চেনা শব্দগুলো

শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক সর্বদা চিরস্থায়ী নয়। বহু শব্দ প্রায়ই তার মূল অর্থ পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ গ্রহণ করে। বিশ্বের সব ভাষাতেই এমনটা ঘটে। ভাষার সঙ্গে মানুষের মনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মানুষের মনের বিচিত্র মতিগতির কারণে শব্দ তার মূল অর্থ ছেড়ে দিয়ে নতুন অর্থ ধারণ করে। অভিধানের গল্পতে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের নানান ঘটনা তুলে ধরা হয়। আজও তার ব্যত্যয় ঘটছে না। বাংলার সঙ্গে থাকছে বাংলা হয়ে যাওয়া বিদেশি শব্দও।
অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

জেরবার

বাঙালির মুখে একদা জেরবার, পেরেশান, পেরেশানি, হয়রান ইত্যাদি শব্দ বেশ চালু ছিল। ইদানীং এসব শব্দের ব্যবহার বেশ কমে এসেছে। পরিবর্তে শহুরে শিক্ষিত মানুষের মুখে এসেছে বিচিত্র সব ইংরেজি শব্দ। সাধারণ মানুষ ইংরেজি বোঝে না। তারা তাদের পুরোনো শব্দগুলোই ব্যবহার করে।

জেরবার শব্দটা এখনো সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ একটা শব্দ। কেউ দেনায় দেনায় জেরবার হয়, কেউ মোকদ্দমার পর মোকদ্দমায় জেরবার হয়। নানা কারণে বিপর্যস্ত কেউ যখন বলেন ‘একেবারে জেরবার হয়ে গেলাম’, তখন তার অভিব্যক্তিটা শুধু জেরবার শব্দেই বোঝানো সম্ভব।

জেরবার ফারসি ভাষা থেকে আসা শব্দ। জেরবার বলতে আমরা বুঝি পর্যুদস্ত, পরাস্ত, বিধ্বস্ত প্রভৃতি অবস্থা। ফরাসি বাগ্ধারা জের ওয়াবার, বাংলায় হয়েছে জেরবার। ফরাসি জের মানে নিচে আর বার হলো বোঝা। মোট কথা, জের ওয়াবার বাগ্ধারার অর্থ হলো বোঝার নিচে চাপা পড়া। এ রকম অবস্থায় যে পড়ে তার অবস্থা সত্যিই বেগতিক।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

ব্র্যান্ড

ব্র্যান্ড শব্দটার ইদানীং বেশ চল হয়েছে। ঘড়ি, চশমা, শার্ট-প্যান্ট ইত্যাদি কিনতে গেলে শুনতে হয় এগুলো ব্র্যান্ডের জিনিস, তাই দামটা বেশি। আমাদের তারকা জগতের অনেকেই বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হন।

ব্র্যান্ডের পণ্যের দামও যেমন বেশি, বৈশিষ্ট্যেও তেমনি আলাদা। ব্র্যান্ডের পণ্য সবার পক্ষে কেনা ও ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। ব্র্যান্ডের পণ্যে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ধরনের চিহ্ন বা নাম থাকে। ফলে পণ্যটাকে সহজেই চেনা যায়। তবে সবাই যে কিনবেন তা নয়, যিনি ব্যবহার করেন কিংবা যিনি ওই ব্র্যান্ডের সঙ্গে পরিচিত, তাঁর পক্ষেই শুধু তা চেনা সম্ভব।

ব্র্যান্ড বাংলাদেশে একেবারেই হাল আমলের শব্দ। বিখ্যাত পণ্যের বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন বা নাম বাংলাদেশে আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে তার নাম মার্কা। অমুক মার্কা তেল, অমুক নামের বনস্পতি ঘি, অমুক মিলের কাপড় (রেডিমেড নয়) ব্যবহার করাটা অনেকেরই পছন্দের ব্যাপার ছিল। তবে তাঁরাও কিন্তু বিত্তবান শ্রেণির। সাধারণ মানুষ সাধারণ জিনিসই কিনতেন, এখনো কেনেন।

বাংলা মার্কা শব্দটা পর্তুগিজ ভাষা থেকে আসা। ইংরেজি মার্ক শব্দের যে অর্থ, পর্তুগিজ মার্কা শব্দেরও মোটামুটি ওই একই অর্থ। তবে ইংরেজি মার্ক শব্দের অর্থের প্রকারভেদ ও বিস্তৃতি অনেক বেশি।

ভাষায় শব্দ ব্যবহারেরও সামাজিক শ্রেণিভেদ রয়েছে। মার্কা এখন সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত শব্দ। কিন্তু ব্র্যান্ড বিত্তবানদের।

ব্র্যান্ড শব্দটা বাংলায় এসেছে ইংরেজি থেকে। আর ইংরেজি ভাষা ব্র্যান্ড শব্দটা পেয়েছে জার্মান ব্রান্ড শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পোড়া বা পোড়ানো। আগুনে অনেক কিছুই পোড়ানো হয়। তবে ব্র্যান্ডের পণ্য বা ব্র্যান্ডওয়ালা জিনিস বলতে আমরা এখন যা বুঝি তার পেছনে ঘটনা রয়েছে।

মধ্যযুগের ইউরোপে সম্পদশালী ব্যক্তিদের পশুখামার থাকত। খামারে থাকত গরু ও ঘোড়া। নিজেদের খামারের গরু-ঘোড়াকে চেনার জন্য নিজেদের নামের আদ্যাক্ষর কিংবা বিশেষ কোনো চিহ্ন দেওয়ার জন্য লোহার ছাঁচ আগুনে পুড়িয়ে তারা গরু-ঘোড়ার গায়ে ছাপ এঁকে দিত। এভাবেই পশুর মালিককে চেনা যেত পশুর গায়ের ছাপ দেখে।

একালের ব্র্যান্ডের পণ্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিখ্যাত পণ্যে যে চিহ্ন বা নাম ব্যবহার করে তা সেকালের গরু-ঘোড়ার গায়ে ছাপ দেওয়ার ধারাবাহিকতা মাত্র। আসলেই ব্র্যান্ডের পণ্য চেনা যায় নাম দিয়ে এবং চিহ্ন দেখে।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

মুমুর্ষ

একজন মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ...—এ রকম আবেদন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে মাঝেমধ্যেই শোনা যায়।

রাস্তায় মুমূর্ষু অবস্থায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখলে দরদি মানুষেরা তার কাছে ছুটে যান। সেবা-শুশ্রূষার চেষ্টা করেন। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে মুমূর্ষু লোকটাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মুমূর্ষু লোক বলতে আমরা সাধারণত বুঝি যার মৃত্যুকাল আসন্ন কিংবা যার অবস্থা মর-মর। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ডাক্তারগণ ব্যতিব্যস্ত হন। রোগীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে তার জন্য ‘লাইফ সাপোর্ট’-এর ব্যবস্থা করা হয়।

মুমূর্ষু বলতে আমরা এখন যা বুঝি, শব্দের মূল অর্থ কিন্তু তা নয়। মুমূর্ষু শব্দটি তার মূল অর্থ পরিত্যাগ করে বর্তমান অর্থ ধারণ করেছে। সংস্কৃত থেকে বাংলায় অসংখ্যবার শব্দটির অর্থ যদি পরিবর্তিত না হতো তাহলে মুমূর্ষু ব্যক্তিকে নিয়ে একালের মানুষের অবস্থা ভিন্নতর হতো। হাসপাতালে পাঠানোর পরিবর্তে মানুষ হয় তাকে পাগলাগারদে নইলে থানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করত।

মুমূর্ষু শব্দের মূল অর্থ যে মরতে ইচ্ছুক বা যে মৃত্যু অভিলাষী অর্থাৎ আত্মহত্যাকারী। বাংলাদেশের আইনে এ ধরনের ঘটনা দণ্ডনীয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

ক্যান্ডি

ক্যান্ডির সঙ্গে ছোটদের বোধকরি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ক্যান্ডির চেহারা, রং এবং স্বাদ-গন্ধই বলে দেয় এটা কী জিনিস। ইংরেজি-বাংলা অভিধানে ক্যান্ডি শব্দ পাওয়া যায়। সংক্ষেপে বলা হয়েছে, ক্রমাগত জ্বাল দিয়ে শক্ত পিণ্ডে পরিণত করা চিনির খণ্ড হলো ক্যান্ডি।

একালের বুড়োরা যখন ছোট ছিল তখন ক্যান্ডি ছিল না, ছিল লজেন্স—খানিকটা একালের ক্যান্ডির মতোই। ক্যান্ডির মতো লজেন্সও ইংরেজি শব্দ। ছোটদের মুখে এমনকি বড়দেরও অনেকের মুখেও শব্দটা শুধু ইংরেজিতে উচ্চারিত হতো না। কেউ বলত লজেঞ্চুস, বোধকরি চোষা হতো বলে। আবার কেউ বলত লবেঞ্চুস অথবা লেবেঞ্চুস।

লজেন্সের রং, স্বাদ-গন্ধ, আকার-আকৃতি ক্যান্ডির মতো বৈচিত্র্যময় ছিল না। সেকালের লজেন্স ছিল প্যাঁচানো। গোলাপি, সবুজ, হলুদ দাগযুক্ত। আকার অনেকটা মার্বেলের মতো। পরে এসেছিল কাঠি লজেন্স। ছোট্ট কাঠির আগায় লাল রঙের চ্যাপটা গোল লজেন্স। আকার অনেকটা দুই টাকার কয়েনের মতো। তবে অনেক পুরু। অনেকক্ষণ চুষে জিব লাল করা যেত।

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল। ফিরে আসি ক্যান্ডির কথায় অর্থাৎ ক্যান্ডি শব্দে। ক্যান্ডি শব্দটার চল আমেরিকা থেকে শুরু। শব্দটা অবশ্য ইংরেজি নয়, ফারসি। তবে ঠিক ফারসিও নয়, আরবি। আরবি ভাষার কন্দ শব্দ ফারসি হয়ে ইংরেজিতে গিয়ে ক্যান্ডি রূপ ধারণ করেছে। আরবি-ফারসি ভাষায় কন্দ শব্দের অর্থ চিনির ডেলা বা মিছরির টুকরো বা খণ্ড।

আরবি ও ফারসির কন্দ শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত কণ্ড শব্দের বেশ মিল রয়েছে। যেমন মিল রয়েছে সংস্কৃত শর্করা শব্দের সঙ্গে আরবি শক্কর শব্দের। পণ্ডিতদের মতে, সংস্কৃত শর্করা ও কণ্ডই আরবি ও ফারসিতে শক্কর কন্দ শব্দে পরিণত হয়েছে। আবার আরবি এই কন্দ শব্দই ইংরেজিতে গিয়ে হয়েছে ক্যান্ডি।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

কসমেটিক্স

কসমেটিকস ইংরেজি শব্দ। বাংলা হলো প্রসাধনী বা প্রসাধনসামগ্রী। কসমেটিকস ব্যবহার করা হলো প্রসাধনচর্চা। তবে বাস্তবতা হলো এই যে বাংলা শব্দগুলো এখন শুধু পাওয়া যাবে লিখিত ভাষায়, বাঙালির মুখের ভাষায় নয়। তাই কসমেটিকস শব্দটাকে এখন বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে ঠাঁই দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

গ্রিক শব্দ কসমস থেকে ইংরেজি কসমেটিক শব্দের উৎপত্তি। কসমস শব্দের অর্থ হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা শৃঙ্খলাবদ্ধ মহাজগৎ। গ্রিক শব্দটি থেকে ইংরেজি কসমেটিক শব্দ তৈরি হয় সতেরো শতকের গোড়ার দিকে। কসমেটিক শব্দের অর্থ তখন ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ। পরে যখন শব্দটা কসমেটিকস হলো তখন তার অর্থ হলো প্রসাধনী বা প্রসাধনসামগ্রী। ব্যাখ্যা দেওয়া হলো, যে নারী কসমেটিকস ব্যবহার করেন তিনি তো তার মাধ্যমে দেহের রূপলাবণ্যকে শৃঙ্খলার মধ্যেই নিয়ে আসেন।