ছেলেবেলা থেকেই প্রোগ্রামার

‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’—বহুল প্রচলিত একটা ইংরেজি প্রবাদ। মেসি হোক বা নেইমার, এমনকি সাকিব আল হাসান—আমাদের এই যুগের সুপার হিরোদের বেলায় সকালটাই বলে দিয়েছিল বেলা শেষে কী হবে। ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গের কথাই ধরা যাক। দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছেন এক ফেসবুক বানিয়ে। হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কম বয়সী ‘বিলিয়নিয়ার’। সোজা বাংলায় কোটিপতি বললেও কম বলা হয়। এক বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি ডলারের মালিক তিনি। তাও হয়েছেন কয়েক বছর আগে। জাকারবার্গের বয়সটা এতই কম যে বাংলাদেশে থাকলে আগামী বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারতেন। ৩০ এখনো পূর্ণ হয়নি জাকারবার্গের। এরই মধ্যে ২০১১ সালে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী  টাইম -এর বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব।

সকালটাই যে বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে, সে কথায় আসি এবার। যে বয়সে শিশু-কিশোরদের কম্পিউটার চালানো মানে গেমস খেলে সময় কাটানোর কথা, সে বয়সে ০ আর ১ নিয়ে মাতামাতি দেখা যায় জাকারবার্গের মধ্যে। বয়স যখন তার ১২, তখনই একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম বানিয়ে ফেললেন তিনি। সেটা বল ড্রপ খাওয়ানো বা একটা বিন্দু বড় হতে হতে বল হয়ে যাওয়ার মতো প্রোগ্রাম না, রীতিমতো কাজের প্রোগ্রাম। জাকারবার্গের বাবা এডওয়ার্ড জাকারবার্গ ছিলেন দাঁতের ডাক্তার। মার্কের তৈরি করা ‘জ্যাকনেট’ প্রোগ্রামটি তাঁর চেম্বারে ব্যবহার করতেন এডওয়ার্ড। চেম্বারে নতুন কোনো রোগী এলে অভ্যর্থনাকারী জাকনেট দিয়ে এডওয়ার্ডকে সেই তথ্য জানাতে পারতেন। এই প্রোগ্রামটি জাকারবার্গ লেখেন আটারি বেসিক নামের একটি প্রোগ্রামিং ভাষা দিয়ে। তথ্য জানিয়ে একধরনের যোগাযোগ ঘটানোর কাজই করত জ্যাকনেট। ফেসবুকের একটু আভাস তো মনে হয় এখান থেকেই মিলছে।

১৯৮৪ সালের ১৪ মে মার্ক জাকারবার্গের জন্ম নিউইয়র্কের হোয়াইট প্লেইনস এলাকায়। বাবার কথা তো বলা হলো, দাঁত নিয়ে যাঁর কারবার। আর মায়ের কাজ মানুষের মন নিয়ে—কারেন জাকারবার্গ পেশায় ছিলেন একজন মনোবিজ্ঞানী। মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে জাকারবার্গ। বাকি তিন বোন—র‌্যান্ডি, ডোনা ও অ্যারিয়েলে জাকারবার্গ। হোয়াইট প্লেইনসে জন্মালেও জাকারবার্গের বেড়ে ওঠা বাড়ির কাছাকাছি ডবস ফেরি নামের এক গ্রামে।

উচ্চশিক্ষিত, সচ্ছল পরিবারে শৈশব যেমন কাটে, মার্কের বেলায় তার তেমন হেরফের হয়নি। পার্থক্য একটাই, এই ছেলে শৈশবের দুরন্তপনার পাশাপাশি মেতে উঠেছিল কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করার নেশায়। যে জ্যাকনেট তৈরি করেছিলেন বারোতে, সেটা বাবার চেম্বার থেকে চলে এসেছিল নিজেদের বাড়িতে। ভাই-বোন, মা-বাবা নিজেরা বাড়ির মধ্যে এটা দিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এটার পরপরই জাকারবার্গ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বানিয়েছিলেন একটা কম্পিউটার গেমস। ‘আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ছিল, যারা ছবি আঁকতে পারত। তারা আমার বাসায় আসত, ছবি এঁকে দিত একের পর এক। আর আমি সেসব ছবি ব্যবহার করে প্রোগ্রাম লিখে লিখে গেম বানিয়ে ফেলেছিলাম’—নিজের গেম তৈরি সম্পর্কে এমন কথাই পরে বলেছেন মার্ক জাকারবার্গ।

জ্যাকনেটের ব্যবহার থেকেই বোঝা যায়, ছেলের কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরির কাজটাকে উৎসাহ দিতেন এডওয়ার্ড। তাই ছেলের জন্য কম্পিউটারের গৃহশিক্ষক নিয়োগ করে দেন তিনি। সেই শিক্ষক ডেভিড নিউম্যান সপ্তাহে এক দিন যেতেন জাকারবার্গের বাড়ি আর তাকে নিয়ে কম্পিউটারের কাজ করতেন। নিউম্যান জাকারবার্গ সম্পর্কে পরে বলেছেন, ‘এমন বিস্ময়বালকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া কঠিন।’

মা-বাবা ও দুই বোনের সঙ্গে মার্ক জাকারবার্গ
মা-বাবা ও দুই বোনের সঙ্গে মার্ক জাকারবার্গ

শুরুটা স্থানীয় স্কুলে হলেও পরে জাকারবার্গের স্কুলজীবন কাটে নিউ হ্যাম্পশায়ারের খুব উন্নত প্রিপারেটরি স্কুল ফিলিপস এক্সেটার একাডেমিতে। এখানে এসেও চলতে থাকে প্রোগ্রামিং। তবে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন ফেন্সিংয়ে (বিশেষ ধরনের তলোয়ার খেলা)। এ খেলায় স্কুল দলের দলনেতা ছিলেন তিনি। এখানে পড়ার সময়ই জাকারবার্গ তৈরি করেন নিজের পছন্দমতো গান শোনার সফটওয়্যার ‘প্যান্ডোরা’র প্রাথমিক সংস্করণ। আর তখন এটা কিনে নিতে চাইছিল আমেরিকান অনলাইন লিমিটেড (এওএল) ও মাইক্রোসফট। কিন্তু জাকারবার্গ বিক্রি করেননি।

স্কুল শেষে ২০০২ সালে জাকারবার্গ ভর্তি হন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও কোর্সম্যাচ আর ফেসম্যাশ প্রোগ্রাম তৈরি করে হইচই ফেলে দেন। হার্ভার্ড থেকে ডিগ্রি নেওয়া হয়নি তাঁর। তবে যে কাজের জন্য জাকারবার্গ আজকের জায়গায় পৌঁছেছেন, তার গোড়াপত্তন এই হার্ভার্ডেই। সহপাঠী দিব্য নরেন্দ্র এবং ক্যামেরন ও টাইলার উইঙ্কলিভস নামের যমজদের নিয়ে জাকারবার্গ তৈরি করেন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট, যার নাম ছিল হার্ভার্ড কানেকশন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। এরপর বন্ধু এদুয়ার্দো স্যাভেরিন, অ্যান্ড্রু ম্যাক কুলাম ও ক্রিস হিউজের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দি ফেসবুক’। তাতে ধীরে ধীরে ছবি রাখা, মন্তব্য করার সুবিধা যোগ হতে থাকে। তবে ২০০৪ সাল পর্যন্ত হার্ভার্ডের ডরমিটরির বাইরে বেরোয়নি ফেসবুক। এ সময়টাতে দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র জাকারবার্গ, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পুরোটা সময় ফেসবুকে দিতে শুরু করেন। ২০০৪ সালের জুন মাসে জাকারবার্গ ফেসবুকের জন্য অফিস নেন ক্যালিফোর্নিয়ার প্যালো অ্যালটোতে। দ্রুতই এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ লাখে। আর এখন? ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১৫ কোটি।

প্রিসিলা চ্যান মার্ক জাকারবার্গ
প্রিসিলা চ্যান মার্ক জাকারবার্গ

জাকারবার্গ যখন প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করেন, তখন ফেসবুক থাকলে সেটা কি তিনি ব্যবহার করতে পারতেন? উত্তরটা হবে ‘না’। কারণ, ফেসবুকের নিয়ম হলো ১৩ বছরের আগে কেউ তা ব্যবহার করতে পারবে না।

২০১০ সালে বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট ও জর্জ লুকাসের সঙ্গে জাকারবার্গ সই করেছেন ‘গিভিং প্লেজ’ উদ্যোগে। তাঁরা নিজেদের সম্পদের ৫০ শতাংশ এ উদ্যোগে দান করবেন সারা বিশ্বের শিশুদের কল্যাণে। জাকারবার্গ চান, শিশুদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখানো হোক স্কুলে স্কুলে। এরই মধ্যে কোড ডট অর্গ নামে ওয়েবসাইট চালু হয়েছে এই উদ্যোগ থেকে। শিশুদের প্রোগ্রামিং শেখানোর কাজটাও শুরু হয়ে গেছে। সত্যি সত্যিই তিনি চান, আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে প্রযুক্তি দুনিয়ায় নিজেদের জায়গা করে নিক।

শেষে একটা তথ্য জানাই। তার আগে প্রশ্ন, আচ্ছা ফেসবুকের রং নীল কেন? কারণ, লাল আর সবুজ তাঁর কাছে ঝাপসা। এ দুটিতে তাঁর বর্ণান্ধতা আছে। তবে জাকারবার্গ নীল রংটা স্পষ্টভাবে দেখেন। আর তাই ফেসবুক নীল।

তথ্যসূত্র: বায়োগ্রাফি ডট কম, উইকিপিডিয়া