠানো হয় সারভেয়ার-৩ নামের মানুষবিহীন মহাকাশযান। সেটি চাঁদের যে অংশে অবতরণ করে, সেখানেই অবতরণ করেন অ্যাপোলো-১২-এর অভিযাত্রীরা। এই অভিযানে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ ও ছবি তোলা হয়। এ ছাড়া সারভেয়ার-৩ মহাকাশযানের বেশ কিছু অংশ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন অভিযাত্রীরা। তাঁরা মোট ৩১ ঘণ্টা ৩১ মিনিট চাঁদে অবস্থান করেন। পৃথিবীতে ফিরে আমেরিকার সামোয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রে অবতরণ করে মহাকাশযানটি।

অ্যাপোলো-১৪

চাঁদে মানুষের তৃতীয় অভিযানটি ছিল অ্যাপোলো-১৪-এর। লুনার মডিউলে করে কমান্ডার অ্যালান শেফার্ড ও পাইলট এডগার মিশেল চাঁদের মাটিতে পা রাখেন ১৯৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। গতানুগতিক নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি মজার কিছু পরীক্ষাও চালানো হয় এই অভিযানে। কমান্ডার অ্যালান শেফার্ড গলফ খেলেন চাঁদের মাটিতে। ৩৩ ঘণ্টা ৩১ মিনিট চাঁদের পৃষ্ঠে কাটিয়ে কন্ট্রোল রুমে ফিরে আসেন এই দুই নভোচারী। চাঁদের কক্ষপথে মূল মহাকাশযানে কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে ছিলেন পাইলট স্টুয়ার্ট রোসা। ৯ ফেব্রুয়ারি প্রশান্ত মহাসাগরে সামোয়া উপকূলে অবতরণের মাধ্যমে এই অভিযান শেষ হয়।

অ্যাপোলো-১৫

অ্যাপোলো-১৫ ছিল মানুষের চতুর্থ সফল চন্দ্রাভিযান। ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই চাঁদের মাটিতে পা রাখেন কমান্ডার ডেভিড স্কট ও পাইলট জেমস আরভিন। মূল মহাকাশযান থেকে ছোট্ট একটি খেয়াতরিতে (লুনার মডিউল) চড়ে চাঁদে নামেন তাঁরা। চাঁদের কক্ষপথে মূল মহাকাশযানে বসে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করছিলেন আলফ্রেড ওয়ার্ডেন। মহাকাশযানের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতে। এই অভিযানে প্রথম লুনার রোভার ব্যবহার করা হয়। এটা আসলে চাঁদের বুকে চলতে সক্ষম একধরনের রোবোটিক গাড়ি। চাঁদের বুক থেকে মাটি ও পাথর কিংবা ছোটখাটো খননকাজে সক্ষম ছিল এই লুনার রোভার। প্রায় ৬৬ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট চাঁদে কাটিয়ে মূল মহাকাশযানে ফিরে আসেন নভোচারীরা। হনলুলু থেকে ৩০০ মাইল উত্তরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবতরণ করে মহাকাশযানটি।

অ্যাপোলো-১৬

১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল পঞ্চমবার চাঁদে পা পড়ে মানুষের। অন্য চার অভিযানের মতো এই অভিযানে তিন নভোচারী অংশ নেন। মূল মহাকাশযানে কন্ট্রোল রুমে বসে চাঁদের কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেন থমাস ম্যাটিংলিকে। লুনার মডিউলে চড়ে চাঁদে অবতরণ করেন কমান্ডার জন ইয়াং ও পাইলট চার্লস ডিউক। এবারও মহাকাশচারীদের সঙ্গে ছিল একটি লুনার রোভার। সেই লুনার রোভারে বসে চাঁদের মাটিতে প্রায় ২৭ কিলোমিটার ভ্রমণ করেন দুই নভোচারী। তাঁদের অভিযানের ব্যাপ্তি ছিল ৭১ ঘণ্টা ২১ মিনিট। চাঁদের অজানা একটা অংশে অভিযান চালান অ্যাপোলো-১৬-এর নভোচারীরা। ২৪ এপ্রিল তাঁরা চাঁদ থেকে রওনা দেন। ২৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিসমাস দ্বীপপুঞ্জের ২০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরে তাঁরা অবতরণ করেন।

অ্যাপোলো-১৭

চাঁদে মানুষের ষষ্ঠ ও সর্বশেষ অভিযানটির নাম ছিল অ্যাপোলো-১৭। ১৯৭২ সালের ১১ ডিসেম্বর চাঁদের বুকে পা রাখেন কমান্ডার ইউজিন সার্নান ও পাইলট হ্যারিসন। কক্ষপথে মূল মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন রোনাল্ড ইভানস। ইতিহাসের মানুষের সর্বশেষ এই অভিযানই ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। দুই নভোচারী ৭৫ ঘণ্টার বেশি চাঁদের বুকে কাটান। নভোচারীরা চন্দ্রপৃষ্ঠের নতুন নতুন ছবি তোলেন, সংগ্রহ করেন চাঁদের মাটি ও পাথর। এ ছাড়া কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা তো ছিলই। এই অভিযানেও একটা লুনার রোভার ছিল নভোচারীদের সঙ্গে। তাতে চড়ে চাঁদের বুকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন দুই নভোচারী। ১৪ ডিসেম্বর লুনার দুই নভোচারীকে নিয়ে চাঁদের বুক থেকে উড়াল দেয়, যুক্ত হয় মূল মহাকাশযানের সঙ্গে। ১৯ ডিসেম্বর কমান্ড মডিউলসহ মহাকাশযানটি ফিরে আসে। প্রশান্ত মহাসাগরের সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের কাছে তাঁরা অবতরণ করেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা