প্রথমে একটা কোলন, তারপর একটা হাইফেন। আর সবশেষে বড় হাতের ইংরেজি অক্ষর ‘উ’। কী হলো বলো তো? নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, এটা দাঁত বের করে হাসার একটা সংকেত। ইংরেজিতে যাকে বলে ইমোটিকন। তোমরা এ রকম ইমোটিকনের সঙ্গে খুব পরিচিত এবং হরহামেশাই এগুলো ব্যবহার করো। এগুলো আসলে একধরনের প্রতীক। চিন্তাভাবনাকে সহজভাবে প্রকাশের জন্য প্রতীক ব্যবহৃত হয়। আবার নির্দেশনা প্রদানের ক্ষেত্রেও প্রতীক ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কে কবে প্রথম প্রতীক আবিষ্কার করেছে তা জানা যায়নি। তবে স্থান ও সময়ভেদে অনেক প্রতীকের উদ্ভাবন সম্পর্কে জানা যায়। চলো প্রচলিত কিছু প্রতীকের মানে জেনে নিই।
শান্তির প্রতীক
প্রতীকটির মর্মার্থ হচ্ছে, একটা মানুষের দুটো হাতে দুই দেশের পতাকা। যা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে দুটি দেশের মধ্যে অস্ত্রের সম্পর্ক নয়, হওয়া উচিত শান্তির সম্পর্ক।
জলি রজার
প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে এটি ব্যবহার করত জলদস্যুরা। কালো পতাকায় জলি রজার থাকা মানে প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণের আহ্বান। আর লাল পতাকায় থাকার অর্থ প্রতিপক্ষের ধ্বংস বোঝায়। এখন বিপজ্জনক বা বিষাক্ত কোন কিছু বোঝাতেই এটি ব্যবহৃত হয়।
জেন্ডার প্রতীক
জ্যোতির্বিদ্যায় মার্স আর ভেনাসের বেশ প্রাধান্য হয়েছে। এখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছে প্রতীক দুটি। ঊর্ধ্বমুখী তির-ধনুকটি পুরুষ অর্থে আর নিম্নমুখী ক্রুশচিহ্ন নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
ক্যাডিউসিয়াস
প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যায় মুখোমুখি দুটি সাপ ও পাখা দিয়ে বোঝানো হতো মানুষের ভালো আর মন্দ এ দুই রূপকে। কিন্তু গ্রিক পুরাণ ক্যাডিউসিয়াসকে চিহ্নিত করেছে জরা থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে। এ জন্যই বর্তমানে অনেক হাসপাতালে এ প্রতীক দেখা যায়।
হাতুড়ি আর কাস্তে
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার বোঝাতে হাতুড়ি আর কাস্তে ব্যবহৃত হয়। ১৯২২ সাল থেকে রাশিয়ায় এই প্রতীকটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। এখন গোটা বিশ্ব সাম্যবাদের প্রতীক হিসেবে চেনে এই হাতুড়ি আর কাস্তেকে।
নৈরাজ্যের প্রতীক
অ্যানার্কি মানে নৈরাজ্য। এ জন্যই এ প্রতীকে ইংরেজি বর্ণ ‘অ’ দেখা যায়। এ ছাড়া এখানে ‘ঙ’ বর্ণ দিয়ে বোঝানো হয় অর্ডার। একসঙ্গে অ্যানার্কি ইজ অর্ডার। যেসব দেশে মারামারি, হানাহানি বেশি সেসব দেশে নির্দিষ্ট স্থানে এ রকম প্রতীক দেখা যায়।
স্মাইলি
এ প্রতীক ১৯৬০ সালে আবিষ্কৃত হয়। ১৯৬২ সালে নিউইয়র্কের এক রেডিও স্টেশন তাদের প্রচারণার জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার নির্ধারণ করা হয় স্মাইলি আঁকা সোয়েটার। এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সত্তরের দশকে এর আরও নতুন নতুন রূপ তৈরি হয়।
জরিপে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রতীকের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে স্মাইলি।
পেন্টাকল
পেন্টাকল প্যাগান বা প্রকৃতি পূজারিদের ধর্মীয় প্রতীক। আবার ডাইনি, ফ্রিম্যাসন বা গুপ্ত সংগঠনের প্রতীকও এটি। পেন্টাকল ভেনাসেরই প্রতীক, যা ভালবাসা এবং সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে। তবে জাদুবিদ্যায় এটি সলোমনের সিল হিসেবেও পরিচিত। এর চারটি বিন্দু পৃথিবীর মূল উপাদান আগুন, পানি, মাটি আর বাতাসের প্রতীক। আর পঞ্চম বিন্দুটি আত্মা নির্দেশ করে। বৃত্তটি অনন্ত বা অমরত্ব নির্দেশ করে। পেন্টাকলের উল্টো প্রতীক শয়তান পূজারিরা ব্যবহার করে বিশ্বাস অনেকের।
বিকিরণ সংকেত
ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করতে এটি ব্যবহার হয়। হলুদ ওপর কালো বা গোলাপি তিনটি প্রপেলার থাকে এতে।
হর্সশ্যু
অশুভ দৃষ্টির হাত থেকে নিজেদের রক্ষায় গ্রিসের মানুষ দরজায় ঘোড়ার খুর ঝুলিয়ে রাখত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এটি তাদের আয়-রোজগার বৃদ্ধি করবে, মেধা ও প্রজ্ঞা বাড়াবে। এমন কুসংস্কার এখন অনেকেই বিশ্বাস করে না। তবে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশে এটি ব্যবহৃত হয়।
ডেভিল হর্ন
হেভি মেটাল ব্যান্ডের শিল্পীদের এ রকম প্রতীক ব্যবহার করতে দেখা যায়। প্রাচীনকাল থেকেই নাচের মুদ্রা বিভিন্ন অর্থ বহন করে। এ রকমই একটি নাচের মুদ্রা থেকে প্রতীকটি এসেছে। এই প্রতীক দ্বারা বোঝায় ‘উপকারী’। এর শুরুটা করেছিলেন রনি জেমস ডিও নামক এক শিল্পী। তবে প্রাচীনকালে শয়তানের শিং বোঝাতে প্রতীকটি ব্যবহার করা হতো। তাই এখনো নানা দেশে এর ভিন্ন অর্থ প্রচলিত আছে।
রিসাইক্লিং
কোনো কিছু পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করা সম্ভব বোঝাতে এটি ব্যবহার হয়। তিনটি তির দিয়ে একটি চক্র বোঝানো হয়েছে। বস্তুভেদে (যেমন: প্লাস্টিক, কাগজ বা কাচ) এ প্রতীকের রং বা ডিজাইনে পার্থক্যও থাকে।
সর্ব সাক্ষাৎ নয়ন বা ইলুমিনাটি
এটি একটি বিশ্বজনীন সংকেত, যার দ্বারা আধ্যাত্মিক দৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি, অভেদ্য রহস্য দর্শনকে বোঝানো হয়। প্রাচীন মিশরে এটি সূর্য দেবতা হোরাসের চোখ হিসেবে পরিচিত ছিল। গুপ্ত সংগঠন ইলুমিনাটি ও মেসোনরা এই প্রতীক ঈশ্বরের সর্বদর্শী চোখ হিসেবে ব্যবহার করে। মার্কিন ডলারে এই চিহ্নটি ব্যবহার করা হয়েছে।
ইন ইয়াং
চীনা ধর্ম তাওবাদীদের প্রতীক এটি। প্রতীকের কালো অংশ ইন আর সাদার নাম ইয়াং। একত্রে ইন ও ইয়াং। ইন স্ত্রীবাচক ও রাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইয়াং সক্রিয়, পুরুষবাচক ও সূর্য বোঝায়। চীনা দর্শনমতে, এ দুটি বিপরীতধর্মী শক্তি বিশ্বজগতের ভারসাম্য রক্ষা করছে।
ডেভিডের তারা
ইহুদিদের কাছে এটি স্টার অব ডেভিড (দাউদ) বা ডেভিডের তারা হিসেবেও পরিচিত। আবার সিক্স পয়েন্ট স্টার নামেও এর পরিচিতি আছে। ইসরায়েলের পতাকায় এ প্রতীক দেখা যায়। তবে ইহুদিদের আগে থেকেই এটি বৌদ্ধ, হিন্দু এবং জৈন ধর্মানুসারীরা ব্যবহার করে আসছে।
ওম
হিন্দুধর্মের পবিত্র প্রতীক। হিন্দু দর্শনের সর্বোচ্চ ঈশ্বর ব্রহ্মকে বোঝাতে এ প্রতীকটি ব্যহার করা হয়। শুধু হিন্দুই নয়, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ ধর্মানুসারীরাও এই প্রতীকটি পবিত্র হিসেবে মানে।
স্বস্তিকা
পশ্চিমা বিশ্বে স্বস্তিকা (জার্মান ভাষায় সেবাস্তিকা) চিহ্নটি আতঙ্কের। কারণ হিটলারের নািস বাহিনীর প্রতীক ছিল এটি। তবে খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই ভারত, গ্রিস, মিশর, রোমান, চীনসহ অন্যান্য সভ্যতায় এর ব্যবহার দেখা যায়। ভারতের হিন্দু ধর্মে এটি পবিত্র এবং দেবতা বিষ্ণুর প্রতীক। এছাড়া বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের কাছেও এটি পবিত্র। সংস্কৃতে এর অর্থ সৌভাগ্য।
অ্যালকেমি
অ্যালকেমি প্রতীকটি ত্রিভুজ, বৃত্ত ও বর্গের সমন্বয়ে গঠিত। অর্থাৎ, বিভিন্ন কাঠামো দিয়ে এটি তৈরি, যা মূলত বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়কে নির্দেশ করে। পুরাণ মতে, অ্যালকেমি জাদুবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। জাদুর ক্ষেত্রে যেমন অনেক তন্ত্রমন্ত্র জানতে হয়, অ্যালকেমির ক্ষেত্রেও তা-ই। অনেক উপাদানকে সমন্বয় করে এই অ্যালকেমির সৃষ্টি। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে এই প্রতীকের প্রচলন শুরু হয়।
অসীম
প্রাচীন ভারত ও তিব্বতে এই প্রতীকটিকে পরিপূর্ণতা, দ্বৈতবাদ, নারী-পুরুষ একাত্মতার পরিপন্থী হিসেবে মানা হতো। গণিতশাস্ত্রে এটি অসীম সংখ্যার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
প্রতীকের সঙ্গে আরেকটি বিষয় সম্পর্কিত। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা। অনেকে মনে করেন, ইশারা ভাষার ধারণা এসেছে প্রতীক ধারণাটি থেকে। ইশারা ভাষা কিন্তু দেশভেদে ভিন্ন হয়। তেমনি অনেক প্রতীক আছে, যেগুলোর অর্থ দেশভেদে ভিন্ন হয়। তাই কোন প্রতীক কোন দেশে দেখছ, সে অনুযায়ী এর অর্থ নির্ধারণ করো।