জলসবুজের ঝরনার দেশে

‘ঝরনা’ শব্দটার মধ্যেই একটা প্রাণোচ্ছল ব্যাপার আছে। ঝরনা সব সময়ই অবাধ্য, উন্মত্ত, উচ্ছ্বাসে ভরপুর এক জীবন্ত আনন্দ। আমাদের দেশে পাহাড়ের মাঝখানে সারাক্ষণ কলকল করতে থাকা উচ্ছ্বাসে ভরপুর ঝরনা আছে। একটা ঝরনা যেমন সৌন্দর্যের উত্স, তেমনি এই ঝরনাই পাহাড়ের পানির উত্স। পাহাড়কে ঘিরে বেঁচে থাকা সব মানুষের বেঁচে থাকার রসদ। আমাদের দেশটা ছোট হলেও ঝরনার কমতি নেই। দেশের পূর্ব-পশ্চিম এলাকাজুড়ে যত পাহাড় রয়ছে, তার প্রায় সব কটিতেই ঝিরিঝিরি ঝরনার অস্তিত্ব রয়েছে। এদের মধ্যে কোনো কোনোটা আবার দানবীয় আকারের। সামনে দাঁড়ালে মনে হয় কী ক্ষুদ্র আমি! আমার কিছু ঝরনা দেখতে কী ভীষণ সুন্দর! মন চায় সারাক্ষণ এর সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। আজ তোমাদের এমন কিছু ঝরনার গল্প শোনাব, যে ঝরনাগুলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আকারের দিক দিয়েও মনের মধ্যে স্থায়ী আবাস গড়ে যাবে। তোমরা যারা স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে একটু একটু করে বড় হচ্ছো, তারা কখনো সময় ও সুযোগ পেলে অভিভাবকদের সঙ্গে কিংবা নিজেরাই ঝরনাগুলোতে দেখে আসতে পারো। তার আগে একটু জেনে নিই ঝরনাগুলো সম্পর্কে।

জাদিপাই ঝরনা

জাদিপাই ঝরনা
জাদিপাই ঝরনা

বান্দরবানের গহিনে আকাশছোঁয়া পাহাড়গুলোর একেবারে পেটের ভেতরে লুকিয়ে আছে জাদিপাই ঝরনা। খুব সকাল রোদ পড়লে এই ঝরনার গায়ে একসঙ্গে ৪-৫টা রংধনু দেখা যায়। এর সামনে রয়েছে বিশাল সুইমিংপুলের মতো স্বচ্ছ জলাশয়, মনের আনন্দে যতক্ষণ ইচ্ছা সাঁতরে বেড়ানো যায় এখানে (যদি সাঁতার জানা থাকে)। অন্য ঝরনাগুলোর মতো পানি সরাসরি পড়ে না জাদিপাইয়ের। এর পাথরের ধাপগুলো এমন করে সাজানো যে ওপর থেকে পড়ে পানি চারদিকে ছড়িয়ে যায়। সেই পানি বৃষ্টির মতো ফোঁটায় ফোঁটায় নেমে আসে নিচের সুইমিংপুলের ওপরে। অতিকায় এই ঝরনা দেখতে তোমাকে প্রথমে যেতে হবে কাগজে-কলমে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া (আসলে চতুর্থ) কেওক্রাডাংয়ে, সেখান থেকে একটানা দেড় ঘণ্টা নিচের দিকে হেঁটে জাদিপাই পাড়ায়, সেখান থেকে জাদিপাই ঝরনা।

ধুপপানিছড়া ঝরনা

ধুপপানিছড়া ঝরনা
ধুপপানিছড়া ঝরনা

বাংলাদেশের ঝরনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দানবীয় হলো ধুপপানিছড়া ঝরনা। একটা ঝরনা এত বিশাল, কিন্তু এত শান্ত কীভাবে হয় তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝার সাধ্য নেই। রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার উলুছড়িতে অবস্থিত ধুপপানিছড়া ঝরনায় যেতে হয় কাপ্তাই লেক হয়ে। কাপ্তাইয়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই ঢুকে পড়তে হয় কোমরপানির অজানা এক জঙ্গলে। তারপর পাহাড়-ঝিরি-জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয় সে ঝরনার দেশে! ধুপপানিছড়া বাংলাদেশের একমাত্র ঝরনা যার নিচে না ভিজেও আরামে বসে থাকা যায়! এই ঝরনার একেবারে নিচে গুহার মতো বিশাল খালি জায়গা আছে। পানি ভেঙে সেখানে ঢুকে বসে সামনের পানির ধারা দেখার মধ্যে একটা শান্তির ব্যাপার আছে। এ জন্যই ধুপপানি পাড়ার ভান্তে (ধর্মীয় উপাসক) এখানে সপ্তাহের সোম থেকে শনিবার পর্যন্ত বসে ধ্যান করেন। ভালো কথা! শুধু রোববারেই যাওয়া যায় এই ঝরনায়। সপ্তাহের অন্য দিন এই ঝরনায় প্রবেশ নিষেধ, কারণ তাদের ধর্মীয় গুরু (ভান্তে) এই দিনগুলোতে এখানে ধ্যান করেন। বাংলাদেশের ধরনাগুলোর মধ্যে কেবল এখানেই যেমন স্লো মোশনে পানি পড়ে!

খইয়াছড়া জলপ্রপাত

খইয়াছড়া জলপ্রপাত
খইয়াছড়া জলপ্রপাত

একেবারে হাতের নাগালে ছোট্ট পাহাড়ের মাঝে ঘাপটি মেরে বসে আছে খইয়াছড়া জলপ্রপাত। এর পানি ঝরনার মতো অল্পধারায় পড়ে না, একেবারে হুড়হাড় করে পড়ে। তাই একে বলা হয় জলপ্রপাত। ঝরনায় সাধারণত একটা ধাপই থাকে। তবে খইয়াছড়ায় রয়েছে ১১টা ধাপ। ঢেউয়ের মতো থইথই পানি সারা দিন ধরে আছড়ে পড়ে এখানে। খুব বেশি দূরে না জলপ্রপাতটা। চট্টগ্রামের মিরসরাই হাইওয়ে থেকে পাহাড়ের দিকে মাত্র ৪৫ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে প্রকৃতির এই অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টির।

দামতুয়া ঝরনা

দামতুয়া ঝরনা
দামতুয়া ঝরনা

আবার ফিরে আসি বান্দরবানে। খুব সম্প্রতি আবিষ্কার হওয়া এই ঝরনা বান্দরবানের আলীকদম অনেক গহিনে কাখই পাড়ার নিচে অবস্থিত। এখানে যেতে হলে আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার এলাকায় নেমে আদুপাড়া হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয়। নানা চড়াই-উতরাই পেরোনো এই পথে ‘তুক অ’, ‘ওপাং’সহ আরও অনেক নাম না জানা ঝরনা পরে। দামতুয়া ঝরনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে একসঙ্গে তিনটা ঝরনা, এই তিনটা ঝরনার ওপরে আবার বিশাল এক জলপ্রপাত। এমন জলপ্রপাতসহ ঝরনা এর আগে বাংলাদেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি! সারাক্ষণ হুড়হাড় করে পড়তে থাকা পানির শব্দে নিজের কথাই শোনা দায়।

হামহাম জলপ্রপাত

হামহাম জলপ্রপাত
হামহাম জলপ্রপাত

সিলেটের শ্রীমঙ্গলে একেবারে ভারতঘেঁষা গ্রাম কলাবন। সেখানের রাজকান্দি বনে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের আরেক বিস্ময় হামহাম জলপ্রপাত। জীবজন্তু আর পাহাড়ি গাছের বৈচিত্র্যে ভরপুর এই জলপ্রপাত সীমানার হিসেবে ভারতের ভেতরে পড়লেও এখানে বাংলাদেশিদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ভরা বর্ষায় অনেক অনেক দূর থেকেও শোনা যায় এর পানির হুংকার। এখানেও রংধনু দেখা যায়। চাইলে হাত বাড়িয়ে ছুঁতেও পারবে! কলাবন গ্রাম থেকে দুভাবে হামহামে যাওয়া যায়—ঝিরিপথে এবং পাহাড়পথে। ঝিরিপথটা সুন্দর, কষ্টও কম। তবে প্রচুর জোঁক কিন্তু তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে। সাবধান।

রিঝুক ঝরনা

রিঝুক ঝরনা
রিঝুক ঝরনা

যারা নৌকা দিয়ে ঝরনা দেখতে যেতে চাও, তারা রাঙামাটির শুভলং ঝরনা দেখে নৌকা করে চলে আসতে পারো বান্দরবানের রুমা উপজেলার বাজারের পাশের এই ঝরনাটিতে। বছরের অন্য সময়ে রঝুক ঝরনা খুব চিকন ধারায় ঝরে। তবে বর্ষায় এর রূপ হয় দেখার মতো। ক্রুদ্ধ এক ষাঁড়ের মতো গর্জন করতে করতে আশপাশের পুরো এলাকা কাঁপিয়ে সাঙ্গু নদে এসে পড়ে এই ভয়াল রিঝুক। এর নিচে খুব নরম মাটি, একটু অসাবধান হলেই বুকসমান কাদায় ঢুকে যেতে হতে পারে। খুব কম সময়ে ঝরনা দেখার জন্য এটা ভালো একটা জায়গা।

হালাম ঝরনা

হালাম ঝরনা
হালাম ঝরনা

ঝিরিপথ ধরে হামহাম জলপ্রপাত যাওয়ার পথেই সিতাপ ঝরনা বলে একটা জায়গা আছে। তার বাঁ পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেই আরেকটা নতুন ঝরনা দেখতে পারা যায়, এটার নাম হালাম ঝরা। মজার ব্যাপার হলো এখানে কেউই যায় না, কারণ জানেই না যে এখানে এত সুন্দর আরেকটা ঝরনা রয়েছে। ফলে এই ঝরনা এখনো লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। সবাই হামহাম জলপ্রপাতে দাপাদাপি করেই ফেরত চলে যায়, আর এক কোণে পড়ে থাকে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসা ১০ ধাপের এই হালাম ঝরনা। এখানে খুব সুন্দর একটা ন্যাচারাল সুইমিংপুল আছে। ঝরনা ঘিরে রয়েছে নানান ধরনের ফলের গাছ, আর ওপরে রয়েছে একটা খাসিয়া পাড়া। সেটা ভারতের নাকি বাংলাদেশের এ বিষয়ে আমিও নিশ্চিত নই। তবে মাঝেমধ্যে ওপর দিয়ে গাড়ি যাওয়ার শব্দ শুনেছি!