রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান শোনেনি এমন মানুষ বোধ হয় খুব একটা পাওয়া যাবে না। আবার আমরা প্রায়ই বলি, ‘আমি ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি।’ আজ কিন্তু কোনো বিদেশিনীকে নয় বরং ‘চিনি’কে চেনানোর জন্যই এ লেখা। এখনই ঠোঁট উল্টে, ‘ও মা! চিনিকে আবার কী চিনব? বাজারে গিয়ে এক প্যাকেট চিনি চাইলেই তো ধবধবে সাদা, দানাদার চিনি পাওয়া যায়’—এই ভেবে বসে থেকো না যেন। চিনির মিষ্টতার খবর সবার জানা। কিন্তু এ চিনি কীভাবে তৈরি করা হয়, কেনই বা এটা এত মজাদার এমন অনেক মজার তথ্য নিয়ে আজ হাজির হয়েছি। মিষ্টি খাবার তৈরির পাশাপাশি খাবারের স্বাদ, ঘ্রাণ বৃদ্ধি করার জন্যও ব্যবহৃত হয় চিনি। চিনির ব্যবহার খাবারে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং খাবারটি দেখতেও লোভনীয়।
এই চিনি আসলে কী জিনিস? খাবার চিনি হিসেবে যে জিনিসটিকে আমরা সবাই চিনি তার রাসায়নিক নাম হলো সুক্রোজ, এটি একধরনের শর্করাজাতীয় খাবার। যে মুহূর্তে সুক্রোজ আমাদের জিবকে স্পর্শ করে, স্বাদ গ্রহণকারী বিভিন্ন নার্ভ ঠিক তখনই মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠায় এবং ডোপামিন নামের একধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। এই ডোপামিন অনেকটা পুরস্কার পাওয়ার মতো অনুভূতি আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করে, সহজভাবে বললে এটি আমাদের আনন্দানুভূতি সৃষ্টি করে এবং পুনরায় ওই খাবার গ্রহণ করার ব্যাপারে আমরা আকৃষ্ট হই। মস্তিষ্কে যখন এসব খেলা চলছে, পাকস্থলী কিন্তু তখন বসে নেই। সুক্রোজ সহজে পানিতে দ্রবীভূত হতে পারে এবং পাকস্থলীর পাচক রসের সঙ্গে মিশে গিয়ে এটা আরও কম ঘনত্বের এক দ্রবণে পরিণত হয়। পাকস্থলী থেকে ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই সুক্রোজ ভেঙে গিয়ে সমপরিমাণ গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজে পরিণত হয় অর্থাৎ এক অণু সুক্রোজ ভেঙে তৈরি হয় এক অণু গ্লুকোজ ও এক অণু ফ্রুক্টোজ। এই গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ আমাদের দেহে শক্তি সরবরাহের কাজ করে। আমাদের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার প্রায় শতকরা ১৩ ভাগই কিন্তু চিনি থেকে পূরণ করা সম্ভব।
এত যে উপকারী এই চিনি, এটি কিন্তু একসময় বেশ দুর্লভ ছিল। এতটাই দুর্লভ যে একে বলা হতো ‘সাদা সোনা’। যে সময়ের কথা বলছি তা কিন্তু যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় হাজার তিনেক বছর আগের। প্রথম নিউ গিনি অথবা ভারতীয় উপমহাদেশে চিনি প্রস্তুত শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তখনকার সময় প্রস্তুতকৃত চিনি আর এখনকার চিনির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, চিনি প্রস্তুতির পদ্ধতিই যে অনেকখানি বদলে গেছে। এখন বলো তো, চিনি বানানো হয় কী দিয়ে? হুম ঠিক ধরেছ, আখের রস থেকেই বানিয়ে ফেলা হয় এই চিনি। কিন্তু আখের রস যেটা কিনা তরল এক জিনিস, সেখান থেকে এমন শুষ্ক দানাদার বস্তু তৈরি হয় কীভাবে? সে গল্পই এবার শুরু করা যাক।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে কোন চিনি তাহলে বেশি ভালো? সাদা না বাদামি? এর উত্তর হচ্ছে দুই চিনিই প্রায় একই রকম গুণসম্পন্ন।
আখ দেখতে অনেকটা বাঁশের মতো এবং লম্বায় প্রায় ২০ ফুটের মতো হতে পারে। অর্থাৎ তোমার উচ্চতা যদি হয় ৫ ফুট, তবে তোমার মতো চারজনকে একের মাথায় অন্যকে বসিয়ে একটি আখের সমান উচ্চতা পাওয়া যেতে পারে।
সাধারণত উর্বর জমিতে, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আখের ভালো ফলন হয়। পরিপক্ব আখের ওপরের অংশ কেটে নেওয়া হয় চিনি প্রস্তুতির জন্য। আর গোড়ার দিকের অংশ জমিতেই থেকে যায়। সেখান থেকে পুনরায় আখ চাষ করা যায়, ওই রেখে দেওয়া আখের গোড়া থেকে জন্মায় নতুন আখ। একবার আখ কাটা হয়ে গেলে দ্রুত তার পচন শুরু হয়ে যায়, এ জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে ফেলা আখকে ব্যবহার করে চিনি প্রস্তুত শুরু করতে হয়। খেত থেকে ফ্যাক্টরি পর্যন্ত যাতায়াতব্যবস্থা ভালো না হলে অনেক লোকসানে পড়তে হয়।
এই যে আখ নিয়ে আসা হলো ফ্যাক্টরিতে, এখানে প্রথমেই আখগুলো খুব ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। যাতে একটুও বালু, মাটি বা অপ্রয়োজনীয় গাছের অংশবিশেষ না থাকে। এরপর খুব ছোট ছোট টুকরা করা হয় অনেকগুলো ধারালো দা–এর মতো অংশ দিয়ে তৈরি প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণমান এক যন্ত্র ব্যবহার করে।
এরপর আখের পুরু শক্ত আবরণ তুলে ফেলা হয়। এখন এটি প্রস্তুত রস বের করে নেওয়ার জন্য। মিলিং মেশিনে অনেক জোরে চাপ প্রয়োগ করে আখের রস বের করে নেওয়া হয়। রসহীন শুষ্ক অংশকে বলে ব্যাগ্যাস বা আখের ছোবড়া, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আখের মিষ্টি রস তো পাওয়া হয়ে গেল, এরপর একে ভালো করে ছেঁকে ভাসমান ময়লা দূর করা হয়। তারপর এতে কিছু লাইম (ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইডের দ্রবণ) মেশানো হয়। কারণ, আখের রসে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু পরিমাণ ফসফরাসের যৌগ ফসফেট হিসেবে উপস্থিত থাকে। যখন লাইম এতে মেশানো হয়, তখন ক্যালসিয়াম ফসফেটের অধঃক্ষেপ পড়ে, এই অধঃক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে রসে দ্রবীভূত অপ্রয়োজনীয় ময়লাগুলোও আলাদা হয়ে যায়। নিচে পড়ে থাকে অধঃক্ষেপের স্তর আর ওপরে পরিষ্কার আখের রস। এই রসকে এবার বেশ বড়সড় এক পাত্রে নিয়ে ভালো করে জ্বাল দেওয়া হয়, অনেকটা বড় হাঁড়িতে নিয়ে দুধ জ্বাল দেওয়ার মতো। দুধ অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাতে থাকলে যেমন একসময় দেখা যাবে দুধটা বেশ ঘন হয়ে এসেছে, একপর্যায়ে কেবল ননিই পাওয়া যাবে। আখের রসের ক্ষেত্রেও অনেকটা সে রকমই। কেবল হাঁড়ির জায়গায় অনেক, অনেক বড় পাত্র ব্যবহার করা হয় এবং এত বড় পাত্রকে তাপ দিতেও বেশ উচ্চ শক্তিসম্পন্ন তাপীয় যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এখানে মূলত তাপ দিয়ে রসে উপস্থিত পানিকে বাষ্পে পরিণত করে আখের রসের ঘনত্ব অনেক বাড়িয়ে ফেলা হয়।
এবার চিনির স্বচ্ছ স্ফটিক প্রস্তুতির ধাপ। অধিক ঘনত্বের এই রসকে অনেক ঠান্ডা করলে স্বচ্ছ দানাদার চিনির স্ফটিক তৈরি হয়। চিনির এমন স্ফটিকীকরণকে আরও দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য এবং সব চিনির দানা যাতে অনেকটা একই রকম হয়, সে জন্য আগে থেকেই অল্প কিছু চিনির দানা ওই ঘন রসে দেওয়া হয়। বেশ কিছু সময় পর প্রায় সমগ্র রস চিনির স্ফটিকে পরিণত হয়। চিনি তো তৈরি হয়ে গেল, এবার একে অবশিষ্ট ঘন রস থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। অবশিষ্ট ঘন রসকে বলা হয় মোলাসেস। কিছু পরিমাণ মোলাসেস চিনির দানায় থেকে যায়, যার জন্য এই চিনির রং হয় হালকা বাদামি। এবার একে ড্রায়ার মেশিনে পাঠানো হয়, সেখানে গরম বাতাসের প্রবাহ দিয়ে চিনির আর্দ্রতার পরিমাণ কমিয়ে আনা হয় যাতে চিনি সংরক্ষণ সহজ হয় এবং চিনি গলে না যায়। কি, একটু খটকা লাগছে, কেন চিনির রং বাদামি হলো? আমরা তো সচরাচর সাদা চিনিই খাই। এর কারণ হলো চিনি প্রস্তুতির ধাপে অনেক সময় কিছু পরিমাণ ব্লিচিং এজেন্ট দেওয়া হয়, তখন আখের রসে থাকা যেকোনো রঙিন যৌগ থাকলে তা আলাদা হয়ে যায়। আবার শেষ ধাপে সব মোলাসেস চিনি থেকে সরিয়ে ফেললেই ধবধবে সাদা চিনি পাওয়া যায়।
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে কোন চিনি তাহলে বেশি ভালো? সাদা না বাদামি? এর উত্তর হচ্ছে দুই চিনিই প্রায় একই রকম গুণসম্পন্ন। বাদামি চিনিতে মোলাসেস উপস্থিত থাকে বলে এতে সামান্য কিছু পরিমাণ খনিজ পদার্থ (যেমন ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম) থাকে, যা সাদা চিনিতে থাকে না। কিন্তু এই খনিজ পদার্থের পরিমাণ খুবই কম থাকে বলে দুই চিনির ভেতরকার পার্থক্যও খুব কম। অন্যদিকে সাদা চিনি দেখতে যেমন পরিষ্কার, তেমনি এটা দিয়ে তৈরি খাবারের রং ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে এটাই বহুল ব্যবহৃত। এখন তোমার পছন্দমতো চিনি বেছে নাও। বাজারে খুঁজলে কিন্তু দুই চিনিই পাবে, তবে বাদামিটার জন্য খোঁজের মাত্রা বেশি হবে, কারণ এটি বহুল ব্যবহৃত নয়।
চিনির এই গল্প প্রায় শেষ। তবে শুরুটা যেমন রবিঠাকুরের লাইন দিয়ে করেছিলাম, শেষটাও তেমনি হোক? রবিঠাকুরের ‘...শেষ হয়ে হইল না শেষ...’–এর মতো চিনির গল্পের একাংশ বাকি রয়ে গেল। সেটা হলো আমরা যে চিনি খাই তা কি শুধুই আখের রস ব্যবহার করে তৈরি করা হয়? নাকি অন্য কোনো কিছু থেকেও বানানো যায় এই চিনি? এর উত্তরটা তোমরা খুঁজে বের করতে পারো। সে গল্প এবারের মতো তোলা থাক।